চোখ কুঁচকে আকাশের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো অয়ন। এইতো একটু আগেও কি সুন্দর ঝকঝকে রোদ ছিল। দেখতে দেখতেই সেই ঝকঝকে রোদ কোথায় নিখোঁজ হয়ে চারপাশ ভীষণ কালো হয়ে ওঠেছে। অথচ প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি আসছে জেনেও অয়ন জায়গা ছেড়ে নড়তে পারছে না।
ভার্সিটির ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সকাল দশটা থেকে এই গাছ তলায় দাঁড়িয়ে আছে ও।
এখন আড়াইটা বাজে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আর কাছাকাছি এলাকাতেই একটু হাঁটাহাঁটি করে সময় পার করেছে। অথচ সামারাকে ফোন ও দিতে পারছে না। সামারা এখন ঘুমাচ্ছে। স্কুল বন্ধ বলে এখন তার সময়ের কোনও ঠিকঠিকানা নেই।
অনেক রাত অব্দি জেগে থেকে ভোরের দিকে ঘুমাতে যায়। এর মাঝে ফোন দিলে ওর ঘুমের ব্যাঘাত হয় বলেই ও মানা করেছে ফোন দিতে। ও ঘুম থেকে জেগে সবার আগে ওকে ফোন করে কথা বলে নেয়। এই সব কিছু জানা থাকার পরেও ফোন করলে ওই মেয়ে ভয়ানক রকম ক্ষেপে যাবে। খামাকাই মেজাজ দেখাবে।
তুচ্ছ তুছ সব ব্যাপার নিয়ে ধমকাবে। অথচ এদিকে আকাশের এই অবস্থা। কিন্তু সে চলে যেতেও পারছে না। আজকে যে করেই হোক সামারার সাথে তাকে দেখা করতেই হবে। অবশ্য তাদের দেখা করা মানে সামারা এসে বারান্দায় দাঁড়াবে আর অয়ন তার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে তাদের বাড়ির সামনের পথ ধরে হেঁটে যাবে আবার ফিরে আসবে।
এরই মাঝে টুক করে একটু উপর দিকে তাকিয়ে যেটুকু দেখা যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল অয়ন। কবে যে সামারা কলেজে উঠবে! অবশ্য কলেজে উঠার পরেও মনে হয় না ওর মা ওকে একা ছাড়বে। সামারা ভার্সিটিতে ওঠা পর্যন্ত তাকে এমন ধৈর্য ধরতে হবে। কিন্তু যাই কিছু হোক না কেন আজ দেখা করতেই হবে।
আজকের মতো বিশেষ দিনে কি আর দেখা না করে চলে যাওয়া যায়? আজকে তাদের প্রেমের দ্বিতীয় বছর পূর্তি হল। দুই বছর আগের ঠিক এই দিনে তারা একে অন্যের কাছে তাদের ভালোবাসা স্বীকার করেছিলো।
বার বার ফোনটাকে পকেট থেকে বের করে হাতে নিয়ে অয়ন দেখছিল কোনও মেসেজ কিংবা কল এলো কিনা। কেমন জানি ধোঁকা ধোঁকা লাগে। পকেটে ফোনটাকে রাখতে না রাখতেই মনে হয় এই বুঝি মেসেজ বা কল এলো কিন্তু ভিড়ের কারণে হয়তো সে শুনতে পাচ্ছে না।
আবার ও পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখল অয়ন। পৌনে তিনটা বাজে। এখনও সামারার কোনও খোঁজ নেই। মনে হচ্ছে আজ দুপুরটাও না খেয়েই পথে পথে ঘুরে পার করে দিতে হবে। সকালেও ঠিক মতো খাওয়া হয়নি।
আজ দেখা হবে এই খুশিতে গলা দিয়ে খাবার যেন নামতেই চাইছিল না। ফোনটা পকেটে রেখে দুহাতে মাথার চুলগুলি খাবলে ঠিক করার চেষ্টায় মন দিলো অয়ন। এরই মাঝে ফোন বেজে উঠলঃ
-হ্যালো
-ঘুম ভেঙ্গেছে?
-হ্যাঁ। কি খবর?
-খবর আর কি? সকাল দশটা থেকে তোমার বাসার কাছাকাছি ঘুর ঘুর করছি।
-কয়টা থেকে?
-দশটা থেকে।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আরেকটু দাঁড়াও। আমি তৈরি হয়ে বারান্দায় যাচ্ছি।
-আচ্ছা।
ফোন রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে অবাক হল সামারা।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে মাকে খুঁজে পেলো না ও। সব ঘর খুঁজে মাকে কোথাও পেলো না। হলরুমে ছোট ভাই ছাতা নিয়ে খেলছে। ওকে জিজ্ঞেস করতেই জানালো মা ছাদে গেছে।
অনেক খুঁজে পেতে সামারা তার গোলাপি রঙের ছাতাখানি বের করে ভাইকে সাথে নিয়ে ছাদে উঠে গেলো।
ছাদে গিয়ে চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে অয়নকে আবার ও ফোন দিলো সামারা।
-হ্যালো। আমি ছাদে এসেছি। তুমি কোথায়?
-এইতো।
তোমাদের বাড়ির কাছাকাছিই আছি।
-সামনে এগোতে থাকো। আমি ছাদে আছি।
-তুমি কি বৃষ্টিতে ভিজছ?
-আরে না না। আমি ভিজছি না।
ছাতা নিয়ে এসেছি।
-আচ্ছা দাঁড়াও। আমি আসছি।
ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সামারা দেখল অয়ন ভিজতে ভিজতে এগিয়ে আসছে। আহা বেচারা! একটুখানি দেখা করবে বলে সেই কখন থেকে পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে।
এখন বৃষ্টিতে ভিজছে। চোখে পানি চলে এলো ওর। বাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখে নিলো মা আর ছোট ভাইটার দিকে। কেউ দেখছে না তো আবার! অবশ্য বৃষ্টি থাকাতে ভালোই হয়েছে। চোখের কোণায় জমা পানি কেউ টের পাবে না।
কথা বলতে বলতে সামারাদের বাড়ির ঠিক সামনের বড়ো আম গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ালো অয়ন। ধুর! এত্ত বড়ো একটা গাছ, তবুও এর নিচে দাঁড়িয়েও বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ফোনে কথা বলে আস্তে আস্তে আবার ফিরতি পথ ধরে এগোতে লাগলো ও। ব্যাগের ভেতর বই খাতাগুলি হয়তো ভিজে নষ্ট হয়েই যাচ্ছে। যাক।
সামারার সাথে দেখা তো হল! মন থেকে খারাপ লাগা ভাবটা ঝেড়ে দূর করতে চাইছে ও। কিন্তু মন খারাপ লাগা ভাবটা ঘুরেফিরেই ফিরত আসছে। এমন ঝুম বৃষ্টি না থাকলে হয়তো আরও কয়েক মিনিট দাঁড়াত ও। কিছুদুর এগিয়ে যাবার পর বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য এক বাড়ির সামনের গাড়িবারান্দায় দাঁড়ালো ও।
অয়ন চলে যেতেই সামারা চিলেকোঠায় ফিরে গেলো।
তার প্রচণ্ড কান্ন পাচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু অনেক অনেক প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে বলে কাঁদতে পারছে না। তাছাড়া ছোট ভাইটা যা দুষ্টু! একবার টের পেলেই হল। সারাক্ষণই ক্ষেপাবে।
কাউকেই কিছু বুঝতে দেয়া যাবেনা। একটু ভেবে সে উপায় বের করলো। বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকবে সে। তাহলে চোখের পানিও কেউ দেখবে না আর অয়নের মতো করে তার ও বৃষ্টিতে ভেজা হবে।
সামারা ছাতা বন্ধ করে রেখে দিয়ে আবার ও ছাদে ফিরে এলো।
মা ওর দিকে তাকাতেই বলল যে দমকা বাতাসে ছাতা উল্টে যাবে মনে হওয়ায় সে ছাতা বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। কোনোমতে কথা কয়টা বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ছাদের আরেক দিকে যাবার জন্য হাঁটতে লাগলো। অয়ন যেটুকু ভিজেছে তার চেয়েও অনেকখানি বেশি ভিজবে সে। বৃষ্টিতে ভিজবে আর কাঁদবে। কেউ কিচ্ছু বুঝবে না।
সে কাউকেই কিছু বুঝতে দিবে না। এই কান্নার কথা শুধু সে আর বৃষ্টিই জানবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।