বলা হয়, সব সফল পুরুষের পেছনেই একজন নারী থাকেন। শচীন টেন্ডুলকারের সফলতার পেছনেও তেমনি একজন আছেন। নামটা অনেকেরই জানা—অঞ্জলি টেন্ডুলকার। তিনি লিটল মাস্টারের স্ত্রী।
১৯৯০ সালে ইংল্যান্ড সফর থেকে ফেরার সময় মুম্বাই এয়ারপোর্টে প্রথম অঞ্জলিকে দেখে টেন্ডুলকার।
মুহূর্তের ভালো লাগা থেকে পরিচয়, এরপর মন দেওয়া-নেওয়া। পাঁচ বছরের প্রেম পরিণয়ে রূপ নেয় ১৯৯৫ সালে। বয়সে ছয় বছরের বড় অঞ্জলিকে বিয়েও করেন। বিয়ের পর অঞ্জলি মেহতা হয়ে যান অঞ্জলি টেন্ডুলকার।
গুজরাটের শিল্পপতি আনন্দ মেহতা ও ব্রিটিশ সমাজকর্মী অ্যানাবেল মেহতার মেয়ে অঞ্জলি ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন চিকিত্সক।
এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীও পেয়েছিলেন। হয়তো চিকিত্সা পেশায়ও ভালো করতেন। কিন্তু বেশি দিন সেটা চালিয়ে যাননি অঞ্জলি। টেন্ডুলকারের জন্য উত্সর্গ করেন নিজের সব স্বপ্ন, ক্যারিয়ার।
টেন্ডুলকারকে সঙ্গ দেওয়া, তাঁর পাশে ছায়া হয়ে থাকা; টেন্ডুলকার যেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারেন, হয়ে উঠতে পারেন বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের একজন।
একই সঙ্গে সন্তান ও পরিবারের দেখাশোনা তো আছেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, শতভাগ সফল অঞ্জলি।
ব্যাটিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব রেকর্ডই নিজের করে নিয়েছেন টেন্ডুলকার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সবচেয়ে বেশি রান ও সেঞ্চুরি তাঁর। গড়েছেন সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি।
দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, ক্রিকেটকেই নিয়ে গেছেন ভিন্ন এক উচ্চতায়। অঞ্জলি-টেন্ডুলকার দম্পতিকে দেখা হয় ভারতের আদর্শ দম্পতিদের অন্যতম হিসেবে।
বিয়ের দুই পছর পরই (১৯৯৭ সালে) টেন্ডুলকার-অঞ্জলির ঘর আলোকিত করে আসে মেয়ে সারা। ১৯৯৯ সালে জন্ম হয় ছেলে অর্জুনের। সন্তানদেরও সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত করেছেন তাঁরা।
টেন্ডুলকার ও অঞ্জলি সব সময়ই বলে এসেছেন, তাঁদের সন্তানদের যেন কখনোই অন্যদের চেয়ে বাড়তি সুবিধা দেওয়া নয়। তাঁরা চান, সারা-অর্জন যেন অন্য শিশুদের মতোই বেড়ে ওঠে।
পারিবারিক বিত্ত-বৈভব, স্বামীর ঈর্ষণীয় সাফল্য কখনোই অঞ্জলিকে আকাশে তুলতে পারেনি। নিজের পা দুটো সব সময় মাটিতেই রেখেছেন। দেশের হয়ে টেন্ডুলকার যখন গোটা বিশ্বে চষে বেড়িয়েছেন, অঞ্জলি নিজের ঘরেই থেকেছেন।
পরিবার সামলেছেন। সন্তানদের দেখাশোনা করেছেন।
স্বামীর সফলতার জন্য প্রার্থনা করেছেন। ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের একজনের স্ত্রী হয়েও সব সময় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার চেষ্টা করতেন। বাইরে খুব একটা যেতেন না, গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেন না।
জীবন যাপন করেছেন সাধারণ একজন মধ্যবিত্ত মানুষের মতো।
গণমাধ্যমে সেভাবে প্রকাশ না পেলেও টেন্ডুলকারের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে অঞ্জলির প্রভাব ছিল স্পষ্ট। পরিবারের ঘনিষ্ঠরাই কেবল সেটা জানেন। লিটল মাস্টারের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক ঝড়-ঝাপ্টা এসেছে। কিন্তু টেন্ডুলকারকে কখনোই ভেঙে পড়তে দেননি অঞ্জলি।
স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের কথাই ধরুন।
সেবার বাংলাদেশের কাছে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকেই ছিটকে পড়ে ভারত। টেন্ডুলকার কিছুতেই সেটা মানতে পারছিলেন না। এতটাই আহত হয়েছিলেন যে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন বলে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল।
কিন্তু অঞ্জলি পরিস্থিতিটা শান্ত করেন। টেন্ডুলকারকে এই বলে বোঝান, ‘এটা নিছকই একটা দুঃসময়। দেখো, সুদিন আসবে। ’
অঞ্জলির আশার বাণী মিথ্যা হয়নি। পরের বিশ্বকাপেই (২০১১) শিরোপা জেতে ভারত।
বর্ণিল ক্যারিয়ারে বিশ্বকাপ না জেতার যে আক্ষেপ ছিল, সেটার অবসান ঘটে টেন্ডুলকারের। ২০০৭ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের দুর্দশা আর ২০১১ সালে ওয়াংখেড়ের বর্ণিল চিত্রটাই বুঝিয়ে দেয়, টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারে কতটা অবদান রেখেছেন স্ত্রী অঞ্জলি।
খুব কম সময়ই টেন্ডুলকারের খেলা মাঠে বসে দেখেছেন অঞ্জলি। স্বামীর খেলায় যেন বিঘ্ন না ঘটে, মনোযোগ যেন শুধু ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাড়িতে নিজের জন্য আলাদা একটা আসন আছে অঞ্জলির।
সেখানে বসেই টেন্ডুলকারের খেলা দেখেন। দুই দশক ধরে এভাবেই লিটল মাস্টারের ছায়াসঙ্গী হয়ে আছেন।
গত সপ্তাহে অবাক করার মতো এক কাজ করেন অঞ্জলি। কাউকে না জানিয়ে হঠাত্ কলকাতা ইডেন গার্ডেনে উপস্থিত হন। টেন্ডুলকারকে ‘সারপ্রাইজ’ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল না।
তাঁর জন্য যেন বিশেষ কোনো আয়োজন না করা হয়, সে জন্যই হঠাত্ উপস্থিত হন অঞ্জলি। সেখানে গিয়েও টেন্ডুলকারকে আগলে রাখার চেষ্টা করেন তিনি। আয়োজকদের এই বলে সতর্ক করেন, টেন্ডুলকারের ১৯৯তম টেস্ট স্মরণীয় করতে গিয়ে যেন বাড়াবাড়ি কিছু করা না হয়। যেন টেন্ডুলকারের খেলায় বিঘ্ন না ঘটে! এভাবেই অঞ্জলি কখনো কখনো ছায়া হয়ে ছিলেন টেন্ডুলকারের পুরো ক্যারিয়ারে। প্রায় সময়ই ছিলেন অভিভাবকের ভূমিকায়ও।
ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিকেও একটা পরামর্শ দেন অঞ্জলি, কলকাতা টেস্টে টেন্ডুলকারকে এক ওভারের জন্য হলেও যেন বল করতে দেওয়া হয়। অঞ্জলির কথার যথার্থ সম্মান দিয়েছেন ধোনি, প্রতিদানও পেয়েছেন। প্রথম ইনিংসে দুই ওভার বল করে একটি উইকেট তুলে নেন টেন্ডুলকার।
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ২০০তম টেস্টে মাঠে নেমেছেন টেন্ডুলকার। এর মধ্য দিয়ে ইতি ঘটবে তাঁর দুই যুগের স্বপ্নিল ক্যারিয়ারের।
টেন্ডুলকারের বিদায়ী টেস্টেই এখন যত দৃষ্টি ক্রিকেটবিশ্বের। লিটল মাস্টারের জন্মস্থান মুম্বাই যেন উত্সবের এক নগর। যে উত্সব একই সঙ্গে আনন্দের আর বিষাদের। এই প্রথম মাঠে বসে টেন্ডুলকারের খেলা দেখছেন তাঁর পুরো পরিবার।
লিটল মাস্টারকে সবচেয়ে বড় উপহারটা দিয়েছেন তাঁর মা রজনী টেন্ডুলকার।
এই প্রথম মাঠে বসে ছেলের খেলা দেখছেন তিনি! এত দিন মাঠে যাননি এই কুসংস্কার ধারণ করে যে ছেলের খেলা খারাপ হবে। কিন্তু ছেলের বিদায়ী টেস্ট নিয়ে যখন গোটা বিশ্ব উদ্বেলিত, তখন ঘরে বসে থাকতে পারেননি মা রজনী। নিজে হুইলচেয়ারে বসে পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে টেন্ডুলকারের খেলা দেখছেন। বিদায়বেলায় এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে! সন্দেহ নেই, ওয়াংখেড়েতে অঞ্জলির দায়িত্বও বেড়ে গেছে অনেকখানি!
ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, গলফসহ যেকোনো খেলার আপডেট ও খবর পেতে আপনার মোবাইল থেকে S লিখে এসএমএস করুন ২২২১ নম্বরে।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।