আমি নিজের মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া অজেয় একিলিস নই । আমি নিজের প্রেমে আত্মহারা নার্কিসাস নই । আমি অসম্ভবকে সম্ভব করা মহাবীর ... হেরাক্লেস নই। আমি পৃথিবীর ভার ধরে থাকা এটলাস নই । দুর্গম পথ পারি দিয়ে আসা ইথাকার রাজা ওডিসিউস নই ।
আমি সৌন্দর্যের প্রতিরূপ আদোনিস ন
গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকের শুরুতেই মন্ত্রিসভার সব সদস্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে তাদের পদত্যাগপত্র জমা দেন। সারা দিন টেলিভিশনের সচিত্র প্রতিবেদনে দৃশ্যটি অবলোকন করল দেশের জনগণ। আমাদের সংবিধানে ৫৮(১) নং অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে, "প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন। " সংবিধানের ব্যাখ্যা অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেওয়ামাত্রই মন্ত্রীদের পদ সংবিধান অনুযায়ী শূন্য হয়ে যাবে।
সংবিধানের এই অনুচ্ছেদে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা বা শর্ত প্রয়োগ করা হয়নি। অন্য কোনো পদ্ধতি অনুসরণের প্রয়োজনের কথাও বলা হয়নি। এই অনুচ্ছেদে কোনো 'যদি' বা 'তবে' বা কোনো ফর্মালিটির উল্লেখ করা হয়নি। মন্ত্রীরা পদত্যাগপত্রটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেবেন। আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র পেঁৗছামাত্র তাদের পদ শূন্য হয়ে যাবে।
এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শুধু পোস্টবঙ্ হিসেবে কাজ করবেন। টেলিভিশন ফুটেজে দেখা যায়, পুরো মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় হাসিমুখে ও খুশি মনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার প্রধানমন্ত্রীর পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ পর্যন্ত নিয়েছেন। পুরো ঘটনাটাই ঘটেছে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে। পুরোটাই অফিসিয়াল।
অস্বীকার বা চালাকির কোনো সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বা দলীয় কার্যালয়ে পদত্যাগ করলে এটার হয়তো হাজারো ব্যাখ্যা করা যেত। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ঘোষণা দিয়ে বললেন, এটাই এই ক্যাবিনেটের শেষ মিটিং। মজার বিষয় হলো, গতকালের পদত্যাগটি ছিল পুরো মন্ত্রিপরিষদের অর্থাৎ গোটা ক্যাবিনেটের। এটা কোনোভাবেই কোনো একজন বা একাধিক মন্ত্রীর পদত্যাগ নয়।
তাই এটা আইনের দৃষ্টিতে কোনো মন্ত্রীর ব্যক্তিগত পদত্যাগ নয়, বরং গোটা ক্যাবিনেটের পদত্যাগ। এক্ষেত্রে গোটা ক্যাবিনেট ভেঙে গেলে শুধু প্রধানমন্ত্রী একা স্বপদে বহাল থাকাটাও যে নৈতিকতা ও সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিপন্থী তা বোধহয় আলাদা করে বলার অবকাশ নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংবিধানিকভাবে গতকাল থেকেই মন্ত্রীদের সবার অর্থাৎ পুরো ক্যাবিনেটের পদ শূন্য হয়ে গেছে। এখন কোনো মন্ত্রী আর বেতন-ভাতা, বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার ও অন্যান্য সুবিধাদির কোনোটারই অধিকার রাখেন না। সংবিধানের ৫৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পদত্যাগ করার পর পদত্যাগী কোনো মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব পেতে হলে তাকে আবার সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের আওতায় নতুন করে শপথ নিতে হবে ও শপথে স্বাক্ষর দিতে হবে।
আমাদের সংবিধান খুব পরিষ্কারভাবে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও অন্যান্য মন্ত্রীর পদত্যাগকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে দেখিয়েছে। খেয়াল করার বিষয় হলো- সংবিধানের ৫৭(১)(ক) অনুচ্ছেদ মতে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হয় রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করলে। অপরপক্ষে মন্ত্রীদের পদ শূন্য হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করলে। প্রশ্ন জাগতে পারে- এই দুই ক্ষেত্রে ভিন্নতা কেন? জবাব হলো- সংবিধান মতে রাষ্ট্রপতি সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দেন। আর প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে ও বর্ণিত প্রক্রিয়ায় তিনি যেরূপ স্থির করবেন সেরূপ মন্ত্রীদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
এটা সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারাধীন বিষয়। তাই সংবিধান প্রণেতাগণ প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ এই ক্ষমতা প্রয়োগের রক্ষাকবচের জন্যই মন্ত্রীদের পদ শূন্যের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক বলে রক্ষাকবচ দিয়েছেন। কেননা মন্ত্রীদের পদশূন্যতা যদি রাষ্ট্রপতির মর্জির ওপর শর্তযুক্ত থাকে তাহলে সংসদীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী একজন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আসলে মন্ত্রীদের এই পদত্যাগ নিয়ে সরকার চালাকি করতে গিয়ে আইনের কাছে ফেঁসে গেছে। তাই মন্ত্রিপরিষদের সচিব বিষয়টি পরে বুঝতে পেরে ঘোষণা দিলেন, মন্ত্রিসভা ভাঙা হচ্ছে না বরং পুনর্গঠিত হচ্ছে।
কিন্তু গোটা ক্যাবিনেট পদত্যাগ করে সবার পদ শূন্য হলে তখন পূর্বোক্ত ক্যাবিনেটের পুনর্গঠনের আর কোনো সুযোগই থাকে না। থাকতেও পারে না। ক্যাবিনেট করতে হলে নতুন করে শপথ নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে। কোনো বিষয় সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন হয় না। গঠিত জিনিসই পুনর্গঠন হয়।
সম্পূর্ণ ভঙ্গুর কিছুর পুনর্গঠনের কোনো সুযোগ নেই। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, মন্ত্রীরা পদত্যাগ করলেও তারা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাবেন, অফিস করবেন এবং ফাইলেও যথারীতি স্বাক্ষর করবেন। এটা কেমন হুকুম! যেখানে পদত্যাগ করার পর মন্ত্রীদের প্রত্যেকের পদ সংবিধান মতে শূন্য ঘোষিত হলো সেখানে সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও অবৈধভাবে মন্ত্রীরা যদি অফিস করেন এবং ফাইলে স্বাক্ষর দিতে থাকেন তাহলে সরকার নিজেই সংবিধানের চরম লংঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন। কেননা ১১ নভেম্বরের পর সরকারের পদত্যাগী মন্ত্রীরা সম্পূর্ণ অবৈধ বিধায় তাদের কেউ আর কোনো বেতন-ভাতা, বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার, অফিস করা, ফাইলে স্বাক্ষর করা ও অন্যান্য সুবিধাদির কোনোটাই করার অধিকার রাখেন না। সংবিধানের ৮৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সরকারি অর্থের রক্ষণাবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ সংসদ দ্বারা প্রণীত আইনের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হবে।
এটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। সংসদ কোনো আইন প্রণয়ন করে পদত্যাগী মন্ত্রীদের ভরণ-পোষণের কোনো বিধান অদ্যাবধি তৈরি করেনি। তাই পদত্যাগী মন্ত্রীদের দেওয়া সব বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা অবৈধ। তাদের নীতিনির্ধারণী, ফাইলে স্বাক্ষর ও নোটিংসহ সব কাজকর্ম অবৈধ। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সরকার একদিকে সংবিধানের দোহাই দিয়ে রাতকে দিনে রূপান্তরিত করছে, অন্যদিকে ঠাণ্ডা মাথায় একের পর এক সংবিধান লংঘন করেই চলেছে।
সংসদের মেয়াদ অবসানের পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান রেখে পঞ্চদশ সংশোধনীতে করা ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদ এবং নব সংযোজিত ৭২(১) অনুচ্ছেদ করে নির্বাচনকালীন নব্বই দিনে সংসদের কোনো অধিবেশন না বসাকে নিশ্চিত করেছে। অথচ সরকার প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়েই সংবিধানের এই বিধানকে লংঘন করে সংসদ অধিবেশন চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সরকার শুধু সংবিধানকে ইচ্ছামতো সংশোধন করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং সরকারের নিজের করা সংযোজনকৃত বিধানগুলোকেও নিজ প্রয়োজনে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে অবজ্ঞা প্রদর্শন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এটা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হতে পারে না। সংবিধানের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থাকে এভাবে পরাভূত করলে সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠবে।
রাজনৈতিক কৌশল যাতে সংবিধানকে আহত না করে এটা নিশ্চিত করতে হবে। তাই সংবিধানের সঙ্গে কোনো ধরনের চালাকি বা গণতন্ত্রের প্রতি হুমকিস্বরূপ সংবিধান পরিপন্থী যে কোন আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড মোটেও সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
e-mail: ড. তুহিন মালিক
- See more at: Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।