আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের পোশাক-শ্রমিক রেহানা বেগম এখন আর নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন না। ঘুমের মাঝেই তাড়া করে ফেরে সেই বিভীষিকাময় রাত। সেই আগুনের লেলিহান শিখা। অন্ধ বিশ্বাসে হাতে চার-পাঁচটা তাবিজ লাগিয়েছেন। তাতেও কোনো কূলকিনারা হচ্ছে না।
দিনগুলোও স্বাভাবিক নয় রেহানার। তাজরীন ফ্যাশনসের আগুন সেটিও কেড়ে নিয়েছে। অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন কারখানার ছয়তলায়। আগুন লাগার পর কোনোরকমে চারতলা পর্যন্ত এসে জানালা দিয়ে লাফ দেন। বাঁ পায়ের গোড়ালি ও কোমরের হাড় ভেঙে যায়।
এখনো ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হয় তাঁকে।
রেহানার মতোই হেনা, জরিনা, আলেনূর, রেবা খাতুনসহ আরও অনেক পোশাকশ্রমিক তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন এক বছর ধরে। যাপন করছেন মানবেতর জীবন। তাঁদের অনেকেই হয়তো আর কোনো দিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না।
গত বুধবার তাজরীন ফ্যাশনসের ঠিক পেছনের গ্রামটিতে কথা হয় এই হাতভাগ্য শ্রমিকদের সঙ্গে।
মৃত্যুকূপ তাজরীনের পাশেই জলজ্যান্ত সাক্ষী হয়ে আছেন এমন প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ জন।
ঠিক এক বছর আগে ২৪ নভেম্বর দিবাগত রাতে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তুবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন পোশাকশ্রমিক মারা যান। এর মধ্যে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে মারা যান ১০২ জন (হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন)। আর কারখানার জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে প্রাণ হারান ১০ জন। অনেক শ্রমিক গুরুতর আহত হন।
আগুনে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হওয়ায় ৫৩ জনের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। তাঁদের মরদেহ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষা করেও এখন পর্যন্ত ১৩ জনের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। ঘটনার দিন তাজরীনে ৯৯০ জন শ্রমিক কাজ করছিলেন।
পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, নিহত ৯৯ জনের পরিবারকে সাত লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে।
আহত ৯০ জনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় এক লাখ টাকা করে। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এখন পর্যন্ত ১৩ নিহত শ্রমিক পরিবার ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি।
পোড়া তাজরীনের কঙ্কাল: নিশ্চিন্তপুরে গিয়ে দেখা গেছে, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী হিসেবে এখনো তাজরীনের নয়তলা ভবনের কঙ্কালটি দাঁড়িয়ে আছে। ভবনটির বাইরের দেয়ালের পোড়া কালো দাগ এখনো আছে। পেছনের জানালাগুলো বাঁকা।
অনেকগুলোর লোহার শিক নেই। বড় অ্যাডজাস্টার ফ্যানের পাখাগুলো দুমড়ে-মুচড়ে আছে।
ভবনটির পেছনের যে একতলা বাড়ির চালের ওপর প্রাণ বাঁচাতে শ্রমিকেরা লাফিয়ে পড়েছিলেন, সেই টিনের চালগুলো আঁকাবাঁকা হয়েই আছে। পাকা বাড়িটির ছোট এক কক্ষে ভাড়া থাকতেন এক শ্রমিক দম্পতি। দুজনেই আগুনে পুড়ে মারা গেছেন।
কারখানায় কঠোর পাহারা দিচ্ছেন তাজরীনের মালিক দেলোয়ারের নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীরা। সেখানে প্রবেশ নিষেধ।
বুধবার দুপুরে অনেক অনুরোধ করলেও নিরপত্তারক্ষী গোলাম মোস্তফা ভবনের ভেতরে ঢুকতে দিলেন না। আরেকজন নিরাপত্তাকর্মী জানালেন, আগুনে পোড়ার পর অবশিষ্ট মেশিনপত্র মালিকপক্ষ সরিয়ে নিয়েছে। ভবনের নিচতলার ইট দিয়ে বেশ কিছু নতুন পিলার দেওয়া হয়েছে, যেন ঝুঁকিপূর্ণ ছাদ ধসে না পড়ে।
এ ছাড়া পোশাক কারখানাটি নতুন করে আবার চালুর ব্যাপারে মালিকপক্ষের চেষ্টা চলছে। বিমার ১৮ কোটি টাকা না পাওয়ায় উদ্যোগটি আটকে আছে।
খুঁড়িয়ে চলছে জীবনের চাকা: হেলপার হিসেবে তাজরীনের চারতলায় কাজ করতেন আলেনূর। জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে টিনের চালের ওপর পড়ে বেঁচে যান। মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায় তাঁর।
লাঠি ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না তিনি। স্বামী হামিদুজ্জামানকে নিয়ে কারখানার পেছনেই ভাড়া বাসায় থাকেন। বললেন, ঘরের কোনো কাজ করতে পারেন না। স্বামীর ওপর ভর করেই কোনো রকমে বেঁচে আছেন।
লাফ দিলে ডান পা আর মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায় জরিনা বেগমেরও।
সাংবাদিক এসেছেন শুনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আলেনূরের বাড়ির বারান্দায় আসেন তিনি। জরিনা সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করলেন, ‘আগুনে দিশা হারাই ফালাই। পাঁচতলা থেকে ক্যামনে ক্যামনে তিন তলায় আইসা পড়ি। স্বজনেরা যেন লাশটা অন্তত খুঁজে পায় সেই আশায় জানালা দিয়া লাফ দিছিলাম। ’
জরিনা বলেন, ‘খুব কষ্টে আছি।
ঠিকমতো বসতে পারি না। পায়ে এখনো ব্যথা। তাই কোনো কারখানায় কাজে যোগ দিতে পারতাছি না। চার মাসের ঘরভাড়া বাকি পড়ছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না।
তাই পুরা সুস্থ হওয়ার আশাও আর দেখতাছি না। ’
প্রতিবেশী একজন জানালেন, ঘটনার পর সরকারের কাছ থেকে এক লাখ টাকা পান জরিনা। তাঁর মা তাঁকে একটি ফ্রিজ কিনে দেন। কিন্তু বাড়ির মালিক ভাড়া বাকি পড়ায় ফ্রিজটি নিয়ে যান।
আলেনূরের বাসার সামনেই কথা হয় রেবা খাতুন, হেনা আক্তার ও রেহানার সঙ্গে।
তাঁরা জানালেন, আহত কর্মীদের এক লাখ টাকা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে সরকার। এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস অনিয়মিতভাবে মূল মজুরির সমপরিমাণ টাকা দেয়। একই সঙ্গে দেলোয়ারের কোনো শাস্তি না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে তাঁরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
কারখানা আবার চালু হলে কাজ করবেন কি না, জানতে চাইলে একবার পোড়া তাজরীনের দিকে তাকান রেহানা।
একটু সময় নিয়ে তিনি বলেন, ‘লাখ টাকা দিলেও গার্মেন্টসে আর কাম করুম না। দরকার হয় না খাইয়া মরুম। তার পরও না। শখ মিটা গেছে। ’
মাকে খুঁজে ফিরে তারা: অবুঝ দুই শিশু মাছুম ও মিজান।
সম্পর্কে চাচাতো ভাই। মাছুমের বয়স দুই আর মিজানের দেড়। দুজনের মা-ই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মাছুমের মা মাহফুজা বেগমের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। তবে মিলেছে মিজানের মা মিতু বেগমের।
অবুঝ এই দুই শিশু এখন দাদি জবেদা বেগমের কাছেই মানুষ হচ্ছে। মিজানের বাবা সাদ্দাম হোসেন সরকারের দেওয়া সাত লাখ টাকা পেয়ে ছেলের নামে ব্যাংকে রেখে দিয়েছেন। শনাক্ত না হওয়ায় মাছুমের বাবা আবদুল জব্বার কোনো টাকা পাননি।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, আহত ৯৭ শ্রমিককে প্রতি মাসে কারিতাসের মাধ্যমে মজুরি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া চিকিৎসা ও ওষুধের খরচ দেওয়া হচ্ছে।
এই টাকার অর্থায়ন করছে বিদেশি ক্রেতা সিঅ্যান্ডএ। আর নিহত শ্রমিকদের ৮২টি এতিম শিশুকে প্রতি মাসে চার হাজার টাকা করে দিচ্ছে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান লি আন্ড ফাং। এ ছাড়া বিজিএমইএ ৩৯ নিহত পরিবারকে প্রতি মাসে মজুরি দিয়ে আসছে। এই টাকার অর্থায়ন করছেন কয়েকজন মালিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।