আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সর্বদলীয় সরকার এবং মেনন তোফায়েল

১৮ নভেম্বর নতুন আটজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে আবার নতুন বিতর্কের ঝড় উঠেছে। ২১ অক্টোবরে দেওয়া বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবের বিপরীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারের কথা ঘোষণা করেছিলেন। বিতর্কটা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। কারণ বিরোধীদলীয় নেতা যে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করেছিলেন, এই প্রস্তাব তাকে বাতিল করেছিল। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত সরকারে যোগ দেবে।

প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তার বক্তব্যে সর্বদলীয় সরকারের কাঠামো বা রূপরেখা ব্যাখ্যা করেননি। কিন্তু তারপরেও সর্বদলীয় হয় কী করে? সবাই ধরে নিয়েছিল এই সরকার হবে নির্বাচিতদের দ্বারা গঠিত। কারণ পঞ্চদশ সংশোধনীর পর থেকে অনির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সিভিল সোসাইটির যে কোনো প্রস্তাব তিনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন এই বলে যে, ওরা নির্বাচিত নয়, তাদের কথা আমরা শুনতে যাব কেন? অতএব সংসদে যাদের প্রতিনিধিত্ব নেই সেসব দল সর্বদলীয় সরকারের আসবে না এটা ধরেই নেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু যাদের প্রতিনিধিত্ব আছে তারা কি সবাই থাকবেন? জামায়াতে ইসলামীর কথা আসতে পারত কিন্তু তারা তো যুদ্ধাপরাধী সংগঠন।

তাদের বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু তারপরেও সংসদে আর দুটি সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব আছে, যারা বিরোধী জোটের অন্তর্ভুক্ত। তারাও তো থাকল না এই সরকারে। কেউ কেউ এ রকম করে বলছেন, বর্তমানে যে সরকার ঘোষণা করা হয়েছে তাতে চারটি দলের প্রতিনিধিত্ব আছে আর চারটি দলের নেই। অতএব, যে কোনো বিবেচনায় এটাকে আর যাই বলা যাক সর্বদলীয় সরকার বলা যায় না।

অথচ মন্ত্রীরা যে পদত্যাগপত্র পেশ করেছিলেন তাতে এ কথা পরিষ্কার উল্লেখ ছিল, একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করার অভিপ্রায়েই তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করেছিলেন।

মন্ত্রীদের পদত্যাগ নিয়ে যা নাটক করা হয়েছে তার বিশেষ উল্লেখ আমি এখানে করতে চাই না। সর্বদিকের বিবেচনায় এই পদত্যাগপত্র পেশের মাধ্যমে মন্ত্রীদের পদ শূন্য হয়েছিল। কিন্তু আমরা প্রধানমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী জানলাম যে, তাদের চাকরি যায়নি তারা বহাল আছেন। দিবি্ব খাচ্ছেন, দাচ্ছেন, গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে চলছেন এবং অফিস করছেন।

তারা কি সবাই মন্ত্রী আছেন? সংবিধান অনুযায়ী নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী আছেন। সবাই কি আছেন? নিশ্চয়ই নয়। না হলে প্রধানমন্ত্রী তাদের পদত্যাগ পত্র চাইলেন কেন? কিন্তু কারা যে আছেন আরা কারা বাদ পড়েছেন সেটা কেউ জানে না, জানেন কেবল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিপরিষদ সচিব অবশ্য বলেছেন, আরও চমক আছে।

সেই যে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা গঠনের প্রাক্কালে 'সারপ্রাইজ' বলে একটি শব্দ বলেছিলেন অনেকটা সেই রকম।

কিন্তু এবারের ঘটনার সবচেয়ে বড় চমক সম্ভবত জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গত কয়েক দিনে তিনি যে কি বললেন আর কি করলেন তা ভেবে পাগল হয়ে গেছে এদেশের মানুষ। সেই যে কথায় বলে, 'একই অঙ্গে এত রূপ' একটু ঘুরিয়ে বলা যায় একই মুখে এত কথা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমি বেহেশতেও জেতে রাজি না, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে লোক আমাকে থুথু দেবে, বেইমান বলবে, আমি শেষ বয়সে বেইমান হতে চাই না।

এত কিছু বলে কেমন নির্দ্বিধায় একলাফে নির্বাচনের নৌকায় উঠে গেলেন। বাংলার অন্যতম উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার এক প্রশ্নের জবাবে আমাকে বলেছিলেন, 'আমি রাজনীতি করি না। কারণ রাজনীতিবিদরা সত্যি কথা বলেন না। ' রীতিমতো শ্রদ্ধার্হ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ওপর আমার রাগ হয়েছিল। এখন আমার নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে।

রাজনীতিতে কূটকৌশল আছে, কিন্তু কপটাচার থাকা উচিত নয়। কিন্তু আমাকে বলতে হচ্ছে সার্বিক ঘটনাই কপটাচার।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেই সকালেই সংবাদ সম্মেলন করে মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। মহাজোট তিনি ছাড়ছেন কেন কারণ এই সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী। এ অভিযোগে যদি মহাজোট ছাড়লেন তবে আবার সেই সরকারে যোগ দেওয়া কেন? পাঠকবৃন্দ যারা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের এ সংবাদ সম্মেলন টিভিতে দেখেছেন বা পত্রিকায় এ খবর পড়েছেন তারা খেয়াল করেছেন, এরশাদ মনে করছেন এই সরকার নির্বাচনে কারচুপি করতে পারে।

সে ক্ষেত্রে তিনি নির্বাচন বয়কটও করতে পারেন। তারপরেও তিনি এ সরকারে যোগ দিচ্ছেন ব্যাপার খেয়াল রাখার জন্য। হ্যাঁ হতোস্মি। বিক্ষুব্ধ হতাশায় জাতি হাসবে না কাঁদবে? নাকি করুণা করবে এ অসহায় ভীরু লোভী লোকটিকে।

এ কথা সবাই জানে সংবিধান অনুযায়ী কোনো মন্ত্রীকে নিযুক্ত কিংবা বিযুক্ত করার ক্ষমতা দেশের প্রধানমন্ত্রীর।

সেই ড. আকবর আলি খান বলেছেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা রাশিয়ার জার কিংবা মোঘল সম্রাটদের মতো। কথিত এই সর্বদলীয় সরকার গঠন করার পর সেই ক্ষমতা এতটুকু কমবে না। এরশাদ সাহেবের দল একটির জায়গায় ৭টি মন্ত্রী পেয়েছে। তাতে যে তাদের ক্ষমতা বেড়েছে বা সংহত হয়েছে তা বলা যাবে না। কারণ প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলেই এ সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে পারবেন।

সরকার অবশ্য মাঝে মাঝে একে নির্বাচনকালীন সরকার বলেও উল্লেখ করছে। মনে হচ্ছে যখন যা বললে বা করলে সুবিধা হয় তখন তা-ই বলছে তারা। তা-ই করছে কিংবা করার চেষ্টা করছে। এই যে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে এভাবে ব্যবহার করাটা কি কোনো নীতিনৈতিকতার মধ্যে পড়ে? আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহাসিক দল এতটা দেউলিয়া হয়ে গেল যে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে কাদায় নামতে হলো? এই যে বলা হচ্ছে, সে অনুযায়ী এটা কি কোনো নির্বাচনকালীন সরকার? যখনই আপনি নির্বাচনকালীন সরকার বলবেন তখনই তা সাধারণ সময়ের সরকারের চেয়ে আলাদা হবে। সে রকম কোনো ব্যাপার আছে? আমাদের সংবিধানে সর্বদলীয় কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার বলে কোনো বিষয় নেই।

কিন্তু বিশ্বের দেশে দেশে আছে। সেখানে নির্বাচনকালীন সরকার মানে এক প্রকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যেহেতু সময়টা নির্বাচনের সেহেতু নির্বাচন কমিশন থাকে ড্রাইভিং সিটে। নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার সব ধরনের সহায়তা দিতে বাধ্য থাকে। এ জন্য বিধিবিধান, প্রবিধান থাকে।

আগেই বলেছি, আমাদের সংবিধানে এরকম কিছু নেই। আর এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনী আচরণবিধি বা অনুরূপ কিছু করা হয়নি। যার কাছে এই সরকার অনুগত থাকতে বাধ্য। তার মানে এটা সর্ব অর্থেই একটি প্রচলিত সরকার। এটা গঠন করার মধ্যে কিংবা এতে যোগ দেওয়ার মধ্যে কোনো নিয়মনীতির বালাই নেই।

একটি ঘটনা আমার বিবেচনায় এ সরকারকে বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। বিবেচনার বিষয় দুজন মানুষ। একজন হচ্ছেন রাশেদ খান মেনন, আরেকজন তোফায়েল আহমেদ। কৈশোর পেরিয়ে যখন যৌবনে পা রাখছি তখন রাশেদ খান মেননকে চিনেছি। আর যখন যৌবনে উন্মাতাল অভ্যুত্থান তখন তোফায়েল আহমেদ।

তাদের অতীত নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। কম-বেশি সবাই সেগুলো জানে। সেই সময়ের তারুণ্যের কম্পাস রাশেদ খান মেনন যখন নৌকায় উঠেছিলেন তখন অনেকেই কষ্ট পেয়েছিলেন।

আমার অনুভূতির কথা আমি বলব না। কিন্তু আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম যখন বছর দেড়েক আগে এই সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ তারা দুজন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক সাংগঠনিক বিশ্লেষণে যাইনি। গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছিল এই ভেবে যে, আমাদের দেশে এমন রাজনীতিবিদ আছেন যারা মন্ত্রিত্বের পদ অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। আর আমার বিশেষ আনন্দ সে দুজন এমন মানুষ যারা আমার ছাত্র রাজনীতির জীবনের আইকন ছিলেন।

আজ আমি ভেবে পাচ্ছি না সেই দুজন মানুষই এখন কেন এই বিতর্কিত মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন। আমার মনে আছে তখন তারা বলেছিলেন, এই পড়ন্ত বেলায় আর মন্ত্রী হয়ে কি করতে পারব।

প্রশ্ন জাগে, এখন কি বেলা আবার নতুন করে উঠল? এই সরকারের আয়ু তো বেশি হলে আড়াই মাস। এখন কেন গেলেন তারা? কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, শেখ হাসিনার কারিশমা দেখুন। এই দুজনকেও খোঁয়াড়ে ঢুকালেন। তাই কি? পানি তারা খেলেন। কিন্তু ঘোলা করে? আবারও জানতে ইচ্ছা করছে, তাই কি? তারা কি এতই পিপাসু ছিলেন? কিসের পিপাসা?

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।

ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.