দেশটা কিন্তু বেশ মজার একটা জায়গায় পরিণত হয়েছে। আমরা এত করে বললাম—হরতাল দেবেন না, প্লিজ; হরতাল দেবেন না, প্লিজ। কে কার কথা শোনে, আর যেই না আমেরিকা থেকে নিশা দেশাই বিসওয়াল এলেন, অমনি দেশে আর কোনো হরতাল নাই। হরতাল না দেওয়ার আরেকটা কারণও আছে, তা হলো, সশস্ত্র বাহিনী দিবস। ভালো।
আমরা চাই, ও নিশা আপা, আপনি বারবার আসেন। তো সারা বছর যদি নিশা আপা এই দেশে থাকেন, সারা বছরই তো আর হরতাল হয় না।
বলছিলাম, দেশটা একটা মজার জায়গায় পরিণত হয়েছে। আমরা সবাই জানি, আওয়ামী লীগ চায় না যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক। তো আওয়ামী লীগের এই চাওয়াটাকে সম্মান জানাতে চায় বিএনপি।
আওয়ামী লীগ যেহেতু চায় না, তাই বিএনপি ঠিক করেছে তারা নির্বাচনে যাবে না। আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নই তো বিএনপির কাজ।
আর কী সুন্দর চলছে সবকিছু। মন্ত্রীরা সবাই প্রধানমন্ত্রীর হাতে পদত্যাগপত্র দিয়ে দিলেন। টেলিভিশনে সেই দৃশ্য প্রচারিত হলো।
অমনি সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলতে লাগলেন, সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর হাতে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া মানেই মন্ত্রীরা আর মন্ত্রী নন। কিন্তু তবু তাঁরা মন্ত্রী। তবে সবাই নাকি নন। কারও কারও পদত্যাগপত্র গৃহীত হবে, কারও কারওটা হবে না। তাহলে সবার পদত্যাগপত্র নেওয়ারই বা কী দরকার ছিল।
প্রধানমন্ত্রী যাঁকে যাঁকে মন্ত্রী রাখতে চান, তাঁরাই তো কেবল মন্ত্রী থাকবেন, যাঁকে চাইবেন না, তিনি থাকবেন না, এটা তো হক কথা। এখন কে মন্ত্রী, কে মন্ত্রী নন, গতকাল পর্যন্ত আমরা তা জানতাম না। এর মধ্যে আরও কয়েকজন মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এঁরা সবাই ক্ষমতাসীন মহাজোটের। মহাজোটের মন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভাকে আর যা-ই বলা যাক, সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা বলা যায় না।
আওয়ামী লীগ বলবে, আমাদের কী দোষ, আমরা তো বিএনপিকে মন্ত্রিসভায় আসতেই বলেছি। আর দেখুন এইচ এম এরশাদের অবস্থা। মাত্র কদিন আগে বলেছিলেন, প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন না করলে তিনি নির্বাচন করবেন না, করলে লোকে থুতু দেবে। এখন বলছেন, তিনি নির্বাচনে যাবেন। আশা করি, লোকে তাকে থুতু দেবে না।
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নাকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে ফোন করেছিলেন। ফোনে পাননি। দেশের টেলিফোন-ব্যবস্থা তো সত্যই খারাপ। বিরোধী নেত্রীর লাল ফোন নষ্ট থাকে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে ফোনে পাওয়া যায় না।
ইশপের গল্পটা মনে আছে? শিয়ালকে দাওয়াত করল সারস পাখি। খেতে দিল মুখ সরু একটা কলসিতে। শিয়ালের মুখ ওই কলসিতে ঢুকল না। সে কিছুই খেতে পারল না। সারস পাখি লম্বা ঠোঁট ঢুকিয়ে খেয়ে নিল দিব্যি।
আর সারস পাখিকে নেমন্তন্ন করল শিয়াল। এবার খেতে দিল একটা বড় গোল থালায়। আর তাতে রাখল সুপ। শিয়াল গপগপিয়ে খেয়ে নিতে পারল। সারস পাখি কিছুই খেতে পারল না।
গত কয়েক দিন কে মন্ত্রী ছিলেন, কে ছিলেন না, কার কোন মন্ত্রণালয় ছিল, কে জানত? তাতে একটা জিনিস ঢের টের পাওয়া গেল, মন্ত্রিসভা ছাড়া এই দেশ দিব্যি চলে যায়। সম্ভবত সরকার না থাকলেও দেশ চলে যাবে। সম্ভবত ভালো চলবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেফারসন বলেছিলেন, যদি আমাকে সংবাদপত্র ছাড়া সরকার আর সরকার ছাড়া সংবাদপত্র বেছে নিতে হয়, আমি সরকার ছাড়া সংবাদপত্রওয়ালা দেশ বেছে নেব। কাজেই সরকার ছাড়া দেশের ধারণাটা নতুন কিছু নয়।
আর আমাদের এই দেশ চিরটাকাল ছিল সমাজনির্ভর। রাষ্ট্রনির্ভর নয়। আসলে এই দেশে রাজা ছিল, রাষ্ট্র ছিলই না। তবু আমাদের দেশ নাকি ভালোই চলত। এও শোনা যায়, এই অঞ্চল নাকি ছিল রত্নভান্ডার, শস্যভান্ডার।
এখন অবশ্য রাষ্ট্র আছে, সরকার আছে, আছে আমাদের পদে পদে বাধা দেওয়ার জন্য। আমেরিকান রিপাবলিকানরা খুব চিল্লায়, ছোট সরকার, ছোট সরকার বলে। আমাদেরও হয়তো সরকার চাই না বলে চিৎকার করার সময় এসে গেছে। আমাদের আসলে চাই স্থানীয় সরকার।
স্থানীয় সরকার জিনিসটা যে ভালো, তার সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হলো, আমাদের ফ্ল্যাটবাড়িগুলো।
প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে একটা করে সমিতি আছে। প্রতিবছর নতুন কমিটি নির্বাচিত হয় সেখানে। তাদের প্রতি মাসে চাঁদা দেন বাড়িওয়ালারা। সেই কমিটি গ্যাস বিদ্যুৎ পানি এমনকি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, তাদের বার্ষিক বাজেট আছে। ওখানে দুর্নীতি কম হয়, নির্বাচনেও বড় ঝামেলা হয় বলে শুনিনি।
আমরা পাঁচ বছর পর পর দেশের জন্য এই রকমই একটা ম্যানেজার নির্বাচন করব, যার নাম হবে সরকার, যাদের কাজ হবে নাগরিকদের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া। রাস্তাঘাট হাসপাতাল থানা-পুলিশ ঠিকঠাক রাখা। কিন্তু আমরা আমাদের ম্যানেজার নির্বাচন না করে নির্বাচিত করি আমাদের ভাগ্যবিধাতাদের। তাঁরা হয়ে পড়েন দেশের মালিক। তাঁরা সবকিছু দখল করেন, তাঁদের টিনের ঘরের জায়গায় রাজপ্রাসাদ ওঠে।
তাঁরা বিরোধী দল ও মতকে দমন করেন নৃশংসভাবে। এবং তাঁরা ভাবেন, ক্ষমতা চিরস্থায়ী, আর চিরস্থায়ী যদি নাও হয়, দেশের স্বার্থেই সেটাকে চিরস্থায়ী করে ফেলা দরকার। তারপর শুরু হয় মারামারি, কামড়াকামড়ি।
রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে আমাদের কিছুই যেত আসত না, যদি উলুখাগড়ার প্রাণ না যেত। কিন্তু আমাদের মরতে হচ্ছে, পুড়তে হচ্ছে, আমাদের লেখাপড়া, চলাচল, আয়-রোজগার, জানমাল, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
কাজেই প্রাণ খুলে যে তামাশা দেখব এবং উপভোগ করব, তারও উপায় নেই। যে শিশু বল ভেবে খেলতে গিয়ে ককটেল হাতে নিয়েছে এবং বিস্ফোরণে আহত হয়েছে, তাকে আমরা কী বলব? তার স্বজনদের কী বলে সান্ত্বনা দেব?
কবীর সুমনের গানটাই কেবল মনে মনে আওড়াতে হয়:
বাহবা সাবাস বড়দের দল এই তো চাই,
ছোটরা খেলবে আসুন আমরা বোমা বানাই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।