আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিশ্চিন্তপুরের আগুনে ঝলসে মারা যাওয়া মানুষগুলোর অনুভূতি একটু বুঝেছি

স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি । তবে স্বপ্ন দেখা নিয়ে কিছুদিন যাবত একটা সমস্যা হয়ে গেছে । নতুন দেখা স্বপ্নগুলো কেন যেন পূরণ হচ্ছে না খুব শীঘ্রই এই সমস্যা কেটে যাবে এই আশাতেই আছি । চারপাশ কত চুপচাপ , শান্ত । কম্পিউটারে লো ভলিউমে বাজতে থাকা সফট মিউজিকের সাউন্ড শুনতে পাচ্ছি ।

এর মধ্যে থেকে এখন আর কাল রাতের ভয়াবহ আতংকের সময়টা বিশ্বাসই হচ্ছে না । মৃত্যু পাশ দিয়ে গেল । এখন বেঁচে নাও থাকতে পারতাম । গতরাতে সারাটা রাত আমাদের গাজী বাড়ি সহ পুরো এলাকার কয়েক হাজার মানুষের কেউ ঘুমাই নি । রাত চারটা থেকে আতংকিত হয়ে দৌড়াদৌড়ি , অসহায় চিত্কার , কান্না , আল্লাহ্কে ডাকা ।

এখন মনে হচ্ছে ঘুমের ঘোরে কোন দুঃস্বপ্নই দেখেছিলাম বোধহয় । আমি ঘুমুতে গেছি রাত সাড়ে ৩টার দিকে । চারটার দিকে হঠাত্‍ জানালায় প্রচন্ড শব্দে বাবার বাড়ি । বাড়ির গেট খুলে আমাদের বের হওয়ার জন্য সবাই ভেঙ্গে ফেলার মতো জোরে গেট চাপড়াচ্ছে । তাড়াতাড়ি বাইরে বের হয়ে এসে জমে গেলাম ।

বাড়ির গেটের ভেতরের গ্যাসের রাইজারে আগুন লেগে গেছে । গ্যাসের প্রেসারে প্রতি মুর্হূতে বাড়ছে , ঘূর্নিঝড়ের মতো শব্দ , চিত্‍কার , দৌড়াদৌড়ি । কি করব কিছুই বুঝতে পারলাম না , গ্যাসের আগুন বালি ছাড়া নেভানো সম্ভব না । রাত চারটায় বালি পাবো কই ? আর পেলেও তা দিয়ে রাইজার ঢাকা যাবে না । কারণ সেটা মাটি থেকে প্রায় সাড়ে চার ফিট উপরে ।

প্রচন্ড উত্তাপে কাছেই যাওয়া যাচ্ছিল না , এর মধ্যে এতো উঁচু বালির স্তুপ করা অসম্ভব । বাইরে সবাই দিশেহারা হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে । এতোই শব্দ হচ্ছিল যে চিত্‍কার করে কথা না বললে পাশের জনের কথাও শোনা যাচ্ছিলো না । দেখতে দেখতে ফুলে ফেঁপে বিশাল আঁকার নিয়ে আগুন বেড়ে কয়েক তলা উঁচু হয়ে গেল । বাড়ির মেইন গেটের ভেতরে অসংখ্য মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে আছে ।

রাইজারের চাবি ঘুরানো যাচ্ছে না , আর এলাকার গ্যাস লাইন মেইন পয়েন্ট রাস্তা ঢালাই করার সময় মাটির নিচে চাপা পড়ে যাওয়ায় গ্যাসের ফ্লোও বন্ধ করা সম্ভব না । মহিলারা ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে , মার স্ট্রোকের মতো অবস্থা , কাকু পাগলের মতো সব জায়গায় ফোন করে যাচ্ছেন । গ্যাস কোম্পানি , বিদ্যুত্‍ অফিসে , আত্নীয়স্বজন । কোথাও ফোন যাচ্ছেনা । কোথাও না ।

আগুন বেড়েই চলেছে । আশেপাশের গাছেও আগুন ধরে গেলো , কারেন্টের লাইনগুলো ছুঁয়ে ফেললো । আরেকটু পড়েই ঘরে আগুন লেগে যাবে । এদিকে ফায়ার ব্রিগেডের নম্বারই কারো কাছে নেই । কোথায় খুঁজবো , কার থেকে নেবো তাও চিন্তা করার অবস্থা ছিলো না ।

আমার মাথাটা কিভাবে একটু ঠান্ডা ছিলো জানি না । সব ডায়রির শুরুর দিকে ছাপানো কাগজে জরুরি কিছু ফোন নম্বার দেয়া থাকে । তেমনই একটা ডায়রি থেকে নম্বার দিয়ে ফোন দিলাম । হাত কাঁপছিলো । ফোনে সব বলার আগেই লাইন গেলো কেটে ।

ব্যালেন্স শেষ । আমার তখন কেমন লেগেছে বুঝতে পারছেন ? ফায়ার ব্রিগেডে খবর গেলো । আমার মেঝো দাদাও আরেকজন কে ফোন দিয়ে খবর দিলেন । আগুনের তীব্রতা বেড়েই চলছে । বাড়ির ভেতরের গ্যাসের পাইপ গলে যেতে যেতে একেবারে মোটা মেইন পাইপে আগুন চলে যাচ্ছে , দেওয়াল আগুনের তাপে টকটকে লাল ।

মেশিন ছাড়া গ্যাসের আগুন খালি হাতে পানি দিয়ে কিছুই হবে না , সবাই জানে । তবু সবাই পাগলের মতো বালতি দিয়ে পানি দিয়ে যাচ্ছে । একটা কিছু তো অন্তত করতে হবে ! আমাদের গেটের বাইরে টিনের ঘরে যারা থাকেন তারা তাদের সারা ঘর পানি দিয়ে ভেজাচ্ছেন যেন আগুন ওখানে চলে না যায় । আমি আমার জীবনে এতো আগুনের এতো তীব্রতা দেখি নি । এটা না দেখলে কল্পনা করা যাবে না ।

দেথে হিপনোটাইজড হয়ে যাবে যে কেউ । এতোই জোরে শব্দ হচ্ছিল আর আকাশ আলো হয়ে গিয়েছিলো যে আমাদের ভূঁইয়া পাড়ার সব মানুষ জেগে উঠে কিছুই করার নেই জেনেও আগুন নেভাতে চলে এসেছিলো । বিপদে সব মানুষ আসলেই এক হয়ে যায় । আমরা বেঁচে গেছি আল্লাহর রহমতে । কপাল খুব বেশি ভালো যে তখন গ্যাসের আগুনে পুড়তে থাকা ইলেকট্রিসিটির তারে কারেন্ট ছিলো না ।

গভীর রাতে সবসময়ই কারেন্ট থাকে । কাকতালীয়ভাবে ঠিক গতকাল রাতেই সাড়ে ৩টার পর মেইন রাস্তায় একটা ট্রাক ট্রান্সফর্মারের খুঁটিকে ঢাক্কা দিয়ে প্রায় উপড়ে ফেলায় পুরো এলাকার কারেন্টের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো । অন্যকোন রাতে নয় , ঠিক গতকাল রাতেই । তাও আগুন লাগার আধ ঘন্টার কম আগে । কারেন্ট থাকলে শর্ট সার্কিট হয়ে মুর্হূতের মধ্যে অনেক আগেই সারা এলাকায় আগুন ছড়িয়ে যেতো ।

পুরো এলাকা তখন ঘুমে অচেতন । আমরা হয়তো ঘর থেকে বেরও হতে পারতাম না । পুরানো ঢাকার নিমতলীর মতো আরেকটা ঘটনা ঘটতো । ঐ ট্রাক ড্রাইভারটা কখনো জানবেও না সে একটা একসিডেন্ট করে কতগুলো মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে । আবাসিক এলাকা বলে রাস্তাঘাট এতোই সরু যে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢুকতেই পারে নি ।

পোর্টেবল মেশিন দিয়ে বাড়ির কাছের পুকুর থেকে পানি এনে আগুন নেভাতে হয়েছে । পুকুরটা ছিলো বলে রক্ষা । না হলে ওরা পানিই পেতো না । ফায়ার ব্রিগেডের প্রশংসা না করে পারছি না । ওরা ফোন দেওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে চলে আসায় কোন বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটেনি ।

অথচ ফায়ার স্টেশন খুব একটা কাছে না । কি হতো যদি তখন বাসায় কারেন্ট থাকতো ? কিংবা আগুন লাগার পর যদি কারেন্ট চলে আসতো ? হিসাবটা জটিল না । কারেন্টটা থাকলেই আমরা সবাই হয়তো . . . . . এলাকার মানুষ এখনো ভয়ে অস্থির । সবাই দেখা হলেই বলছে যে কাল সবার অনেক বড় একটা ফাঁড়া কাটলো , তারা সবাই দোয়া করেছেন । অনেক দূর থেকেও তারা শব্দ শুনছিলেন , আকাশে আগুনের ফুলকি দেখছিলেন ।

এ যেন নতুন একটা জীবন পাওয়ার মতো । কি পরিমান আতংক যে ছড়িয়েছিলো তখন . . . . . . এক ঘন্টারও বেশি সময় দাউদাউ করে চোখের সামনে যেন মৃত্যু ছিলো । কয়েকদিন আগে নিশ্চিন্তপুরের আগুনে ঝলসে মারা যাওয়া মানুষগুলোর অনুভূতি একটু বুঝেছি গতরাতে । লিখে ঐ সময়ের পরিস্থিতিটা বোঝানো সম্ভব না । এমন অবস্থায় যেন আর কারো পড়তে না হয় ।

আল্লাহর দরবারে হাজার কোটি শুকরিয়া । সাবধানে থাকবেন সবাই । ১৩.১২.২০১২ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।