আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

২২শে আগস্ট



২২ শে আগস্ট ২০০৭ আমার জীবন পরিবর্তনের এক স্মরণীয় দিন। এর আগেরদিন পর্যন্ত আমার জীবন ছিল মেডিকেল চান্স না পাওয়ার বিশাল এক হতাশার পাহাড়। ঐ সময়টাকে আমার জীবনের কাল অধ্যায়ও বলা চলে। কোনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে আপণ মনে হচ্ছিল না। চকবাজার যাওয়ার পথে মেডিকেল গেইট পার হতে বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করতাম।

২২ শে আগস্ট সকালে একা একা ভাল লাগছিল না তাই আমানত হলে বন্ধু সুজনের রুমে গিয়ে আড্ডা দিতে গেলাম। দুপুরের পর হঠাৎ এক বড়ভাই বলল হল লিভ দেয়ার সম্ভাবনা আছে রুমে চলে যা তাড়াতাড়ি। হল লিভ আবার কি? বড় ভাই বুঝিয়ে বললেন। মনে মনে খুবই খুশি হলাম আর বললাম আমি ত এইটাই চাই। কিছুক্ষন পর দেখি হলের মসজিদ থেকে ঘোষণা দিচ্ছে রাত ৮টার মধ্যে হল ত্যাগ করতে হবে।

তাড়াতাড়ি হলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথিমধ্যে বন্ধু সোহেলের সাথে দেখা। সমাজ বিজ্ঞান অডিটরিয়ামে মুভি দেখে আসছিল সে। বললাম হল লিভ দিছে শুনেছিস? বলল ঐটা শুনেই ত আধা ছিনেমা থেকে উঠে চলে আসলাম। বললাম কি করবি এখন? ও বলল আগে ভার্সিটি থেকে বের হই তারপর দেখি বাসায় যেতে পারি কিনা? আমি বললাম আমি হল থেকে ব্যাগ গুছিয়ে আসছি।

আমার জন্য অপেক্ষা করিস। ও বলল ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের যোগাযোগের কোন সম্ভাবনা ছিল না। কারণ তার মোবাইল নাম্বারটাই আমার কাছে ছিল না। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে কাঁটা পাহাড় হয়ে আসার সময় টাসকি খেয়ে গেলাম।

ঐদিন মনে হয় হলের সুন্দর মেয়েগুলোর ২/৩ অংশ দেখলাম। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই কারো দিকে ভাল করে তাকানোর সুযোগও নেই। কারণ শুনলাম ট্রেন নেই, বাসে যেতে হবে। আমি গোল চত্বরে পৌছাতে দেখি সোহেল ব্যাগ হাতেই দাড়িয়ে আছে। সোহেলের সাথে দৈব সাক্ষাতে বুঝলাম টেলিপ্যাথি নামে আসলেই কিছু একটা আছে।

অনেক লম্বা কাহিনির পর ট্রেন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল প্রশাসন আর আমরা ট্রেনে উঠে পড়লাম। আব্বাকে ফোন দিতে গিয়ে দেখি মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়েছে, মোবাইলের চার্জও প্রায় শেষ। শহরে পৌছতে পৌছতে সাড়ে ৮টা বেজে গেল আর আমরা বহদ্দার হাট বাস টার্মিনালের দিকে রওনা হলাম। ততক্ষনে শহরে কারফিউ শুরু হয়ে গেছে। রাস্তায় একরকম ভুতুড়ে অবস্থা একমুহুর্তের জন্য একাত্তরের প্রেক্ষাপট অনুভব করেছিলাম।

রাস্তায় আমরা আর আমাদের রিক্সা ছাড়া আর কিছু দেখলাম না। অনেক দূর থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ভেসে আসছে। রিক্সাওয়ালা বলল মামা আর্মি রাস্তায় কাউকে দেখলে গুলি করছে, যামু না। অনেক বুঝিয়ে রাজি করলাম। একটু দূরে আগানোর পর দেখলাম রাস্তার ঐপাশের আর্মির একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে আর এক রিক্সাওয়ালাকে কিছু আর্মি বেধড়ক পেটাচ্ছে।

এই দেখে আমাদের রিক্সাওয়ালা ত ভিতরে নাই। পরে সোহেল কে বললাম দেখ আর্মি যদি জানে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাইলে ত কথাই নেই গুলি করতেও পারে তার উপর তুই ত সাংঘাতিক ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। আজকে রাত পার করে কাল বাড়ির দিকে রওনা হব। কিন্তু আজকে রাতে থাকব কই? তখন সোহেল নিয়ে গেল ওর বন্ধু আরিফের বাড়িতে। আরিফের সাথে আমার পরিচয় নেই।

কিন্তু ঐ রাতের পর থেকে আমরা একে অপরের খুবই ভাল বন্ধু। আরিফ ছিল আমার বন্ধুদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে অমায়িক এবং পরোপকারী। পরেরদিনও সকালে যেতে পারলাম না। বিকেলের দিকে কারফিউ শিথীল করা হল, বাস টার্মিনালে গিয়ে টিকেট কেটে বাসে উঠে পড়লাম। সারা পথ দুজনে সেই লোমহর্ষক রাতের কথা চিন্তা করছিলাম।

অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পর বাড়িতে পৌছে নিজেকে যুদ্ধফেরত গাজী মনে হল। সবার চোখে মুখে স্বস্তি। বিকেলে বন্ধুরা মিলে বীচে আড্ডা দিচ্ছিলাম। দেখলাম ওইরাতের ব্যাপারে সবার ভাষ্য আমি আর সোহেলের মতই। ২২ শে আগস্টের ঘটনায় লম্বা বন্ধের পর ভার্সিটিতে ফিরে আমার জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছুই আপণ মনে হচ্ছিল। কেন জানি সব আমার মন মত হচ্ছিল। সবকিছুতেই আনন্দ পেতে শুরু করলাম। আমার জীবনের কাল অধ্যায়ের আপাত সমাপ্তি দেখলাম। আজ ২২ শে জুলাই কেন জানি সেই ২২ শে আগস্টের কথা মনে পড়ে গেল।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.