লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন বৃদ্ধ আবুল খায়ের। সাদা দাঁড়ি, চোখে কালো চশমা। কিছুদিন আগে একটি চোখের অস্ত্রোপচার করেছেন, তাই এই চশমা। নিজের পরনের লুঙ্গি ও গেঞ্জিটি দেখিয়ে কাঁপা গলায় বললেন, ‘পরনের এই কাপড় ছাড়া আর কিছু নেই। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
আমাদের কী অপরাধ সেটা বুঝলাম না। ’
গত বৃহস্পতিবার পোড়া ভিটার সামনে দাঁড়িয়ে আবুল খায়েরের কণ্ঠে এই আক্ষেপ ঝরে পড়ে। আবুল খায়েরের ছেলে শাহজাহান দিনমজুর। তিনিই সংসারের হাল ধরেছেন। সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজী চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশে আবুল খায়েরের বাড়ি।
হয়তো এটাই তাঁদের একমাত্র অপরাধ। শাহজাহানের স্ত্রী জাহেদা বেগম বললেন, ‘ওরা এসে প্রথমে আমার কানের দুল টেনে নিয়ে ফেলল। তারপর ঘরে আগুন দিল। ’
শুধু আবুল খায়ের নন, গত বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে চেয়ারম্যানবাড়ির পাশাপাশি আগুন দেওয়া হয় আরও কয়েকটি নিরীহ বাড়িতে। এতে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে দুটি গাভি ও বাচুরসহ হাঁস-মুরগি।
স্থানীয় জামায়াত নেতা আমিনুল ইসলামের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের পর শ দুয়েক লোক মিছিল নিয়ে এসে চেয়ারম্যানের বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ঘটনায় চেয়ারম্যানের ভাই মো. শহীদুল্লাহর দুটি গরু গোয়ালেই পুড়ে ভষ্ম হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ঘরে ঢুকে ওরা প্রথমে লুটপাট করেছে। পরে আগুন দিয়েছে। আমরা পালিয়ে যাই।
রান্নাঘর, গোয়ালঘর, কাছারিঘর সবকিছুতে তারা আগুন দেয়। কোনো ঘর বাদ রাখেনি। ’
বৃহস্পতিবার দুপুরে যখন চেয়ারম্যানের বাড়িতে প্রতিবেদক যান তখনো ধোঁয়া উঠছিল সেখানে। চেয়ারম্যান মিয়াজীর একতলা পাকা ঘরের প্রতিটি কক্ষে আগুন দেওয়া হয়, জিনিসপত্র তছনছ করা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁর প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলটিও।
হামলাকারীরা ওই সাইকেল কাঁধে করে নিয়ে যায় বলেও অভিযোগ করলেন ভুক্তভোগীরা।
চেয়ারম্যান মিয়াজীর আশপাশে তাঁর আপন ভাই এবং চাচাতো ভাইয়েরা থাকেন। তাঁদের বাড়িও বাদ পড়েনি আগুন থেকে। চেয়ারম্যানের ভাই জাহেদুল করিম বলেন, মোট ১৫টি ঘরে আগুন দিয়েছে তারা।
চেয়ারম্যানবাড়ির একটু দূরে রিকশাচালক নিজাম উদ্দিনের ঘর।
তিন মাস আগে ঘরটি বেঁধেছেন তিনি। চারদিকে বেড়া, টিনের ছাউনিযুক্ত ঘরটিতে নিজামেরা তিন ভাই ও তাঁদের পরিবার থাকে। নিজামের এক ভাই দিনমজুর। তাঁদের আরেক ভাই চেয়ারম্যানের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। এই অপরাধে নতুন ঘরটিতেও আগুন দেওয়া হয়।
নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমি বাড়িতে ছিলাম না তখন। কোনো পুরুষ ছিল না। তারা হই হই করে এসে ঘরে ঢুকে পড়ে। ঘরের মেয়েরা পালিয়ে যায়। আর তারা লুটপাট করে আগুন দিয়ে চলে যায়।
আমি ধারকর্জ করে তিন মাস আগে ঘরটি বেঁধেছি। ’ ভুক্তভোগী লোকজন অগ্নিসংযোগকারীদের নাম জানেন। কিন্তু ভয়ে বলতে চান না। ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর বলে আগুন দিল। সব লোক আশপাশের।
এখানে বাইরের লোক আসেনি। আমরা চিনি। কিন্তু কীভাবে বলি?’—চেয়ারম্যানের ভাই শহীদুল্লাহ এখনো আতঙ্কিত। চেয়ারম্যান মিয়াজী ঘটনার দিন থেকে আর বাড়বকুণ্ডমুখী হননি।
ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা যেখানে এত ভীত, সেখানে দিনমজুর শাহজাহান কিংবা নিজাম উদ্দিনরা কার কাছে আশ্রয় খুঁজবেন!
এই আগুনে খোয়া গেছে জাহেদার শ্বশুর আবুল খায়েরের আরেক চোখ অস্ত্রোপচারের জন্য রাখা ১০ হাজার টাকাও।
‘আমার বাবার একটি চোখ অপারেশন করেছি অনেক কষ্টে। আরেক চোখ অপারেশনের জন্য ভিক্ষা করে ১০ হাজার টাকা তুলে রেখেছিলাম। সেই টাকা আর পাইনি। হয়তো আগুনে পুড়ে গেছে নয়তো তারা নিয়ে গেছে। ’ শাহজাহানের চোখের জল শুকিয়ে গেছে আগেই।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।