একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। আজ বুধবার তারা আসামিপক্ষের উপস্থাপিত যুক্তি খণ্ডন করে।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ রায় অপেক্ষমাণ থাকা অবস্থায় আজ রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি খণ্ডনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এ মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। এক সপ্তাহ আগে (১৩ নভেম্বর) প্রথমবারের মতো মামলার কার্যক্রম শেষ ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, যেকোনো দিন রায় ঘোষণা হবে। তবে পরে আবার আসামিপক্ষকে তিন দিন যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ দেন ট্রাইব্যুনাল।
গতকাল মঙ্গলবার আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়।
আজ যুক্তি খণ্ডনের সময় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তুরিন আফরোজ বলেন, ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন প্রণয়নের বহু আগে থেকেই উসকানি বা প্ররোচনা দেওয়া স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। ১৮০১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে বেশ কয়েকটি মামলায় উসকানিকে স্বতন্ত্র অপরাধ ধরে বিচার হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যুরেমবার্গের ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানির অভিযোগে দুজনের বিচার হয়। তাঁরা হলেন নািস নেতা ও ইহুদিবিদ্বেষী পত্রিকা ‘দের স্টুরমার’-এর প্রকাশক জুলিয়াস স্ট্রাইখার, অন্যজন নািস বেতার বিভাগের প্রধান হানস ফ্রিটশে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানির দায়ে স্ট্রাইখারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, ফ্রিটশে দোষী সাব্যস্ত না হওয়ায় খালাস পান। কিন্তু পরে জার্মানির একটি নািসবাদবিরোধী (ডি-নাজিফিকেশন) আদালত ফ্রিটশের বিচার করে ও শাস্তি দেয়। ওই আদালত ফ্রিটশেকে ‘নািস আদর্শ প্রচারক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি যুক্তি দেন, নিজামীর বিরুদ্ধে আনা ১১ থেকে ১৪তম অভিযোগে উসকানির অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগে একাত্তরে আসামির দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্যে ‘অবিভক্ত পাকিস্তানের’ প্রতি ভালোবাসা, ভারতের প্রতি ঘৃণা প্রভৃতি প্রকাশ পেয়েছে।
এখানে ইসলামী ছাত্রসংঘের (জামায়াতের তত্কালীন ছাত্রসংগঠন) সদস্যদের উদ্দেশে নিজামী কী উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং ওই বক্তব্য ছাত্রসংঘের সদস্যদের মনে কী প্রভাব ফেলছে, তা দেখতে হবে। নিজামী বক্তব্য দেওয়ার ফলে কোন মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে তা প্রমাণের দরকার নেই, কিন্তু তিনি ছাত্রসংঘ-আলবদর সদস্যদের মনে মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালিদের বিরুদ্ধে বিষবাষ্প ঢুকিয়েছেন। জনসম্মুখে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে বলা উসকানির সমতুল্য। আর এ জন্য নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রাপ্য।
তুরিন আফরোজ ছাড়াও আজ যুক্তি খণ্ডন করেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী ও মোহাম্মদ আলী।
তবে যুক্তি খণ্ডনের জন্য মোহাম্মদ আলীর প্রস্তুত না থাকা এবং সময়ক্ষেপণ ট্রাইব্যুনালের বিরক্তি উদ্রেক করে। যুক্তি খণ্ডনের একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল একটি প্রশ্ন করলে তার জবাব দিতে মোহাম্মদ আলী প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে একটি বই খুঁজে বেড়ান। এ সময় ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষের আরেক কৌঁসুলি আবুল কালামের উদ্দেশে বলেন, ‘শুধু নির্বাচন করলে হবে না, আরও পরিশ্রম করতে হবে। ’ আবুল কালাম বলেন, ‘আমি নির্বাচন করব না। ’
রাষ্ট্রপক্ষের কয়েকজন কৌঁসুলি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি খণ্ডন শেষ হলে আসামিপক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম আবারও পাল্টা যুক্তি দেওয়ার আরজি জানান। ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি খণ্ডনের পর মৌখিকভাবে আর যুক্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। আসামিপক্ষ চাইলে লিখিতভাবে তাদের যুক্তি দিতে পারবে।
এর মধ্য দিয়ে প্রায় দেড় বছর ধরে চলা এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়। এখন যেকোনো দিন রায় ঘোষণা করবেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ২৮ মে এই ট্রাইব্যুনাল নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ গঠন করেন। এরপর ১৭ মাস ধরে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষে ৩০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। ওই একই দিনে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছিল। পরে কাদের মোল্লার মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়। ট্রাইব্যুনাল-২-এর রায়ের পর কাদের মোল্লার মামলাটির আপিল নিষ্পত্তিও হয়ে গেছে, এখন শুধু পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়া বাকি।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।