চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস ‘অ্যা টেল অব টু সিটিজ’-এ মাদাম ডিফার্জ নামের এক রক্তপিপাসু চরিত্রের মূল কাজ ছিল মদের দোকানে বসে প্রতিদ্বন্দ্বীদের তালিকা তৈরি করা। পরে সেই তালিকাভুক্ত অনেকেই মারা যেত গিলোটিনে। ভারতের এক ব্যবসায়ীর মতে, বর্তমানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে ডিফার্জের মতো কোনো ব্যবসায়ীবিরোধী চরিত্র রয়েছে। গত তিন বছর ধরে কয়লার খনি, মোবাইলের টুজি প্রযুক্তি ও স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির কারণে ভারতীয় ব্যবসায়ীসমাজ নিবিড়ভাবে গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে আছে।
ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বর্তমানে ‘থ্রিসি’ আতঙ্ককে ভুগছে।
সিবিআই (সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন), সিএজি (কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অব ইন্ডিয়া) ও সিভিসি (সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন) গত তিন বছরে অনেক কোটিপতিকে আইনের আওতায় এনেছে। তাঁদের সম্মিলিত সম্পদের মূল্য ৩০ হাজার কোটি ডলার এবং ভারতীয় জিডিপিতে যাঁদের অবদান ১৬ শতাংশেরও বেশি। ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এসেছে সুপ্রিম কোর্টের নতুন নির্দেশ।
কার্যত রাদিয়া টেপ কেলেঙ্কারির সূত্র ধরে প্রশান্ত ভূষণ নামের একজন আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করার পর আদালত তদন্তের নির্দেশ দেন। বৈষ্ণবী কমিউনিকেশনস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নীরা রাদিয়া সঙ্গে সাংবাদিক, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের ফোনালাপ রেকর্ড করেছিল ভারতের আয়কর বিভাগ।
রাদিয়ার এসব ফোনালাপ ২০০৮-০৯ সালে রেকর্ড করা হয়। ফোনালাপ থেকে ভারতের তত্কালীন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী আন্দিমুথু রাজাসহ অনেকের দুর্নীতি ধরা পড়ে। জানা যায়, টাটা ও রিলায়েন্সের মতো শিল্পগোষ্ঠীগুলো মধ্যস্থতাকারী রাদিয়ার বড় মক্কেল।
১৭ অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্ট গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরও আটটি ঘটনা নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো তামিলনাড়ু সরকারের জন্য টাটার বাস সরবরাহ প্রকল্প, ঝাড়খণ্ডের টাটা স্টিল প্রকল্প, আম্বানি শিল্পগোষ্ঠীর শাসান আলট্রা মেগা পাওয়ার প্রজেক্ট, ইউনিটেকের শেয়ারবাজারে প্রভাব খাটানো এবং রিলায়েন্সের টেলিযোগাযোগ কেলেঙ্কারি।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই ২২ অক্টোবরে জানায়, তারা বাইজাল, রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস, রাদিয়া ও ইউনিটেকের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে। এর পরের দিনই সিবিআই টাটা মোটরস ও রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এই অবস্থায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি হবে না বলে ব্যবসায়ীরা ধারণা করছে। ভারতীয় চেম্বার অব কমার্সের জরিপে দেখা যায়, গত ১৮ মাসে ভারত সম্ভাব্য এক লাখ কোটি রুপির বিনিয়োগ হারিয়েছে। ব্যবসায়ীরা বর্তমানে দেশে বিনিয়োগ করতে স্বস্তি বোধ করছেন না বলেও এই জরিপে প্রকাশ পায়।
যার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত নেমে এসেছে।
২০১১-১২ সালের যেখানে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৫১২ কোটি ডলার সেখানে ২০১২-১৩ সালে তা নেমে আসে ২২৪২ কোটি ডলারে। এই জরিপে আরও দেখা যায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা অন্য দেশে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। ২০১৩ সালের প্রথম অর্ধে ভারতীয়রা বিদেশে ৩২৪ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন। যা গত বছরের চেয়ে ১৭১ কোটি ডলার বেশি।
এই সম্পর্কে ‘ইন্ডিয়া টুডে’কে গোদরেজ শিল্পগোষ্ঠীর মালিক আদিল গোদরেজ বলেন, কোনো কারণ ছাড়া সম্মানিত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এই ধরনের নজরদারি ব্যবসায় পরিবেশকে কঠিন করে তুলবে। ভারতীয় চেম্বারের প্রধান গোপাল কৃষ্ণাণ বলেন, এই পরিবেশে নিজ দেশের ও বিদেশি ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করা যাবে না। একজন শিল্পপতি ‘ইন্ডিয়া টুডে’কে বলেন, ‘আমরা ভয়ের কারণে নতুন কোনো প্রকল্প শুরু করছি না। ’
সাময়িকীটি মন্তব্য করেছে, ব্যবসায়ীদের মাথার ওপরে এভাবে তলোয়ার ঝুললে তাঁদের জন্য ব্যবসা করা কঠিন হয়ে যায়। আরও বলা হয়েছে, ‘ভারত ক্রমশ পিছাচ্ছে, এমন সমাজতান্ত্রিক অবস্থার দিকে এগোচ্ছে যেখানে ব্যবসায় লাভ করাই পাপ।
’
এই পরিস্থিতিতে করপোরেট বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শচীন পাইলট বলেন, ‘আইন সবার জন্য সমান। ... দোষীদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতেই হবে। ’ সুপ্রিম কোর্টে মামলার আবেদনকারী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, ‘করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো গত ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় সম্পদকে একচেটিয়া ভোগ করেছে। তাদের এসব সম্পদ ও সম্পত্তি দেওয়া হয়েছিল বিনা শর্তে। এখন সুশীল সমাজ ও সুপ্রিম কোর্ট দাবি জানাচ্ছে এসব লুটপাট বন্ধ এবং এর জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা হোক।
’
প্রশান্ত আরও বলেন, রাদিয়া টেপ থেকে জানা যাচ্ছে যে বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে আমলাদের নিয়োগ, সংসদের বিতর্কের বিষয় ও গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রশান্তের অভিযোগ খণ্ডনের দাবি কেউ করেনি। বরং দেশটির সরকার, বিচারব্যবস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দুর্নীতিবিরোধী তত্পরতা জারি রাখতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। অনেকেই মনে করেন, সরকারের বেশি নিয়ন্ত্রণ বাণিজ্যের জন্য অশুভ। কিন্তু একটি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা যদি অস্বচ্ছ উপায়ে ব্যবসা করে মাদাম ডিফার্জের আতঙ্কে দিন কাটান, তবে তা খুব অন্যায় হবে না।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।