ক্রিকেটে একজন ব্যাটসম্যান কত ভাবে আউট হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরে হয়তো অধিকাংশ ক্রিকেটপ্রেমীই রায় দেবে পাঁচ বা ছয় ধরনের আউটে। তাদের এ রায় খুবই স্বাভাবিক কেননা ঘুরে ফিরে আমরা সাধারণত পাঁচ-ছয় ধরনের আউটই দেখে থাকি--ক্যাচ, বোল্ড, লেগ বিফোর উইকেট (এলবিডবি¬ও), রান আউট এবং স্টাম্প আউট। হিট উইকেটকেও চাইলে প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা যায়। তবে কম প্রচলিত বা অপ্রচলিত হলেও হ্যান্ডেল দ্যা বল, টাইম আউট, অবস্ট্রাকটিং দ্যা ফিল্ড এবং হিট দ্য বল টোয়াইস নামে আরও কিছু আউট সহ ক্রিকেট আইনে অন্তর্ভূক্ত মোট আউটের সংখ্যা দশ। তবে রিটায়ার্ড আউট নামে ১১ তম আরেকটি আউটের কথা ক্রিকেট আইনে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায়।
আমাদের এই অচেনা আউট আয়োজন তালিকার শেষ অর্ধাংশ নিয়েই।
রিটায়ার্ড আউট- ফার্স্ট-ক্লাস ক্রিকেটে বেশ কিছু নজির থাকলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই আউটের ঘটনা ঘটেছে কেবল দুই বার। একই ম্যচে ঘটা এই বিরল দৃশ্যের সাক্ষী বাংলাদেশ। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে অন্য ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং প্র্যাকটিস করার সুযোগ করে দিতেই যেন মারভান আতাপাত্তু ২০১ রান এবং মাহেলা জয়বর্ধনে ১৫০ রান করে রিটায়ার্ড আউট নিয়ে স্বেচ্ছায় সাজঘরে ফিরে যান। পরে অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের জন্য যা নিয়ে বেশ সমালোচনাও হয়।
কেননা এই ধরনের ছেলেমানুষী সাধারণত দেখা যায় প্রস্তুতি ম্যাচ বা প্রীতি ম্যাচে। এই কৃতিত্বও কোন বলারের প্রাপ্য নয়। এই আউট ক্রিকেট ম্যাচের চেয়ে ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং গড়ের হিসেব কষতেই বেশী প্রাসঙ্গিক।
ক্রিকেট আইনের ২.৯(বি) অনুযায়ী কোন ব্যাটসম্যান আঘাতজনিত বা অন্য কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া যদি তার ব্যাটিং-এ অব্যাহতি চান তবে তাকে রিটায়ার্ড আউট ঘোষণা করা হয়। তবে ১৯৮৩ সালে গর্ডন গ্রিনীজ ১৫৪ রানে রিটায়ার্ড আউট নিয়ে তার অসুস্থ মেয়েকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান।
দুদিন পর তার মেয়ে মারা যান। পরবর্তিতে তার এই রিটায়ার্ড আউট কে রিটায়ার্ড নট আউট ঘোষনা করা হয়। তিনিই রিটায়র্ড নট আউট একমাত্র ব্যাটসম্যান।
টাইম আউট- যদি একজন ব্যাটসম্যান আউট হবার পর পরবর্তী ব্যাটসম্যান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্রিজে পৌছাতে না পারে তবে তাকে টাইম আউট ঘোষণা করা হয়। ক্রিকেট আইনের ৩১ তম ধারায় এই আউট সন্নিবেশিত আছে।
এই ’নির্ধারিত সময়’ পূর্বে ২ মিনিট থাকলেও বর্তমানে তা ৩ মিনিট করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এখন পর্যন্ত এই আউটের সাক্ষী না হতে পারলেও ফার্স্টক্লাস ম্যাচে টাইম আউটের ৪ টি ঘটনা নথিবদ্ধ আছে। আগের দিন নট আউট থেকে পরের দিন ব্যাটিং-এ নামার জন্য মাঠে আসতে নানা কারণে দেরী হওয়া বা ব্যাটিং-এ নামতে তৎপর না হয়ে বাউন্ডারিতে দাড়িয়ে ম্যানেজারের সাথে কথপোকথনে বেশী মনোযোগী হওয়া ইত্যাদি কারনে এই ৪ টি আউট দেওয়া হয়েছে।
হ্যন্ডেল দ্যা বল- ক্রিকেট আইনের ৩৩ ধারা অনুসারে যদি কোন ব্যাটসম্যান ফিল্ডিং দলের অনুমতি ব্যতীত ব্যট ছাড়া কেবল হাত দিয়ে বল স্পর্ষ করে বা ধরে ফিল্ডারের কাছে ফেরত পাঠায় তবে ফিল্ডিং দলের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে যে আউট ঘোষনা করা হয় তা-ই হ্যান্ডেল দ্যা বল আউট। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমরা হরহামেশাই ব্যাটসম্যানকে দেখি হাতে ধরে ফিল্ডার বা বলারকে বল ফেরত পাঠাতে।
ব্যাটসম্যানের সহযোগীতাপূর্ণ মানসিকতা বিবেচনায় এমন কর্মকান্ডে আউটের আবেদন জানায়না ফিল্ডিং দল। তবে এই আউটের আবেদন সাধারণত করা হয় বল ব্যাটে লেগে স্টাম্পের দিকে যাবার পথে পা বা ব্যাটের বদলে হাত দিয়ে বলের গতি রোধ বা পরিবর্তণ করা হলে। তবে এই উইকেটের কৃতিত্ব রান আউটের মতো বোলারকে দেয়া হয় না।
ক্রিকেট চেতনায় অনেক সময়ই ফিল্ডিং দল খেলাকে বড় কোনভাবে বাধাসৃষ্টি না করলে এমন আউটের জন্য আবেদন করেনা। তবে অন্যরকমও একেবারেই দেখা যায়না তা নয়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে এমন বিরল অভিজ্ঞতা আছে কেবল নয়জন ব্যাটসম্যানের আর একুশ শতকের ক্রিকেটে এমন ঘটনা দেখা গেছে মাত্র দুই বার। যার প্রথমটি ১৯৫৭ সালে এবং সর্বশেষটি ২০০১ সালে। শেষ দুই ব্যাটসম্যান হলেন স্টিভ ওয়াহ এবং মাইকেল ভন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এই নয় হ্যান্ডল দ্যা বলের সাতটি টেস্ট ক্রিকেটে এবং দুটি একদিনের ক্রিকেটে। স্টিভ ওয়াহ এবং মাইকেল ভন ছাড়াও এই দলে আরও আছেন অস্ট্রেলিয়ার এন্ড্রু হিলডিচ, ইংল্যান্ডের গ্রাহাম গুচ, দক্ষিণ আফ্রিকার রাসেল এনডীন ও ড্যারেল কালিনান, পাকিস্তানের মোহসিন খান, ভারতের মোহিন্দর অমরনাথ এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডেসমন্ড হেইন্স।
হিট দ্য বল টোয়াইস- যদি কোন ব্যাটসম্যান একাধিকবার শরীর বা ব্যাটদিয়ে বলকে আঘাত করে তাহলে তিনি হিট দ্যা বল টোয়াইস আউট বলে বিবেচ্য হবেন। এখানে প্রথম শটটিকে প্রকৃত খেলার জন্য এবং দ্বিতীয় শটটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাতে বলের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য করা হয়েছে বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। প্রথমবার আঘাত করার স্ট্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাওয়া বল অনেক সময়ই পা, ব্যাট এমনকি হাত দিয়ে আটকাতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে হাত দিয়ে বলটির গতিরোধ করলে তা হ্যান্ডেল দ্যা বল হবে এবং পা বা ব্যাটদিয়ে গতিরোধ বা পরিবর্তন করলে তা হিট দ্যা বল টোয়াইস বলে বিবেচ্য হবে। ক্রিকেটের ৩৪তম আইনে এই সম্পর্কিত আউটের বর্ণনা পাওয়া যায়।
হিট উইকেট- হ্যান্ডেল দ্যা বল বা রিটায়ার্ড আউটের মতো এত দুর্লভ কিছু না হলেও হিট উইকেট ক্যাচ-বোল্ড এর মতো এত সুলভ কিছুও নয়। আমাদের মাঝে অনেকেরই হয়তো সৌভাগ্য হয়নি লাইভ একটা হিট উইকেট দেখার। হিট উইকেট ক্রিকেটের ৩৫ তম আইন এবং পরিচিত আউটগুলোর মধ্যে ঘটন সংখ্যার বিবেচনায় ছয় নম্বরে আছে।
ব্যাটসম্যান তার ব্যাট, ক্যাপ, হেলমেট বা অন্যকোন ব্যবহার্য কিংবা শরীরের কোন অঙ্গ দ্বারা আঘাত করে স্ট্যাম্পের বেল ফেলে দিলে তাকে হিট উইকেট বলে। যেমন ২০০২ সালের ১৮ই আগস্ট মরোক্কোতে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং পাকিস্তান ম্যাচে রান তাড়া করতে যেয়ে জাস্টিন অনটং-এর একটা বলে ওভার বাউন্ডারি হাকিয়ে ইনজামাম পায়ের ধাক্কায় স্ট্যাম্পের বেল ফেলে দিলেন।
ছয় রানের বদলে তাকে ধরতে হলো প্যাভিলিয়নের পথ। এরকম অনেক সময়ই হিট উইকেট ট্র্যাজেডির চেয়েও বেশী কমেডি, হিট আউট হয়ে ব্যাটসম্যান অনেক সময়ই সমর্থকদের বেদনার সাথে কিছু আনন্দও দিয়ে যান। মন্টি পানেসারের বলে ইনজামামেরই হিট উইকেট বা এ্যামব্রোসের বলে স্যার ইয়ান বোথামের হিট আউটের মজার ভিডিওগুলি চাইলে ইউটিউব থেকে দেখে নিতে পারেন।
অবস্ট্রাকটিং দ্যা ফিল্ড- ক্রিকেটের ৩৭ তম আইন অবস্ট্রাকটিং দ্যা ফিল্ড। কোন ক্রিকেটার তার কথা বা কাজের দ্বারা ফিল্ডারদের কাজে বাধা সৃষ্টি করলে তাকে অবস্ট্রাকটিং দ্যা ফিল্ড এর দোষে আউট দেয়া হতে পারে।
ফিল্ডার ক্যাচ নেবার সময়, রান আউট করার সময় বা বল থ্রো করার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে বলে ফিল্ডারকে বাধা প্রদান করলে একজন ব্যাটসম্যান অবস্ট্রাকটিং দ্যা ফিল্ড হতে পারেন। আন্তার্জাতিক ক্রিকেটে এই আউটের সংখ্যা সাকুল্যে চার। এর মধ্যে টেস্ট ক্রিকেটে একবার এবং একদিনের সীমিত ওভার ম্যাচে তিনবার দেখা গেছে এই আউট। যার সর্বশেষটি ইনজামাম উল হকের কল্যাণে দেখা গেছে ২০০৬ সালের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে। ইনজামাম উল হক ক্রিজের বাইরে দাড়িয়ে ফিল্ডার কর্তৃক উইকেট কিপারকে থ্রো করা একটি বল ব্যাটের স্পর্ষে গতিপথ পরিবর্তন করেছিলেন।
প্রথম আউটটি দেখা গিয়েছিল ১৯৫১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা-ইংল্যান্ড ম্যাচে। ব্যাটসম্যান লেন হাটন ব্যাটের গুতোয় উইকেট কীপার রাসেল এনডেনকে একটি ক্যাচ নেয়া থেকে বঞ্চিত করার দায়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এই আউট হয়েছিলেন। দৈবক্রমে রাসেল এনডেনও এরকম বিরল এক আউটের প্রথম শিকার। তিনি হ্যান্ডল দ্যা বল হওয়া প্রথম ব্যাটসম্যান।
তবে মনে রাখতে হবে কোন আউটই বোলার বা ফিল্ডিং দলের আবেদন ছাড়া ঘোষণা করা যাবে না।
হিট দ্যা বল টোয়াইসের মতো আউটগুলো অধিক সময়েই ক্রিকেটীয় চেতনার কারনে আবেদন করা হয়না এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে ঘোষণাও করা হয় না। তাইতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমরা ব্যাটসম্যানকে প্রায়ই দেখি ব্যাটে বা পায়ে লেগে স্ট্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাওয়া বলকে আবার স্ট্যাম্প বা ব্যাট দিয়ে দুরে ঠেলে দিতে কিংবা হাতদিয়ে বল উঠিতে ফিল্ডার বা বলারের কাছে ফেরত পাঠাতে।
যেকোন আইনই করা হয় কোন কাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে, কোন চেতনাকে সমুন্নত রাখতে। যেখানে সুচেতনা কাজ করে না সেখানেই প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ। কিন্তু যেখানে চেতনা জাগ্রত সেখানে আইন অবশ্যই দ্বিতীয় বিবেচ্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।