আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভোটের মালিকদের মরার দশা

তাঁরা প্রত্যেকে ভোটের মালিক। কিন্তু সরকারি দল আওয়ামী লীগ আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভোটের রাজনীতি তাঁদের জীবনের নিরাপত্তার শিকড় উপড়ে ফেলছে।
আওয়ামী লীগের ‘সর্বদলীয় সরকার’ এবং নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণা তাঁদের স্বস্তির নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। বিএনপি জোটের ডাকা হরতাল ও অবরোধে সহিংসতার মুখে সাধারণ এই মানুষেরা দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা আর শান্তি দেখতে চাইছেন।
গত দুই দিন অবরোধের ঢাকা ঘুরে অন্তত ৫০ জনের সঙ্গে কথা বললে এই আকুতি বড় হয়ে সামনে আসে।

তাঁদের কারও কারও গলায় ফোটে একান্ত অসহায়তা।
মঙ্গলবার সিএনজিচালিত অটোরিকশায় অবরোধকারীদের দেওয়া আগুনে মুখ আর শরীর পুড়ে গেছে চালক সাবেদ আলীর। বুধবার দুপুরে প্রশ্ন করলে তিনি দুর্বল অস্পষ্ট গলায় বলেন, ‘আমি তো আজনীতি করি না, আমি হইলাম মুরুক্খু মানুষ। কথা হইল, দেশটা য্যান শান্তিতে থাকে—করি খাইতে পারি। ’ তাঁর চোখ পানিতে ভাসে।


ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের দোতলার ঘরে সাবেদের খাটের পাশে মাটিতে মাদুরে ঘুমাচ্ছিল তাঁর চার বছরের ছেলে আরিফ। স্ত্রী আলেয়া খাতুন বলেন, গাইবান্ধায় গ্রামের বাড়িতে দুটি ছেলেমেয়ে আর শ্বশুর-শাশুড়ির খরচা আছে। সপ্তাহে ৫০০ টাকা ঋণের কিস্তিই বা টানবেন কীভাবে?

এই ওয়ার্ডে ১০ বিছানার সাতটিতেই হরতাল-অবরোধে আগুন, ককটেল আর পেট্রলবোমায় পোড়া রোগী। ২৬ অক্টোবর থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে এভাবে আক্রান্ত হয়ে সাতজন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন অন্তত ১০৯ জন।

শনির আখড়ায় গোলাপ ফুলের ফেরিওয়ালা আবদুর রহিম ১২ নভেম্বর হরতালে বাসে দেওয়া আগুনে পুড়ে যান।

তাঁর গলায় হতাশা, ‘যাঁরা মানুষকে মানুষ হয়া জ্বালায়া দেয়, তারা তো আর মানুষের মধ্যে পড়ে না। ওরা পোড়াইতেই থাকব, সাধারণ মানুষ পুড়তেই থাকব। ’ রহিমের বোন ফাহিমা আকতার বলেন, ‘যেমনে হোক, দুই দলরে মিলমিশের ভিতরে যাইতে হবে। ’

পেশায় দরজি কামাল হোসেন পুড়েছিলেন লেগুনায় দেওয়া আগুনে, ১০ নভেম্বর। তাঁর কথা, ‘খারাপের দিকে যাইতাছে দেশ, হেগো প্রতিহিংসার কারণে।

ভুক্তভোগী হইলাম আমরা। আমি ক্ষমতায় যামু, মানুষ মরল তো আমার কী—দোনো দলেরই এক অবস্থা। ’ নির্বাচনের তারিখ পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শান্তি তো আশাই করা যায় না। অশান্তির নির্বাচন হইব। বর্তমানে যে ক্ষমতায়, ক্ষমতা সে তো ছাড়তে চাইতেছে না।

ছাড় কিন্তু তারেই দিতে হবে। বিরোধী দলেরে আমি বলব, তারা হরতাল না দিয়া জনগণ নিয়া সরকারের সঙ্গে আলাপ কইরা নির্বাচন দিক। মানুষরে আতঙ্কের ভিতরে ফেললে তারাও ক্ষতির মইধ্যে পড়ব। ’

উল্টো দিকে মেয়েদের ওয়ার্ডে মেহেরপুর থেকে আসা মুনিয়ার সারা গা ব্যান্ডেজে মোড়া। অস্ফুটে তিনি বলেন, ‘হরতালে পুইড়েছে।

অটোতে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিছে। ’ তাঁর স্বামী রানা খান নির্বাচনের চলতি তোড়জোড়ের সমর্থক তাঁর মতে, নির্বাচনে না যাওয়াটা বিএনপির ব্যর্থতা। তবে তিনি এ-ও বলেন, বিনা সমঝোতার নির্বাচনে সমস্যা মিটবে না—‘ছাড় দিতে হবে দুই জনকেই। তবে বিএনপি যেহেতু সমঝোতায় আসছে না, সাধারণ জনগণের জন্যি সরকারকেই কঠিন একটা কিছু ছাড় দিতে হবে।

পরিস্থিতি ‘থমথম’: গতকাল সকালে এলিফ্যান্ট রোডে চালু একটি পোশাক কারখানায় কথা হয় সুপারভাইজার ইলা রানীর সঙ্গে। তাঁর কথা, ‘যেহেতু দুই পক্ষে দ্বন্দ্ব, একতরফা নির্বাচন দিলে সমাধান হবে না। দুই পক্ষই এক জায়গায় বসুক। ছাড় দিক। তবে প্রধানমন্ত্রীরই বেশি ছাড় দেওয়া উচিত, যেহেতু সে দেশের মেরুদণ্ড।

একই রকম কথা শুনি ধানমন্ডি এলাকার একজন প্রবীণ গৃহিণীর মুখেও। পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে তিনি বললেন, ‘আমি সরকারকেও সমর্থন করছি। কিন্তু চাচ্ছি, সংলাপ হোক। মনে করি, এ জন্য সরকারের দায়িত্ব বেশি।

একবার ডাকলে আসে নাই, বারবার ডাকেন। আপনি মা। দুষ্টু ছেলেকে মানান!’

পাশ থেকে পিঠা বিক্রেতা শিউলি গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বললেন, ‘এখন থমথম পরিস্থিতি। আর কোনো শব্দ নাই। ’

পোশাক কারখানাটির নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. আবু মাসুম বলেছিলেন, ‘ইলেকশন হইলে মারামারি কাটাকাটি বিশৃঙ্খলা আরও হবে।

নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠন করলে সমাধান আসবে। ’

নিরাশা ও দ্বিধা: গত পরশু বিকেলে সুনসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরতে এসেছিলেন মিরু হোসেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘ক্ষমতার লড়াই না করে, নিজেদের পকেটের কথা চিন্তা না করে দেশের মানুষের চিন্তা করেন। ’ মিরু বলেন, তিনি এ অবস্থায় ভোট দেবেন না। তাঁর বন্ধু রুবেল হোসেন বলেন, ‘না’ ভোট থাকলে দেবেন।

নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রী নওরিন সুলতানার কথা, ‘উভয় দল দেশকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করছে। পরিস্থিতি আরও বেশি অরাজকতার দিকে যাচ্ছে। ’ একই বিভাগের ছাত্র রিশান মাহমুদ বলে উঠেছিলেন, ‘রাজনীতির পিছনে যারা, তারা যে কতটা খারাপ, আপনিও বুঝবেন। সরকার ক্ষমতা ছাড়তে চায় না, হয়তো ভাবে, আর ফিরে পাবে না। ’

রিশান এবারই ভোটার হয়েছেন।

ভোট নিয়ে খুব উৎসাহ ছিল, কিন্তু এখন উবে গেছে।

লোকসান গোনেন যাঁরা: মহাখালীতে টিবি গেট এলাকায় চিশতিয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে ঢুকি বুধবার ভরদুপুরে। মালিক মো. আসাদুজ্জামান বললেন, ‘রাজনীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা, ক্ষুদ্র বা মধ্যম ব্যবসায়ীরা। দেখেন, লাঞ্চের সময়; কিন্তু ঘর ফাঁকা। ’ সংলাপের প্রসঙ্গ তোলেন তিনি, তবে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলা তো খারাপ ছিল না—সর্বদলীয় সরকার।

হইতেছে না যে ক্যান...। ’

পাশের টেবিলে চা সামনে নিয়ে বসে ছিলেন ইমারত হোসেন। দ্রুত বলে ওঠেন, ‘জামায়াতকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়া লাগছে বিএনপি। শেখ হাসিনা যেইভাবে ওদের আদর-আপ্যায়ন করতাছে, তারা তো জায়গা ছাড়তাছে না। ’

এ কথায় নড়েচড়ে বসলেন ঘরের আরেকজন মাত্র খদ্দের আইনজীবী মো. বুলবুল আহমেদ: ‘আমি একমত নই।

প্রধান বিরোধী দল না থাকলে এইটা সর্বদলীয় সরকার কী করে হয়? জ্বালাও-পোড়াও যেমন গণতন্ত্রের ভাষা না, এইটাও তা নয়। ’

হাজির হন দুই পাওনাদার—মাংস আর মুদি ব্যবসায়ী। তাঁরাও মহা বিরক্ত। একজন বলেন, দুই নেত্রী না বসলে সমাধান নাই।

কিন্তু তর্কও যেন জোশ পায় না।

শেষবেলায় রেস্টুরেন্টের তিন বালক কর্মচারী লালশাক আর অল্প কয়টা কাচকি মাছ দিয়ে ভাত খেতে বসে।

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।