আমি একজন ইসলামের দায়ী---আল্লাহ আমাকে ইসলামের দায়ী হিসাবে কবুল করুন। ...আমীন।
বিষয়বস্তু:
এই যে এখন কম্পিউটারে দু-একটি বোতাম টিপেই খুলে বসেছি আমারব্লগ ডটকম, অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস, ঠিক এমনটি কী আমরা ভাবতে পেরেছিলাম বছর দশেক আগে? নিঃসন্দেহে এটি তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি তথা ব্যবহারিক দিক বিবেচনায় বাংলা ভাষারই অগ্রগতি। আচ্ছা, বাংলার এই উল্লম্ফন শুরু হলো কবে থেকে?
এ নিয়ে যারা দীর্ঘদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তাদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে এই লেখক জেনেছেন, প্রযুক্তির সিঁড়ি বেয়ে মাত্র চার দশকে বাংলা ভাষা ব্যবহারে বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাতেই সম্ভব হচ্ছে কম্পিউটারে লেখালেখি, বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা প্রকাশ, গবেষণা, ওয়েবসাইট নির্মাণ, তথ্য ও ছবি অনুসন্ধান, ই-মেইল আদান-প্রদান, এমনকি ব্লগিং-ও।
ব্যবহারিক দিক বিবেচনায় এ সবই বাংলা ভাষার জন্য এক-একটি মাইলফলক বৈকি।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, বিশ্বে এখন অন্তত ২৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষা ব্যবহার করছেন। ভাষাভাষীর সংখ্যা অনুসারে বাংলার স্থান ষষ্ঠ। কোনো কোনো হিসাবে এ ভাষাভাষীর সংখ্যা এরই মধ্যে ২৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে এবং এর অবস্থান এখন চতুর্থ। ভারতে বাংলা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কথিত ভাষা।
বছর বিশেক আগে আন্তর্জাতিক বর্ণ সংকেতায়ন ব্যবস্থা– ইউনিকোডে বাংলা ভাষা যুক্ত হওয়ার পর এর সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গিয়েছিল। জনপ্রিয় ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন গুগল ১৩০টি ভাষার সঙ্গে বাংলাকেও যুক্ত করেছে। ফলে এখন গুগল বাংলায়ও ব্যবহার করা যায়। বছর চারেক ধরে কম্পিউটারে ফোনেটিক কি-বোর্ড ব্যবহার করে খুব সহজেই সব ধরনের বাংলা লেখা সম্ভব হচ্ছে।
ফলে যারা কি-বোর্ডের কোথায় কোন বাংলা হরফ আছে তা জানেন না, তারাও সহজেই বাংলায় লিখতে পারছেন।
বাংলা উইকিপিডিয়া এখন বিশ্বের বৃহত্তম বাংলা ভাষার ওয়েবসাইট। পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধ ও খসড়াসহ এর নিবন্ধনের সংখ্যা ১৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে!
বাংলা ভাষার অগ্রগতি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুকেও। এর প্রায় ৩০ কোটি ব্যবহারকারীর মধ্যে লাখ দেড়েক বাংলাভাষী। কিছুদিন আগে ফেসবুকও বাংলা সংস্করণ যুক্ত হয়েছে। তবে সরাসরি ইংরেজী থেকে যান্ত্রিক অনুবাদ হওয়ায় এর আরো বিকাশ প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে।
একই কথা বলা হয়, গুগলের বাংলা সংস্করণ সর্ম্পকে। …
অভ্র সফটওয়্যারে ইউনিকোড ব্যবহার করে ই-মেইল, ফেসবুক, বাংলা ব্লগসহ সব সাইটেই বাংলায় লেখালেখি সম্ভব হচ্ছে। অভ্রকে অনেকেই বলছেন ইন্টারনেটে বাংলা ব্যবহারের মাইলফলক। বাংলাদেশে নকিয়া, সিম্ফোনিসহ দু-একটি মোবাইল ফোন সেট ব্যবহার করে বাংলাতেই সংক্ষিপ্ত বার্তা– এসএমএস আদান-প্রদান করা যাচ্ছে। তবে বাংলা বর্ণমালায় ডট-এর সংখ্যা বেশী হওয়ায় অনেক সময়ই দেখি, একটি ছোট এসএমএস লিখতে দু-তিন পৃষ্ঠা লেগে যাচ্ছে, অর্থাৎ এতে খরচ পড়বে একটু বেশী।
এছাড়া নকিয়া থেকে নকিয়া ফোন সেটেই বাংলায় এসএমএস-এর আদান-প্রদান সম্ভব, নকিয়া থেকে অন্য সেটে এমন সম্ভব নয়। অর্থাৎ এ নিয়েও আরো কাজ করার অবকাশ রয়েছে। …
এ ছাড়া কিছুদিন আগে জি-মেইল ১২টির ভাষার সঙ্গে বাংলাকেও অনুবাদিত ভাষা হিসেবে যুক্ত করায় এখন ফোনেটিক বাংলাতেই ই-মেইল আদান-প্রদান সম্ভব। এমন কি যিনি বাংলা টাইপ করতে জানেন না, তিনিও ফোনেটিকে ইংরেজি অক্ষরে বাংলা উচ্চারণে শব্দটি টাইপ করলে, এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলা হয়ে যাবে; যেমন এখন কিবোর্ডে ইংরেজিতে Pukur লিখলে, জি-মেইল নিজেই অনুবাদ করে তা বাংলায় রূপান্তর করে নেবে ‘পুকুর’।
সম্প্রতি উবুন্টু লিনাক্স, মাইক্রোসফট উইন্ডোজ– এসবের মাধ্যমেও বাংলায় কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
এর পাশাপাশি ওপেন অফিস, ফায়ারফক্স এ সবেরও বাংলা সংস্করণ বেরিয়েছে। অত্যন্ত উদ্যমী একঝাঁক তরুণ কাজ করে চলেছেন বিভিন্ন সফটওয়্যারকে স্থানীয়করণ করতে।
তবে এখনো ইন্টারনেটে বাংলা লেখার সুবিধা কম বলেই কেবল অনেকে বাংলা কথাকে ইংরেজি হরফে লিখছে বা ইংরেজিতেই আলাপ করছে। ই-মেইল, ফেসবুক বা ব্লগে সরাসরি বাংলায় লেখার সহজ ব্যবস্থা পেলেই বাঙালিরা বাংলাতেই আরো অনেক বেশী বাংলার চর্চ্চা করবেন বলেই মনে হয়।
কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মোস্তফা জব্বার বাংলাদেশে প্রথম ১৯৮৭ সালে বাংলা সফটওয়্যার ‘বিজয়’ এবং একই নামে ১৯৮৮ সালে বাংলা কি-বোর্ড উদ্ভাবন করেন।
বাংলাদেশে বাংলার এই ফ্রন্ট ও কি-বোর্ডই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। ১৯৮৭ সালের ১৬ মে কম্পিউটারে প্রথম পত্রিকা ‘আনন্দপত্র’ও প্রকাশ করেন তিনি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ১৯৬৫ সালে ‘মুনীর অপটিমা’ টাইপরাইটার উদ্ভাবন করেন। এর পর অনেক অফিস-আদালতে কাগজ-কলমের বদলে টাইপরাইটার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার পথচলা। এটি বাংলা ভাষা ব্যবহারের এক ধাপ অগ্রগতি।
পরে আটের দশকে বাংলাদেশে কম্পিউটার চালু হলে ‘বিজয়’-এর বাংলা লেখালেখি, পত্র-পত্রিকা প্রকাশ আরো সহজ হয়। কালক্রমে ইউনিজয়, প্রভাত, অভ্র ছাড়াও আরো কয়েকটি বাংলা কি-বোর্ড আবিষ্কৃত হয়। একই সঙ্গে সম্ভব হয় ফোনেটিক পদ্ধতিতে বাংলা লেখা। এ সবই প্রযুক্তির হাত ধরে বাংলা ভাষারই প্রসার। বিজয় বায়ান্নো উইন্ডোজের জন্য প্রণীত সবচেয়ে সাশ্রয়ী বিজয় বাংলা সফটওয়্যার।
এর সর্বশেষ সংস্করণটি রজত জয়ন্তী সংস্করণ। এটি দিয়ে বিজয়-এর স্বাভাবিক আসকি কোড এবং ইউনিকোড; উভয় পদ্ধতিতেই লেখা যায়। এর সাথে রয়েছে প্রয়োজনীয় বাংলা ফন্ট এবং ২০০৩ কনভার্টার। এটি উইন্ডোজ এক্সপি, উইন্ডোজ সেভেন ও উইন্ডোজ এইটে কাজ করে। উইন্ডোজ-এর প্রায় সকল এ্যাপ্লিকেশনেও এটি কাজ করে।
মোস্তফা জব্বারের ভাষ্য মতে, প্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারের এই উন্নতিটুকু দরকার ছিল। তবে এখনো অনেক কাজ বাকি। এ জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রধান উদ্যোক্তা এবং আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড. রাগিব হাসান। তথ্য-প্রতিবেদনের কাজে এ বিষয়ে তার মতামত চাওয়া হলে এই লেখককে তিনি এক ইমেইল বার্তায় বলছেন, গত চার দশকে বাংলা ভাষার ব্যবহার এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা।
এ ক্ষেত্রে ইউনিকোড প্রযুক্তি সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এতদিন কম্পিউটারে বাংলা লেখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো, যার কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল ছিল না। গত পাঁচ বছর ধরে সার্বজনীন ইউনিকোডে বাংলা লেখা হচ্ছে, ফলে ইন্টারনেটে বাংলার ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। বাংলা ব্লগের বিপুল জনপ্রিয়তা ও বাংলা উইকিপিডিয়ার বিস্তার লাভই এর বড় প্রমাণ।
‘অভ্র’ সফটওয়্যার উদ্ভাবন করেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান খান।
মেহেদী, রিফাতুন্নবি, তানভিন ইসলাম সিয়াম, রাইয়ান কামাল, শাবাব মুস্তফা, নিপুণ হক– এই কয়েকজন বন্ধু গত ছয় বছর ধরে অভ্র নিয়ে কাজ করছেন।
‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’ এই শ্লোগান নিয়ে ‘অভ্র’র এগিয়ে চলা। এর সমস্ত সংস্করণ বিনামূল্যে ডাউনলোড করে ব্যবহার করা যায়। ব্যবহারকারীর ইউনিজয়, প্রভাত ও ফোনেটিক কিবোর্ড বাছাই করারও সুযোগ রয়েছে। এমন কি যিনি কম্পিউটারে বাংলা লিখতে অভ্যস্ত নন, তিনি যেন অন্তত কিছু বাক্য বাংলায় লিখতে পারেন, সে জন্য মাউস চেপে (ভার্চুয়াল কিবোর্ড) বাংলায় লেখার অপশনও তৈরি করেছেন অভ্রর কোডাররা।
বাংলা উইকিপিডিয়া, সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটের সার্চ ইঞ্জিনে এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে অভ্র-ফোনেটিক অপশন।
মেহেদী হাসানের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পাই, অভ্রর কোডাররা এখন কাজ করছেন, কি-ভাবে অফলাইনে ফোনেটিক অপশন ব্যবহার করা যায়, সে সুবিধা তৈরি করতে। এই গুরুতর বিষয়টি সম্ভব করে তোলা গেলে বাংলা টাইপিং একেবারে ছেলেখেলা হয়ে দাঁড়াবে বৈকি।
জনপ্রিয় বাংলা ব্লগ সাইট আমারব্লগ ডটকম-এর নির্মাতা, প্রধান সঞ্চালক ও ব্লগার সুশান্ত দাস গুপ্ত’র এ বিষয়ে সে সময় এই লেখককে বলেন, মূলত ইউনিকোডের কল্যাণেই বাংলায় ওয়েবসাইট তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। ওয়েবে বাংলা প্রসারে হাসিন হায়দার, সবুজ কুণ্ডু, এএসএম মাহবুব মুর্শেদ, আহমেদ অরূপ কামাল, আরিল প্রমুখের অবদান উল্লেখযোগ্য।
সহব্লগার সুশান্ত দা তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, আমি নিজে বাংলা টাইপ করতে ভয় পেতাম, কিন্তু অভ্র কি-বোর্ড আসার পর এখন আমি ইংরেজির চেয়েও দ্রুত গতিতে বাংলা টাইপ করতে পারছি। …তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার প্রসারে মুস্তফা জব্বার, লিড প্রোগ্রামার পাপ্পান এবং অভ্রর সব কোডারের বড় অবদান রয়েছে।
এ কথা বলা ভালো, ইউনিকোড বা অভ্র ব্যবহার তুলনামূলক সাম্প্রতিক হওয়ায় অনেকেই এর ব্যবহার শুরু করেননি। বাংলাদেশে এখনো বিজয় সফটওয়ারই বেশি জনপ্রিয়। ফলে লেখালেখির আদান-প্রদানে ফন্ট ভেঙে যাওয়াসহ নানা সমস্যা হচ্ছে।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক গত ২১ বছর ধরে কম্পিউটারে বাংলা ভাষায় সব ধরনের লেখালেখি করছেন। তিনিও মনে করেন, প্রযুক্তির বিকাশে বাংলা ভাষা ব্যবহারিক দিকে এগিয়েছে– এটি অবশ্যই জাতীয় জীবনের একটি মাইলফলক। কিন্তু প্রযুক্তিগত দিকে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো অনেক কাজ বাকি। ইংরেজি ভাষার মতো কম্পিউটারে এখনো বাংলা ভাষা বিশ্বে সবার কাছে পাঠযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
তার ভাষায়, আমি যে ফন্টে বাংলায় লিখি, তা পশ্চিমবঙ্গের কোনো লেখক বা প্রকাশক পড়তে পারেন না।
আবার তারা যে ফন্ট ব্যবহার করেন, সেটিও আমি পড়তে পারি না। এ জন্য দু’দেশের কম্পিউটার বিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখকের একসঙ্গে বসে একটি একক ব্যবস্থায় কম্পিউটারে লেখার সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে। বাংলাদেশকেই এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে হবে।
বর্ণমালার জন্য রক্ত দিয়ে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। বোধকরি সে কারণেই সৈয়দ হকের ওই নেতৃত্বদান বিষয়ক মন্তব্য।
উপসংহার:
সবশেষে বলি, প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা ভাষার ব্যবহারও এগিয়ে চলেছে– এটি অবশ্যই একটি অগ্রগতি। তবে প্রযুক্তি এখনো সমাজের মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই শুধু প্রযুক্তির বিকাশই শেষ কথা নয়।
বাংলা ব্লগের ভাষা ও দিকদর্শনসমূহ:
১। বাংলা ব্লগ সাইটগুলোতে যে ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, তা সত্যিই এখন বাংলা ভাষাপ্রেমীদের ভাবিয়ে তুলেছে।
এফএম রেডিওগুলোর বাংলিশ ভাষার বহুল ব্যবহার ও উচ্চারণও এই ভাবনা আরো উস্কে দেয়। তবে একই সঙ্গে দিন দিন বাড়ছে বাংলা ব্লগের জনপ্রিয়তা ও পরিধী। শেষ পর্যন্ত এর গন্তব্য কোথায়? আর কেমনই বা এর অন্তর্দশন?
তার আগে আসুন, সংক্ষেপে জেনে নেই ‘ব্লগ’ ধারণাটির পেছনের কথা।
২। এক সময় মানুষ যখন লিখতে শেখেনি, তখন ছবি এঁকে সে মনের ভাব প্রকাশ করতো।
গুহাচিত্রে এর অসংখ্য নজির রয়েছে। বিবর্তনের ধারায় ভাষা ও অক্ষরের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লেখার উপকরণের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মানুষ পাথর, মাটির পোড়া ফলক, চামড়া, গাছের ছাল ও পাতা, কাপড় এবং সবশেষে প্যাপিরাস ও কাগজে লিখে মনের ভাব প্রকাশ করতে থাকে; লেখা-পড়া, শিক্ষা-দীক্ষা ও দাপ্তরিক কাজ তো বটেই।
আরো পরে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে টাইপরাইটার হয়ে চলে আসে কম্পিউটার, লেখা হতে থাকে কম্পিউটারের অন্তর্জালে, মুঠোফোনের সংক্ষিপ্ত বার্তা, এসএমএস-এ। মূল বিষয়টি কিন্তু একই থেকে যায়, ভাব প্রকাশ।
আমি যা ভাবছি, তা অন্যকে জানানো, অন্যের ভাবনা জানা, আমার ভাবনা বা অন্যের ভাবনা সম্পর্কে পাঠকের ভাবনাটুকুও জেনে নেওয়া। এটি যেনো অনেকটা সেই লিটল ম্যাগাজিনেরই অন্তর্জাল রূপ। প্রথাবিরোধী লেখা-লেখির এক নতুন মাধ্যম। …
প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে এর আরেকটি প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, ব্লগে পাঠক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পর পরই মন্তব্যের ঘরে। সেখানেও চলে তর্ক-বিতর্ক, প্রসংশা, এমনকী লেখার নিন্দাও।
আবার একটি লেখার বিতর্ক জন্ম দেয় আরো অনেক চিন্তাশীল লেখাও।
‘ওয়েবলগ’ কথাটি থেকে ‘ব্লগ’ কথাটির জন্ম, এর প্রথম সূচনা জর্ন বার্গার নামের একজন আমেরিকানের হাত ধরে ১৯৯৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর। তিনিই প্রথম ওয়েবলগ কথাটি ব্যবহার করেন, আদি ব্লগারদের তিনি একজন, প্রথম দিকের ব্লগ সাইটের উদ্যোক্তা তো বটেই। ১৯৯৯ সালের এপ্রিল-মের দিকে পিটার নামে জনৈক ওয়েবলগ কথাটিকে আরো সহজ করে ‘উই ব্লগ’ কথাটি ব্যবহার করেন। ক্রমে উই ব্লগ, পরে শুধু ব্লগ কথাটিই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে; মনের ভাব প্রকাশ, সামাজিক যোগাযোগ ও তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বিস্তৃত করে।
ব্লগ ধারণাটির বাড়তে থাকে দ্রুত লেখক-পাঠক সংখ্যা। যারা জীবনে কখনো পরীক্ষার খাতা, চাকরি জীবন বা চিঠি পত্রের বাইরে কোনো রকম লেখালেখি করেননি, অধিকাংশ এমন মানুষও ব্লগ পড়তে পড়তে এর ভক্ত হয়ে ওঠেন, তিনি নিজেই এক সময় লিখতে শুরু করেন। পেশাদার লেখকরা তো এখানে আছেনই। ব্লগের এই ধারাবাহিক অগ্রগতি এখনো চলছেই।
৩।
তথ্য-প্রযুক্তিতে আমরা অনেক পিছিয়ে, ব্লগের ধারণাটিও প্রায় নতুন, তাই বাংলা ব্লগ সাইটও অনেক পিছিয়ে থাকবে, এটিই যেনো স্বাভাবিক। কিন্তু এর পরেও মাত্র চার বছরের পথ পরিক্রমায় বাংলা ব্লগের অর্জন নেহাত সামান্য নয়। এই সাফল্য কতোটা ও কেমন করে, তা এক নজরে এখন জেনে নেওয়া যাক।
‘বাঁধ ভাঙার আওয়াজ’ শ্লোগান নিয়ে ২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রথম যাত্রা শুরু করে বাংলা ব্লগ সামহোয়ারইনব্লগ ডটনেট। এখনো এটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা ব্লগ সাইট; এর নিবন্ধিত সদস্য এখন আটত্রিশ হাজার।
বাংলা ভাষাভাষী অধিকাংশ ব্লগারই এর সদস্য। তারপর তৈরি হয়েছে সচলায়তন, আমার ব্লগ, মুক্তমনা, পেঁচালী, নির্মানব্লগ, নাগরিকব্লগ, প্রজন্ম ফোরাম…। এসেছে শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো ব্লগ। দেশের প্রথম অনলাইন দৈনিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-ও বাংলা এবং ইংরেজী– দুভাষাতেই ব্লগ সাইট চালু করেছে।
সাময়োরইনব্লগ ডটনেট -এর পরে সচেলায়তন ডটকম জনপ্রিয়তা পেলেও এখন এটি হারিয়ে ফেলেছে ব্লগ চরিত্র।
বরং অনলাইন সাহিত্যপত্র হিসেবে এখন এটি একটি সুশীল চরিত্র অর্জন করেছে, কমছে এতে পুরনো লেখকদের পদচারনা।
এর বাইরে ব্লগ সাইটের সদস্য সংখ্যাও বাড়ছে। এরই মধ্যে প্রথম আলো ব্লগের সদস্য সংখ্য ১৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে অভিনব বাংলা ব্লগ সাইট আমারব্লগ ডটকম। ‘কথা হোক ইচ্ছে মত’ শ্লোগান নিয়ে মডারেশন বিহীন সাইটটি মাত্র দুবছরেই প্রায় ১০ হাজার সদস্য সংগ্রহ করেছে।
তারাই প্রথম ব্লগ সাইটে মুক্তি দিয়েছে ‘হিল্লা’ নামক একটি স্বল্প দৈর্ঘ চিত্র। অন্তর্জালের সঙ্গে পরিচিত নন, এমন পাঠককে ব্লগারদের লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিতে ব্লগগুলো গত দুবছর ধরে প্রতি বই মেলায় নির্বাচিত লেখা নিয়ে বই প্রকাশ করছে। বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগ, এমন কী অসহায় মানুষের পাশে আর্থিক সাহায্য নিয়েও দাঁড়াচ্ছেন ব্লগাররা।
আবার এক-এগারোর পরে এই লেখক ও ব্লগার, সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্যান্য সহকর্মীসহ সেনা বাহিনী কর্তৃক আটক ও হয়রানীর শিকার হলে প্রথম এর প্রতিবাদ জানান ব্লগাররাই। টেলিভিশনে খবরটি জেনেই তারা একাধিক বাংলা ব্লগে তো বটেই, এমন কী ইংরেজী ব্লগেও সহব্লগারের মুক্তি দাবি করতে থাকেন।
আবার ব্লগাররা নিয়মিত আড্ডা, পিকনিক, ব্লগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস. একুশে ফেব্রুয়ারিতে বন্ধু-বান্ধবসহ সপরিবারে মিলিত হন। পরিচিত হন একে অপরের সঙ্গে। মেতে ওঠেন আনন্দ-হাসি-গানে।
এ সবই হচ্ছে একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা বোধ এবং একটি অন্য রকম যুথবদ্ধতা — যা আগে কখনোই এ ভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে দেখা যায়নি। আর প্রবাসী বাঙালিরা তো অনেকই দেশচিন্তা ও একান্ত নিজস্ব ভাবনা প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন ব্লগকেই।
কম্পিউটারে বিজয় সফটওয়ারের পর অভ্র ফ্রন্ট ও কি-বোর্ড এবং ইউনিকোডে বাংলা প্রকাশ হওয়ার পর ব্লগেও ঘটে গেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
৪। কিছু দিন আগে বাংলা ব্লগের প্রসঙ্গ তুলতেই একজন প্রগতিশীল শিক্ষক বলেছিলেন, শুনেছি, সেখানে নাকি খুব নোংরা ভাষা ব্যবহার করা হয়? আর নাকি গালাগালিও হয় প্রচুর!
এই লেখক তার কথার প্রতিবাদ করেননি। শুধু তাকে অনুরোধ করেছেন, সাইটগুলোতে এক নাগারে কয়েকদিন ঢুঁ মারার জন্য। পরে ওই শিক্ষক জানিয়েছে, ব্লগ সম্পর্কে তার ধারণাই পাল্টা দিয়েছে বাংলা ব্লগ।
আর ব্লগ সাইটে হালকা লেখারা পাশাপাশি যে সব সিরিয়াস বিষয় নিয়ে লেখালেখি হয়, এমন কী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণাধর্মী লেখাও, তা দেখে তিনি সত্যিই হতবাক! ব্লগ সাইটে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ, তেল-গ্যাস-বিদ্যুতসহ খানিজ সম্পদের সংরক্ষণ, কিংবা টিপাইবাঁধ মুখ বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতেও জোরালো ভূমিকা রাখছেন ব্লগাররা।
কিন্তু শিক্ষক মহোদয়ের সেই প্রথম সন্দেহটিও কী এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায়? খানিকটা তেমন প্রবনতা ব্লগগুলোতে থেকেই যাচ্ছে। আবার জামাতী প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে চেষ্টা করা হয়েছে ব্লগ সাইটগুলো ব্যবহার করার।
তবে ব্লগাররাই শেষ পর্যন্ত রুখে দেন সব ধরনের অপচেষ্টা, শক্তিশালী যুক্তি-তর্ক ও তথ্য-নির্দেশিকায় ছিন্ন করেন বিভ্রান্তির মায়াজাল, দাঁত ভাঙা জবাব দেন মৌলবাদী, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রায়িক চেতনার আগ্রাসনকে। সম্মিলিতভাবে ব্লগাররাই ব্লগে রুখে দেন চিন্তার প্রতিবন্ধকতাসমূহ।
একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। অতি সম্প্রতি নো-মডারেশন ব্লগ সাইট আমারব্লগ ডটকম সাইটটি পরিচালনায় সাতটি নীতি (যদিও এটি এই ব্লগে না থাকারই কথা ছিলো) যোগ করেছে। ‘এখন থেকে আমারব্লগের সৌন্দর্য রক্ষার্থে নিম্নোক্ত পোস্ট গুলো প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে’ ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হচ্ছে:
এক. অ্যাডমিন যদি মনে করে কোনো পোস্ট মেশিন-রাইট/অর্থহীন/বক্তব্যহীন, তাহলে সেই পোস্ট প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে, দুই. যে কোন কপি পেস্ট/কপি রাইটেড ম্যাটেরিয়াল উপযুক্ত রেফারেন্স ছাড়া এবং ব্লগারের নিজের কোন বিশ্লেষণ ছাড়া পোস্ট করা হলে সেটা ও প্রথম পাতা থেকে সরানো হবে, তিন. আমারব্লগ ডটকম এ স্প্যামিং বা সাইটের টেকনিক্যাল বা অন্য যেকোনো সমস্যার কারণ হলে যে কোনো পোস্ট বা কমেন্ট আমারব্লগ কর্তৃপক্ষ মুছে দেওয়ার বা প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন, চার. আমারব্লগ.কম এ এক্সটার্নাল কোড ব্যবহার করে ব্লগারদের আইপি বা লোকেশন বের করার চেষ্টা করলে আপনার ইউজার আইডি ডিলিট এবং আপনার আইপি পার্মানেন্টলি ব্যান করে দেওয়া হবে, পাঁচ. যে কোনো অশ্লীল নিক/ছবি/অডিও/ভিডিও/বক্তব্য প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে, ছয়. যে কোনো ইংরেজী লেখা প্রথম পাতা থেকে সরানো হবে এবং সাত. যে কোনো ধরনের ফ্লাডিং কার্যকর পন্থায় প্রতিরোধ করা হবে। …
লক্ষ্যনীয়, ব্লগ যাত্রার শুরুতে কর্তৃপক্ষ ওই সাতটি পন্থার কথা বলেননি। কিন্তু উপরিক্ত পন্থাগুলো না মানার কারণে বা চেষ্টা করায় সদস্য ব্লগাররা বহুবার বিব্রত হয়েছেন, ব্লগের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে, এমন কী কর্তৃপক্ষও সাইটটি চালাতে গিয়ে নানা রকম ঝক্কি-ঝামেলার শিকার হয়েছেন; আর এ সব কারণেই ‘ব্লগের সৌন্দর্য রক্ষায়’ এ সব পন্থা আরোপ করতে হয়েছে নো-মডারেশন ব্লগ সাইটকেও!
৫।
এসব শ্লীল-অশ্লীল ভাষা ও ছবির বাইরে অনেক সময়ই ব্লগে চলে দলাদলি, ব্যক্তিগত হিংস্র আক্রমনও। এ কারণে নীতিমালার বাইরে মোটামুটি সব বাংলা ব্লগ সাইটেই ‘ব্লগারকে ব্লক’ এবং ‘মন্তব্য মুছে দিন’ এমন অপশন যুক্ত করা হয়েছে।
প্রায় শুরু থেকেই ব্লগে চলছে প্রমিত ভাষার লেখা-লেখির পাশাপাশি কথ্যভাষায় পোস্ট ও মন্তব্য দেওয়া। এই প্রবনতাটি বাংলা ব্লগের প্রধান ভাষা রীতি অবশ্যই নয়, তবে খুব ক্ষীণ ধারায় হলেও প্রবণতাটি আছেই। আবার রম্য লেখার ক্ষেত্রেও ব্লগাররা অনেক সময় সাধু ভাষা বা কথ্য ভাষা বেছে নেন।
এছাড়া ব্লগে ব্যবহার করা হয় বেশ কিছু কিম্ভুদ ভাষা। এগুলো একই সঙ্গে যেনো সংক্ষিপ্ত মোবাইল বার্তার ব্লগ সংস্করণ, এমন কী এই লেখার শুরুতে যে বাংলিশ ভাষা ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে, তা-ও।
উদাহরণ দেওয়া যাক। একটি মজার ফটো-ব্লগ পোস্ট দেখে একজন পাঠক মন্তব্যের ঘরে জানতে চাইলেন:
এসব ফটুক পাইলেন কৈ? জানতে মঞ্চায়!
পোস্ট দাতার উত্তর: খোমাখাতা+গুগলাইয়া।
মন্তব্য দাতা: হাহামগে।
পোস্টদাতা: ডিজিএম !
মন্তব্যদাতা: আরো পোস্টান! ।
পোস্টদাতা: দিমুনে, অহন দৌড়ের উর্প্রে আছি।
যারা বাংলা ব্লগের সঙ্গে তেমন পরিচিত নন, তাদের জ্ঞাতার্থে বললে ‘ভদ্র ভাষায়’ কথোপকথনটি হবে অনেকটা এরকম–
মন্তব্যদাতা: এসব ছবি কোথায় পেয়েছেন? জানতে মন চায়।
পোস্টদাতা: ফেসবুক ও গুগল সার্চ ইঞ্জিন থেকে।
মন্তব্যদাতা: হাসতে হাসতে মরে গেলাম।
পোস্টদাতা: দূরে গিয়ে মর!
মন্তব্যদাতা: দয়া করে এ রকম আরো পোস্ট দিন।
পোস্টদাতা: পরে দেবো, এখন খুব ব্যস্ত আছি। …ইত্যাদি।
লক্ষ্যনীয় ফান-পোস্টে এমন রসালো ভাষা ও ইমোকটিনের ব্যবহার মন্তব্যগুলোকেও সরস করে তুলেছে। এটি হয়তো সুশীল ভাষায় ঠিক তেমন জমতো না।
কিন্তু কথ্য ও কিম্ভুদ ওই ভাষায় ব্লগে অনেকে লিখলেও একটু পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে, গত চার বছরেও এটি ব্লগের প্রধান ভাষা হতে পারেনি, পাঠক নন্দিতও হয়নি সেভাবে। সিরিয়াস সব লেখা হচ্ছে, ওই প্রমিত বাংলা ভাষাতেই। ব্লগারদের নির্বাচিত লেখা নিয়ে এ পর্যন্ত যে সব ই-বুক অন্তর্জালে এবং অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানে ওই রকম কথ্য ও কিম্ভুদ ভাষার লেখা স্থান পায়নি।
সব মিলিয়ে এসবই ব্লগ লেখালেখির সার্থকতা এবং অগ্রযাত্রার নির্দেশক। আর বাংলা ভাষার অমিত অন্তর্নিহিত শক্তি এখানেই।
জয় হোক মুক্ত চিন্তার, শুভ বুদ্ধির। হ্যাপি ব্লগিং।
বাংলা ব্লগের জয়যাত্রা
তথ্য-প্রযুক্তি সর্ম্পকে যারা ওয়াকিবহাল, তারা এরই মধ্যে জেনে গেছেন, জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলের সেরা ব্লগ প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন ভাষার ব্লগ সাইটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনটি বিভাগে বাংলাদেশের তিনজন ব্লগার বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া আরো তিনটি বিভাগে দেশের আরো তিনজন বাংলাব্লগ দ্বিতীয় স্থান জয় করেছেন। তাই এ বিজয় শুধু ব্লগারদের একক বিজয় নয়, এটি একই সঙ্গে বাংলা ব্লগেরও বিজয় বটে।
সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এক নজরে জেনে নেওয়া যাক, ব্লগ বিষয়টি আসলে কী?
এক সময় মানুষ যখন লিখতে শেখেনি, তখন ছবি এঁকে সে মনের ভাব প্রকাশ করতো। গুহাচিত্রে এর অসংখ্য নজির রয়েছে। বিবর্তনের ধারায় ভাষা ও অরের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লেখার উপকরণের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মানুষ পাথর, পোড়া মাটির ফলক, চামড়া, গাছের ছাল, পাতা, কাপড় এবং সবশেষে প্যাপিরাস ও কাগজে লিখে মনের ভাব প্রকাশ করতে থাকে; লেখা-পড়া, শিক্ষা-দীক্ষা ও দাপ্তরিক কাজ তো বটেই।
আরো পরে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে টাইপরাইটার হয়ে চলে আসে কম্পিউটার, লেখা হতে থাকে ভার্চুয়াল জগতে– আন্তর্জালে, মুঠোফোনের সংপ্তি বার্তা, এসএমএস-এও।
মূল বিষয়টি কিন্তু একই থেকে যায়– ভাব প্রকাশ। আমি যা ভাবছি, তা অন্যকে জানানো, অন্যের ভাবনা জানা, মতামত, বিশ্লেষণ, যুক্তি-তর্ক। এটি যেনো অনেকটা সেই লিটল ম্যাগাজিনেরই ভার্চুয়াল সংস্করণ। প্রথাবিরোধী লেখা-লেখির এক নতুন মাধ্যম; কেউ বলেন– বিকল্প গণমাধ্যম।
প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে ব্লগ সাইটে লেখালেখির আরেকটি প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, ব্লগে লেখা প্রকাশের পর পরই মন্তব্যর ঘরে পাঠক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়।
সেখানেও চলে তর্ক-বিতর্ক, প্রসংশা, এমনকি লেখার তুমুল সমালোচনা ও নিন্দাও। আবার একটি লেখার বিতর্ক জন্ম দেয় আরো অনেক চিন্তাশীল লেখা।
‘ওয়েব-লগ’ কথাটি থেকে ‘ব্লগ’ কথাটির জন্ম, এর প্রথম সূচনা জর্ন বার্গার নামে একজন আমেরিকানের হাত ধরে ১৯৯৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর। তিনিই প্রথম ‘ওয়েবলগ’ কথাটি ব্যবহার করেন, আদি ব্লগারদের তিনি একজন, প্রথম দিকের ব্লগ সাইটের উদ্যোক্তা তো বটেই। ১৯৯৯ সালের এপ্রিল-মের দিকে পিটার নামে জনৈক ‘ওয়েবলগ’ কথাটিকে আরো সহজ করে ‘উই ব্লগ’ কথাটি ব্যবহার করেন।
ক্রমে ‘উই ব্লগ’, পরে শুধু ‘ব্লগ’ কথাটিই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মনের ভাব প্রকাশ, সৃজনশীল লেখালেখি, সামাজিক যোগাযোগ ও তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বিস্তৃত করে। ব্লগ ধারণাটি প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বাড়তে থাকে এর লেখক-পাঠক সংখ্যা। যারা জীবনে কখনো পরীক্ষার খাতা, চাকরি জীবন বা চিঠি-পত্রের বাইরে কোনো রকম লেখালেখি করেননি, অধিকাংশ এমন মানুষও ব্লগ পড়তে পড়তে এর ভক্ত হয়ে ওঠেন, তিনি নিজেই এক সময় লিখতে শুরু করেন। পেশাদার লেখকরা তো ব্লগে আছেনই।
ব্লগের এই ধারাবাহিক অগ্রগতি এখনো চলছেই।
তথ্য-প্রযুক্তিতে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে, ব্লগের ধারণাটিও আমাদের জন্য প্রায় নতুন, তাই বাংলা ব্লগ সাইটও অনেক পিছিয়ে থাকবে, এটিই যেনো ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু এর পরেও মাত্র চার বছরের পথ পরিক্রমায় বাংলা ভাষার সংকেতায়ন বা ইউনিকোড উদ্ভাবনের পর বাংলা ব্লগের অর্জন নেহাত সামান্য নয়।
‘বাঁধ ভাঙার আওয়াজ’ শ্লোগান নিয়ে ২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রথম যাত্রা শুরু করে বাংলা ব্লগ সামহোয়ার ইনব্লগ ডটনেট। এখনো এটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা ব্লগ সাইট।
এর নিবন্ধিত সদস্য এখন আটত্রিশ হাজার। বাংলা ভাষাভাষী অধিকাংশ ব্লগারই এর সদস্য। এরপর তৈরি হয়েছে সচলায়তন, আমার ব্লগ, মুক্তমনা, পেঁচালী, নির্মানব্লগ, নাগরিকব্লগ, প্রজন্ম ফোরাম। দৈনিক পত্রিকাগুলোও ব্লগ সাইট চালু করেছে। ব্লগ সাইট নির্মাণে এ দেশের আদিবাসীরাও পিছিয়ে নেই।
‘কথা হোক ইচ্ছে মত’ শ্লোগান নিয়ে মডারেশন বিহীন ব্লগ সাইট আমারব্লগ ডটকম যাত্রা শুরুর মাত্র তিন বছরেই প্রায় ১৫ হাজার সদস্য সংগ্রহ করেছে। তারাই প্রথম ব্লগ সাইটে মুক্তি দিয়েছে ‘হিল্লা’ নামক একটি স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র। চলতি বছর ফেব্র“য়ারিতে এর উদ্যোক্তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আমারব্লগ রিসার্চ ফাউন্ডেশন। এই ব্লগ সাইটটিসহ সচলায়তন ডটকম, মুক্তমনা ডটকম এরই মধ্যে ব্লগারদের একাধিক ইলেক্ট্রনিক বই বা ই-বুক প্রকাশ করেছে। যুক্তি, বিজ্ঞান, দর্শন, মুক্তচিন্তা, ব্লগাড্ডা — কী নেই মুক্তমনায়? মুক্তমনা মনে করে– যুক্তি আনে চেতনা, চেতনা আনে সমাজ পরিবর্তন।
আদিবাসী বাংলা ব্লগ ডাব্লিউফোর স্টাডি ডটকম ই-বুক প্রকাশের পাশাপাশি আদিবাসীদের অধিকার, সংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাসের ওপর নানা লেখা প্রকাশ করে চলেছে। এখন তারা কাজ করছে আদিবাসী তথ্যকোষ ও সার্চ ইঞ্জিন নিয়ে।
আন্তর্জালের সঙ্গে পরিচিত নন, এমন পাঠককে ব্লগারদের লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিতে ব্লগগুলো গত তিনবছর ধরে একুশে বই মেলায় নির্বাচিত লেখা নিয়ে বই প্রকাশ করছে। বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগ, এমন কী অসহায় মানুষের পাশে আর্থিক সাহায্য নিয়েও দাঁড়াচ্ছেন ব্লগাররা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ব্লগাররা অনলাইন ও অফলাইনে যোগাড় করেন লাখ লাখ গণস্বার।
এছাড়া তারা আয়োজন করেন নিয়মিত আড্ডা, পিকনিক ও ব্লগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস. একুশে ফেব্রয়ারিতে বন্ধু-বান্ধবসহ ব্লগাররা সপরিবারে মিলিত হন। পরিচিত হন একে অপরের সঙ্গে। মেতে ওঠেন আনন্দ-হাসি-গানে।
এ সবই হচ্ছে একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা বোধ এবং একটি অন্য রকম যুথবদ্ধতা– যা আগে কখনোই এ ভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে দেখা যায়নি।
প্রবাসী বাঙালিরা তো অনেকই দেশচিন্তা ও একান্ত নিজস্ব ভাবনা প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন ব্লগকেই। কম্পিউটারে বিজয় সফটওয়্যারের পর অভ্র সফটওয়্যার এবং ইউনিকোডে বাংলা প্রকাশ হওয়ার পর ব্লগেও ঘটে গেছে এমনই সব বৈপ্লবি
বিজয় বায়ান্নো
বিজয় ভিডিও টিউটোরিয়াল
বিজয় লেখালেখি শেখা
বিজয় এক্সেল শেখা
বিজয় পাওয়ারপয়েন্ট শেখা
বিজয় ফটোশপ শেখা
বিজয় ফ্লাশ শেখা
বিজয় ইলাস্ট্রেটর শেখা
বিজয় ইন্টারনেট শেখা
দেশের কম্পিউটার বিষয়ক সাময়িকীসমূহে জনাব মোস্তাফা জব্বার নিয়মিত লেখেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।