রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য গত রোববারই ‘কিছু সময় অপেক্ষা করার’ কথা বলেছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই আচমকা নির্বাচনী ট্রেনে চড়ার হুইসেল বাজিয়ে দিলেন তিনি।
সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের মাধ্যমে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় সিইসি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৫ জানুয়ারি রোববার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। যদিও এ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণ অনিশ্চিত, তবু ‘আনন্দঘন পরিবেশে’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে সিইসি আশা প্রকাশ করেছেন।
তবে তিনি এ-ও বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় সিইসির পেছনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখা যায়নি। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে সাংবিধানিক অপরিহার্যতা রয়েছে। তবে ছবি কেন রাখা হয়নি তা উনি (সিইসি) ভালো বলতে পারবেন। ’
ভাষণে সিইসি বলেন, ‘এত দিন আমরা অপেক্ষা করেছিলাম একটা রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য।
আমাদের হাতে বিলম্ব করার মতো সময় আর নেই। আলোচনার মাধ্যমে সকলের অংশগ্রহণে একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথে আসার জন্য আবারও সকল মহলকে আহ্বান জানাচ্ছি। ’ সিইসি এ আহ্বান জানালেও রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়ায় দেশ কার্যত একদলীয় বা বোঝাপড়ার নির্বাচনের পথে পা বাড়াল। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বেড়ে যাওয়া এবং সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গতকাল সিইসির ভাষণের পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে বিক্ষিপ্ত হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আজ মঙ্গলবার ভোর ছয়টা থেকে ৪৮ ঘণ্টার রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে প্রথম থেকে নবম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কয়েক কোটি শিশু-কিশোর এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার্থী ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী।
নির্বাচন কমিশনের সংশোধিত আচরণবিধি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, মন্ত্রী এবং সরকারি সুবিধাভোগী অন্যান্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আজ মঙ্গলবার থেকে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবেন না। তবে প্রাপ্যতা অনুযায়ী তাঁরা নিরাপত্তা পাবেন বলে সিইসি তাঁর ভাষণে জানিয়েছেন।
কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, সমঝোতার কথা বলা হলেও সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসায় ইসি তফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়।
ওই সূত্রটি বলছে, সমঝোতা হলে তফসিল ঘোষণা দু-চার দিন পিছিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কমিশন মনে করেছে, শিগগিরই আর সমঝোতা হচ্ছে না। তবে নির্বাচন কমিশন নিজস্ব বিবেচনা থেকে এ সংকটময় মুহূর্তে তফসিল ঘোষণা করেছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
গতকাল সন্ধ্যার পর কমিশন থেকে বের হওয়ার সময় তফসিল ঘোষণা-সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘আপনারা যা যা জানতে চান, ভাষণে সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন। এখনো সমঝোতা হলে ওয়েলকাম (স্বাগত)।
’
১৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে দেখা করে নির্বাচন কমিশন। এ প্রসঙ্গে সিইসি ভাষণে বলেন, ‘আমরা তাঁকে অনুরোধ জানাই, তিনি যেন ব্যক্তিগত বিশেষ উদ্যোগ নেন এই অসহনীয় অচলাবস্থা দূরীকরণে। আমরা এখনো আশা রাখি, জনগণের এ প্রত্যাশা উপেক্ষা করবেন না কেউই। ’
এর আগে গত শুক্রবার কমিশনার শাহ নেওয়াজ বলেছিলেন, সোমবারের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করা হবে। কিন্তু গত রোববার সিইসি বলেন, ‘সারা দেশের মানুষ সমঝোতা চায়।
আমরাও চাই সমঝোতা হোক। সুতরাং সমঝোতার জন্য কি সময় দেওয়া উচিত নয়?’
তফসিল ঘোষণা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের মধ্যে এ দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলে আসছিল কয়েক দিন ধরে। পাশাপাশি সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ নিয়ে চলছে নাটকীয়তা। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মধ্যে গোপন বৈঠকটি নাটকীয়তায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
এর আগে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিয়েও বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
দেশে তখন জরুরি অবস্থা ছিল। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান দুই বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর জরুরি অবস্থা তুলে নেয় সেনাসমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে, নিশ্চিন্তে ঘরে ফেরা: সন্ত্রাস, মাস্তানি বা পেশিশক্তি সাধারণ ভোটারদের জিম্মি করতে পারবে না—ভোটারদের এমন অভয় দিয়েছেন সিইসি। বলেছেন, ‘আমি আজ এটুকুই আশ্বাস দিতে চাই যে, আপনারা যাতে ঘর থেকে বেরিয়ে নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে এবং ভোট প্রদান করে নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরে আসতে পারেন, সে ব্যাপারে যা যা করা দরকার, আমরা তা-ই করব।
’
নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে শুধু পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার ও ভিডিপি নয়, বরং এর পাশাপাশি দেশের অতন্দ্রপ্রহরী ও জনগণের আস্থাভাজন সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকেও নিয়োগ করা হবে। ’ ভাষণে দুবার তিনি বিষয়টি উল্লেখ করেন।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা সরকারি, আধা সরকারি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিপুল কর্মী বাহিনীকে ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে জাতীয় দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকার আহ্বান জানান সিইসি। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা এ দেশের মাটি, পানি, বাতাসে জীবন ধারণ করছেন।
এ দেশের স্বার্থই আজ আপনাদের একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে। দেশের ঋণ শোধ করার জন্য আজ ডাক এসেছে। ’
মনোনয়নপত্র গ্রহণ ও জমার সময়: ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ২ ডিসেম্বর সোমবার। আজ মঙ্গলবার থেকে মনোনয়ন ফরম নেওয়া যাবে। এবার এ প্রক্রিয়ার জন্য মাত্র এক সপ্তাহ সময় রাখা হয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে একই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ১১ দিন (৩ থেকে ১৩ নভেম্বর) সময় রাখা হয়েছিল।
এবার মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর যথাক্রমে বৃহস্পতি ও শুক্রবার। প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৩ ডিসেম্বর শুক্রবার।
বেড়েছে ভোটার ও ভোটকেন্দ্র: এবার ৩০০টি আসনের মোট ভোটার সংখ্যা নয় কোটি ১৯ লাখ ৬৬ হাজার ২৯০ জন। এর মধ্যে পুরুষ চার কোটি ৬১ লাখ ২৩ হাজার ৩১৮ এবং নারী চার কোটি ৫৮ লাখ ৪২ হাজার ৯৭২ জন।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় আট কোটি ১০ লাখ।
নির্বাচনে মোট ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন। এর মধ্যে ৬৪ জেলায় ৬৪ জন জেলা প্রশাসক এবং ঢাকা মহানগর ও চট্টগ্রাম মহানগরে দুজন রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন ৫৭৭ জন।
সিইসি বলেছেন, ২০০৮ সালের তুলনায় ভোটার সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা এবং নির্বাচনী কর্মকর্তার সংখ্যা বেড়েছে।
তফসিল ঘোষণার দিন থেকে নির্বাচন-পূর্ব সময় গণনা শুরু হবে এবং নির্বাচনের ফলাফল গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হওয়া পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে।
শুধু অঙ্কে নয়, কথায়ও লিখতে হবে প্রাপ্ত ভোটসংখ্যা: সিইসি বলেছেন, নির্বাচনী আইনের বিধান অনুসারে প্রত্যেক কেন্দ্রে ভোট গণনার পর প্রিসাইডিং কর্মকর্তা প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের ফলাফল আগের মতো শুধু অঙ্কে লিখবেন না, কথায়ও লিখবেন। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভোটকেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা করার পর এজেন্টদের সই করা রেজাল্টশিট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন। এর একটি কপি ডাকযোগে সরাসরি নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। যত রাতই হোক না কেন, ভোটকেন্দ্র থেকে রেজাল্টশিট (ফল) জমা না হওয়া পর্যন্ত ডাকঘর খোলা রাখা হবে।
কমিশনের উদ্যোগ: সিইসি তাঁর ভাষণে বলেন, নির্বাচন বিষয়ে নিবন্ধিত ৩৮টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দলের সঙ্গে কমিশন আলোচনা করেছে। এ ছাড়া সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী এবং নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এনজিওর প্রধানদের সঙ্গে কমিশন মতবিনিময় করেছে।
বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতীয় সংসদের শূন্য আসনে সাতটি এবং ছয়টি সিটি করপোরেশনসহ মোট ৫৪টি নির্বাচন অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার কথা বলেন সিইসি। তিনি নির্ভুলভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কথা উল্লেখ করেন। সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
সিইসি সব রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে বলেন, ‘দেশবাসীর শান্তির জন্য গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে আপনারা সমঝোতায় আসুন। দেশবাসীর কল্যাণের ওপর আর কিছুই প্রাধ্যান্য পেতে পারে না। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।