কুন্তীবুড়িটা বহুত হতভাগি হলেও ভাবতে পারে নাই যে নিজের সবচে বড়ো দুর্ভাগ্যটা নিজেরই গর্ভে জন্ম দিছে সে...
কুরুসভায় কোনো সিদ্ধান্ত হয় নাই। যুধিষ্ঠিরের লগে আলোচনা কইরা সিদ্ধান্ত জানাইব কইয়া সিদ্ধান্তের লাইগা কৃষ্ণ এখন বইসা আছে কুন্তীর সামনে। কারণ কর্ণের বিপক্ষে পাণ্ডবদের সে যুদ্ধে জড়াবে কি না সেই সিদ্ধান্ত দিতে পারে একমাত্র কুন্তী....
অনেকক্ষণ ঝিম মাইরা মুখ খোলে কুন্তী- কৃষ্ণ; আমি তো কর্ণরে বাদ দিয়াই আমার সন্তান গণনা করি। এখন সে যদি না আইসা যোগ দেয় আমার পোলাগো লগে তবে কোনোদিনও তারে যোগ করব না আমি...
কৃষ্ণ যে উত্তর খুজতেছিল তা সে পায়। কিন্তু কুন্তী একটা শর্ত জুইড়া দিছে- যদি সে যোগ না দেয়...।
তার মানে কুন্তীর পোলাগো লগে কর্ণ যোগ দিব কি না তা দেখার দায়িত্ব কুন্তী কৃষ্ণরেই দিছে...
কুন্তীর ঘর থিকা বাইর হইয়া ভীষ্ম দ্রোণ বিদুরের কাছে বিদায় নিয়া কৃষ্ণ গিয়া হাজির হয় কর্ণের কাছে- তোমার লগে নিরালায় কিছু কথা আছে আমার....
কর্ণরে নিজের রথে তুইলা যাইতে যাইতে কৃষ্ণ কয়- তুমি খালি বড়ো যোদ্ধাই না; বুদ্ধিমানও বটে। তাই ভূমিকা বাদ দিয়া সরাসরি কই- আমি জানি যে তুমি জানো তুমি রাধার পালিত আর কুন্তীর গর্ভজাত সন্তান। সেই হিসাবে তুমি যুধিষ্ঠিরের বড়োভাই; আর আমারও পিসতুতো ভাই। ...আমি তোমারে যা কইতে চাই তা হইল; তুমি দুর্যোধনরে ছাইড়া পাণ্ডবপক্ষে আসো। পাণ্ডবগো লগে যোগ দিলে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে তুমিই হইবা রাজা; যেখানে যুধিষ্ঠির যুবরাজ হইয়া তোমার মাথায় পাখা দুলাইব।
ভীম অর্জুন নকুল সহদেব আর পাণ্ডবগো সকল পোলাপান যেমন তোমারেই কুর্নিশ করব তেমনি অন্ধক বৃষ্ণি পাঞ্চাল আর যাদবগো আনুগত্যও পাইবা তুমি। আর সবকিছুর উপরে; দ্রৌপদীরও একভাগ পাইবা তুমি অন্য ভাইদের লগে...
অতক্ষণ কর্ণ কোনো কথা না কইলেও এইবার হাসে- থামো কৃষ্ণ। লোভ দেখাইতে দেখাইতে একেবারে সীমা ছাড়াইয়া গেলা তুমি। কওতো; তুমি কেমনে আরেকজনরে দ্রৌপদীর ভাগ দেও? নাকি তুমিও দ্রৌপদীরে যুধিষ্ঠিরের মতো নিজের সম্পত্তি মনে করো যে ইচ্ছামতো তারে বাজিতেও যেমন ধরা যায় তেমনি যার তার কাছে দানও করা যায়?
কৃষ্ণ একটু থতমত খায়। আমতা আমতা করে- না মানে এককালে দ্রৌপদীর স্বয়ংবরায় তুমিও প্রার্থী হইয়া খাড়াইছিলা তো; তাই কইলাম আরকি...
- দ্রৌপদীর স্বয়ংবরায় তো তুমি নিজেও একজন প্রার্থী আছিলা কৃষ্ণ।
পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়া কি তবে তুমিও দ্রৌপদীর ভাগীদার এখন?
- না না না সেইটা কেন হবে? আমিতো পাণ্ডবগো লাইগা সেইদিনই প্রতিযোগিতা থাইকা নিজেরে প্রত্যাহার কইরা নিছিলাম। কিন্তু তুমি যেমন নিজেরে প্রত্যাহার করো নাই। তেমনি শুধু ক্ষত্রিয় পরিচয় না থাকার কারণে যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ ছাড়াই দ্রৌপদী তোমারে অপমান কইরা খেদাইয়া দিছিল সেদিন। তাই ভাবছিলাম দ্রৌপদীর প্রতি এখনো হয়তো তোমার অনুরাগ আছে...
- অনুরাগ না কৃষ্ণ। দ্রৌপদীর উপরে রাগ আছিল আমার।
সুযোগ পাইয়া কুরুসভায় সেই রাগ ঝাড়তেও দ্বিধা করি নাই আমি। কিন্তু সেই সভাতেই দ্রৌপদীর উপর শ্রদ্ধা তৈরি হইছে আমার; যা আমি সেইদিনের সভাতেই সকলের সামনে প্রকাশ্যে বলছি। কারণ এমন নারী কেউ আগে যেমন দেখে নাই; তেমনি কোনোদিন শোনেও নাই এমন নারীর কথা। যে নিজে নৌকা হয়ে দুর্দশার সাগরে ভাসা পাণ্ডদের দাসত্ব থাইকা উদ্ধার কইরা নিছিল সেদিন। তাই অনুরোধ করি; আমারে লোভ দেখাইতে গিয়া তারে আর অসম্মান কইরো না তুমি।
সে তোমারে খুব বড়ো বন্ধু হিসাবেই জানে...
কৃষ্ণ চুপ কইরা থাকে। কর্ণ কথা আগে বাড়ায়- দ্রৌপদীর স্বয়ংবরায় শূদ্র বইলা দ্রৌপদী আমারে যে অপমান করছিল সেইটার লাইগা কিন্তু দ্রৌপদী দায়ী না কৃষ্ণ। দায়ী তোমার পিসি কুন্তী। আমারে তো পরিচয়হীন শূদ্র দ্রৌপদী বানায় নাই; বানাইছে তোমার পিসি কুন্তী...
- সেই কুন্তীই এখন তোমার যথার্থ পরিচয়ে তোমারে প্রতিষ্ঠিত করতে চান কর্ণ
হা হা কইরা হাইসা উঠে কর্ণ- আমার কি এখন পরিচয়ের খামতি আছে যে তোমার পিসির কাছ থিকা আমারে পরিচয় ধার নিতে হইব?
কর্ণের প্রশ্নে কৃষ্ণ তার কথা বদলায়- না না না। তোমার পরিচয় খামতি থাকবে ক্যান? এই আর্যাবর্তে শিক্ষাদীক্ষা- বীরত্ব- রাজত্ব- বন্ধুত্ব- দানশলীতা এমন কোনো ক্ষেত্র নাই যেইখানে মানসে তোমারে এক নামে না চিনে।
আমি সেইটা কই নাই। আমি কইতেছিলাম কুন্তীর মাতৃত্ব আর পাণ্ডবগো লগে ভ্রাতৃত্বের পরিচয়ের কথা...
কর্ণ আবার হাসে- শূদ্র হইলেও মা বাবা কিংবা ভাইয়েরও কিন্তু কোনো অভাব কোনোদিন আমার হয় নাই কৃষ্ণ। শূদ্রাণী রাধা সেদিন যেমন বেওয়ারিশ শিশু কর্ণের মা ছিল; আইজ বিখ্যাত কর্ণের মাও শুধু রাধা। আমারে যে বুকের দুধ দিয়া- গু-মুত পরিষ্কার কইরা তিলে তিলে বড়ো কইরা তুলছে সেই রাধার বদলে অন্য কাউরে মা বলা আমার পক্ষে সম্ভব না কৃষ্ণ...
কৃষ্ণ মিন মিন করে- ভুল বুইঝো না। তোমারে মা বদলানোর কথা কই নাই আমি।
আমি কইতে চাইছিলাম যে; তুমি যদি আইজ কুন্তীপুত্র হিসাবে পরিচিত হও তবে যুধিষ্ঠির না; কুরুরাজ্যের অজেয় রাজা হইবা তুমি...
ঠা ঠা কইরা হাইসা উঠে কর্ণ- তোমারে আমি রাজা ধৃতরাষ্ট্র থাইকা বেশি বুদ্ধিমান মনে করতাম কৃষ্ণ। কিন্তু এখন দেখি বুদ্ধিতে ধৃতরাষ্ট্র আর তোমার মধ্যে তেমন কোনো ফারাক নাই। রাজা ধৃতরাষ্ট্র যেমন ঘুস দিয়া তোমারে তার পক্ষে নিবার ধান্দা করছিলেন। তেমনি তুমিও দেখি ঘুস দিয়া আমারে পক্ষে টানতে চাইতাছ...
- না না না। ঘুস না।
পাণ্ডবগো বড়ো ভাই হিসাবে তোমার ন্যায্য অধিকারের কথাই আমি তোমারে কইতে চাইতাছি কর্ণ...
- ন্যায্য অন্যায্য তোমাদের যেমন ইচ্ছা তোমরা তেমন হিসাব করতে পারো। কিন্তু মনে রাইখ তুমি যদি আইজ আমারে কুরুরাজ্য দানও করো; তবু সেই রাজ্য আইনা আমি আবার দুর্যোধনরেই দান কইরা দিমু...
কৃষ্ণ হা কইরা তাকাইয়া থাকে কর্ণের দিকে- কিন্তু কেন কর্ণ?
- কারণ আমার অসহায় কালে অধিরথ আর রাধা যেমন আমারে সহায় দিছিলেন; তেমনি আমার পরিচয়হীনতার কালে দুর্যোধনই আমারে দিছিল প্রথম ক্ষত্রিয় পরিচয়...
কৃষ্ণ উৎসাহী হয়ে উঠে- আমি তো সেই কথাই কই। দুর্যোধন তোমারে ক্ষত্রিয় পরিচয় দিছে। আর কুন্তীপুত্র হিসাবে তুমি হইবা ক্ষত্রিয় মহারাজ...
কর্ণ কৃষ্ণরে থামায়- তুমি ভালো কইরাই জানো রাজত্ব কিংবা ক্ষমতার লোভ আমার কোনোদিনও ছিল না। আমার শুধু লোভ ছিল শিক্ষার।
শূদ্রপুত্র বইলা যখন দ্রোণাচার্যসহ অন্য সকল গুরুই আমারে শিক্ষার্থী হিসাবে গ্রহণ করতে আপত্তি জানাইল তখন শুধুই শিক্ষার সুযোগ পাওয়ার লাইগা আমি নিজেরে ব্রাহ্মণ পরিচয় দিয়া ভর্তি হইছিলাম পরশুরামের গুরুকুলে। শুধু এই একটা ক্ষেত্রে আমি আমার পরিচয় গোপন করছি; এর বাইরে সব জায়গাতেই সব সময়ই কিন্তু গর্বভরে আমি অধিরথ সূতপুত্র রাধাগর্ভজাত কর্ণ হিসাবেই নিজের পরিচয় দিছি আর আইজও দেই। পরশুরামের কাছে শিক্ষা গ্রহণের পর আমার চাওয়া ছিল; আমার পরিচয় যেন আমার যোগ্যতা দিয়া হয়। অথচ সেইখানেও দেখলাম আমার অযোগ্যতা মাপা হইতে থাকল আমার বাপের শূদ্রত্ব দিয়া। তখন দুর্যোধন আমারে রাজা বানাইয়া আমারে সুযোগ দিলো আমার নিজের যোগ্যতা প্রমাণের...
কৃষ্ণ স্বীকার করে- সেইটা একটা ভালো কাজ করছে দুর্যোধন।
সে তোমারে রাজা বানাইছে দেইখাই তুমি তোমার যোগ্যতা প্রমাণ দিয়া আইজ মহাবীর এবং দানবীর কর্ণ হইছ। এখন তুমি আরেকধাপ আগাইয়া হইবা মহারাজা; সেইটাই বলতে চাই আমি...
হাত তুইলা কৃষ্ণরে থামায় কর্ণ- থামো কৃষ্ণ। রাজত্বের লোভ আর আমারে দেখাইও না তুমি। রাজত্ব আর ক্ষমতার লোভ যদি আমার থাকত তবে যুধিষ্ঠিরের ছাইড়া যাওয়া ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্যেরও রাজা হইতে পারতাম আমি। দুর্যোধন আমারেই সেই রাজ্যের রাজা হইবার অনুরোধ করছিল।
এর বাইরেও চাইলে আমি যে নিজেই রাজ্য জয় কইরা নিতে পারি তাও নিশ্চয়ই তুমি স্বীকার করো...
কৃষ্ণ কয়- ঠিকাছে। তুমি হস্তিনাপুরের সিংহাসন না নেও; কুন্তীরে মা নাইবা কও; পাণ্ডবগো ভাই না কও। কিন্তু যেহেতু জানো যে পাণ্ডবরা তোমারই ছোট তাই তোমারে অনুরোধ করি তোমার মায়ের পেটের ছোট ভাইগো লাইগা অন্তত যুদ্ধ থাইকা তুমি বিরত হও। তুমি যুদ্ধবিমুখ হইলে কোনোভাবেই পাণ্ডবগো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস পাইব না দুর্যোধন...
- ঠিক এই কারণেই যুদ্ধ থাইকা বিরত থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না কৃষ্ণ। আমার ভরসাতেই দুর্যোধন যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিছে; আমারেই দ্বৈরথে অর্জুনের প্রতিযোদ্ধা হিসাবে নির্বাচন কইরা রাখছে।
সারা দুনিয়া দিলেও দুর্যোধনের এই ভরসার লগে বিশ্বাসঘাতকতা করব না আমি। আমি প্রাণ ত্যাগ করতে পারি; কিন্তু দুর্যোধনকে না; অতক্ষণে কথাটা তোমার কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত কৃষ্ণ...
কৃষ্ণ এইবার প্রসঙ্গ পাল্টায়- ঠিকাছে। দুর্যোধনের পক্ষ ছাড়বা না তুমি। ঠিকাছে। কিন্তু পাণ্ডবগো লগে যুদ্ধ হইলে তার পরিণতি নিশ্চয়ই ভাইবা দেখছ তুমি?
কর্ণ হাসে- লোভ দেখাইয়া ব্যর্থ হইয়া এখন আমারে তুমি ভয় দেখাইতে শুরু করলা কৃষ্ণ? দুর্যোধনের দলে লোক বেশি হইলেও তার পক্ষের লোক আমি ছাড়া কেউ নাই সেইটা সকলেই জানে।
ভীষ্ম কৃপ দ্রোণ শল্য সবাই তার দলে যুদ্ধ করলেও বিজয় চাইব পাণ্ডবপক্ষের। আমি পরিষ্কার জানি আসন্ন যুদ্ধটা পাণ্ডবগো সাত বাহিনীর বিরুদ্ধে কৌরবদের এগারো বাহিনীর যুদ্ধ না; যুদ্ধটা মূলত হইব পাণ্ডবগো সাত বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্যোধন আর কর্ণ; মাত্র দুইটা মানুষের যুদ্ধ... যার ফলাফল যেকোনো শিশুও বইলা দিতে পারে...। হোক। তাই হোক। যুধিষ্ঠির বহু বছর ধইরা রাজা হইবার লাইগা কাঙাল হইয়া আছে।
যুদ্ধের পর সেই রাজা হউক। আমার কোনো আপত্তি নাই। আমার দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করার কথা; সৎভাবে আমি শুধু সেইটুকুই করব। একজন ক্ষত্রিয় হিসাবে যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রহাতেই যেন আমার মৃত্যু হয় সেইটাই আমার একমাত্র কামনা কৃষ্ণ। বন্ধুর লগে বেইমানি করে সারা জগতের রাজা হইতেও আমার কোনা আগ্রহ নাই।
... আরেকটা কথা। পাণ্ডবরা জানে কি না জানি না যে আমি তাগো বড়ো ভাই। তোমারে একটা অনুরোধ করি; কথাটা তাগোরে জানাইবার দরকার নাই। আমি না হয় জানলাম তারা আমার ভাই। তারা যেন আমারে শত্রু হিসাবেই জানে।
ভাই পরিচয়ে যুদ্ধের ময়দানে আমি কোনো সুবিধা কিংবা দয়া নিতে চাই না কারো...
হা কইরা অনেকক্ষণ কর্ণের দিকে তাকাইয়া থাইকা তারে জড়ায়ে ধরে কৃষ্ণ- কঠিন মানুষ তুমি। সারা পৃথিবী দিলেও তুমি যেমন নিতে চাও না তেমনি বিজয়ীও হতে চাও না তুমি। ঠিকাছে তয়; প্রত্যাশা করি অধিরথ এবং রাধার পুত্র আর দুর্যোধনের বন্ধু হিসাবেই যেন তুমি মৃত্যুবরণ করতে পারো...
কৃষ্ণ একটু থাইমা আবার শুরু করে- এখন সময়টা বেশ ভালো। বৃষ্টিও নাই; রাস্তাঘাটে কাদাও নাই। বেশি গরমও না; বেশি ঠান্ডাও না।
এই অগ্রহায়ণ মাসেই তবে যুদ্ধটা হোক। ফিরে গিয়া ভীষ্ম দ্রোণ আর কৃপাচার্যরে কইও যে সাতদিন পরে যেদিন অমাবস্যা সেইদিনই যুদ্ধের তারিখ ঠিক করছি আমরা দুইজন...
বিদুরের মুখে যুদ্ধের তারিখ শুইনা ছটফট করে কুন্তী। অমীমাংসিত কুরু সভার শেষে উপপ্লব্য নগরে গিয়া পাণ্ডবগো লগে আলোচনার পর কৃষ্ণ যে সিদ্ধান্ত জানাইবার কথা সেই সিদ্ধান্ত সে হস্তিনাপুরে কর্ণের লগে আলোচনার পরেই জানাইয়া দিছে। তার মানে মাতৃত্ব-ভ্রাতৃত্ব-রাজত্ব যেমন কর্ণরে পাণ্ডবপক্ষে টানতে পারে নাই তেমনি মৃত্যু ভয়েও সে ছাড়ে নাই দুর্যোধনের পক্ষপাত। যুদ্ধ হইব কুরু আর পাণ্ডবে।
কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তার পাঁচ পোলা বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধের সিদ্ধান্ত আর তারিখ ঠিক করে কি না তারই গর্ভজাত বড়ো ছেলে...
কর্ণের মৃত্যু নিয়া কুন্তীর বেশি মাথা ব্যথা নাই। কিন্তু পরশুরামে শিষ্য কর্ণের মৃত্যু ঘটানোর ক্ষমতা নিয়া বহুত দুশ্চিন্তা তার...
কর্ণের সাথে এখন আর তার অক্ষয় বর্মটা নাই। পায়েও কোনো জুতা পরে না সে। যুধিষ্ঠিরের পরিকল্পনামতে যুদ্ধের সময় শল্য কর্ণরে গালাগাল কইরা অস্থির রাখবেন। কিন্তু তারপরেও তীরে-বর্শায়-ভল্লে-কুড়ালে-তলোয়ারে-গদায় কর্ণের সামনে খাড়াইবার মতো একক কোনো যোদ্ধা পাণ্ডবপক্ষে নাই।
ভীম স্বল্প পাল্লার গদায় ভালো হইলেও তীর-বর্শার দূরত্বে সে অসহায়। অর্জুন তীরে দুর্ধর্ষ কিন্তু বর্শা ছোঁড়ার শক্তিতে সে যেমন কর্ণের থাইকা পিছে তেমনি স্বল্পপাল্লার অস্ত্রে সে নিতান্তই নিরুপায়। কৃষ্ণ অর্জুনের সারথি হইব তাই অর্জুনরে নিয়া দুশ্চিন্তা কম। কৃষ্ণের পরিকল্পনা আর কৌশলি রথ চালানোর ফাঁক দিয়া অর্জুনের শীরের নিশানা করা যেমন কর্ণের পক্ষে কঠিন হইব তেমনি কৃষ্ণ আর অর্জুন; দুইজনের দুইটা ঢাল ভেদ কইরা অর্জুনরে বিদ্ধ করাও হইব প্রায় অসম্ভব। কারণ যুদ্ধ না করলেও রথ চালাইবার সময় একইসাথে অস্ত্র আর একইসাথে ঢাল; তার সুবর্ণ চক্রখান সাথেই রাখব কৃষ্ণ।
...বর্মবিহীন খালিপায়ের কর্ণের পক্ষে শল্যের গালাগালি সহ্য কইরা কৃষ্ণের বুদ্ধি-ঘোড়া দাবড়ানি আর অর্জুন-কৃষ্ণের ঢাল অতিক্রম কইরা সফলকাম হওয়া বহুত কঠিন। কিন্তু বাকিরা? বাকি চাইর পাণ্ডব? তাগোরে তো সুরক্ষা দিব না কেউ...
ভীষ্ম যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন যুদ্ধ করব না কর্ণ। কিন্তু কুরুপাণ্ডব যুদ্ধে ভীষ্মের জীবনও আশঙ্কামুক্ত না। পাণ্ডবরা কেউ তারে হত্যা করব না সেইটা নিশ্চিত হইলেও তার নিজস্ব শত্রুর সংখ্যা বেশুমার। ছোটভাই বিচিত্রবীর্যের সাথে বিবাহ দিবার লাইগা কাশীরাজের তিন কন্যারে ছিনাইয়া আনছিলেন তিনি; ছোটো দুই বোন অম্বিকা অম্বালিকারে জোর কইরা ভাইয়ের লগে বিবাহ দিলেও তার কাণ্ডের কারণে বড়ো বোন অম্বা আত্মহত্যা করে।
কাশীরাজের বংশ সেই ক্ষতি এখনো ভুলতে পারে নাই। তারা আইসা যোগ দিছে পাণ্ডবপক্ষে; ভীষ্মের বিরুদ্ধে। ...ভীষ্মের ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ সংবরণ কাইড়া নিছিলেন পাঞ্চালগো দেশ; সেই থাইকা কুরুদের লগে পাঞ্চালগো বংশপরম্পরায় শত্রুতা। ...কুরুসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার সময় মুখ ফিরাইয়া বইসা ছিলেন কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম; সেই কারণে বইনের অপমানের শোধ হিসাবে পাঞ্চাল রাজপুত্র শিখণ্ডী প্রতিজ্ঞা করছে ভীষ্ম হত্যার। আর তার উপর দ্রৌপদীর যমজ ভাই পাঞ্চাল যুবরাজ ধৃষ্টদুম্নই হইল পাণ্ডবপক্ষের প্রধান সেনাপতি...
দেব্রবত ভীষ্ম এককালে ছিলেন অজেয় যোদ্ধা।
সেনাপতি হিসাবে অভিজ্ঞাতায় আর বুদ্ধিতে হয়তো এখনো তার জুড়ি নাই। কিন্তু শিখণ্ডীর মতো তরুণ শত্রুদের সাথে দ্বৈরথ যুদ্ধে নিজেরে আর কতটুকু রক্ষা করতে পারবেন এই শতবর্ষী লেতড় বৃদ্ধ মানুষ? আর ভীষ্মের মৃত্যু মানেই যুদ্ধক্ষেত্রে কুন্তীর সন্তানদের বিরুদ্ধে কুন্তীরই আরেক সন্তানের প্রবেশ...
ভাবতে ভাবতে অস্থির কুন্তীর হঠাৎ মনে হয়- কর্ণ পোলাটা খালি বড়ো যোদ্ধাই না; অনেক বেশি দয়ালুও বটে। কৃষ্ণের দেখানো লোভ আর ভয়ে যখন কাজ হয় নাই তখন তার পোলাগো ঢাল হিসাবে কর্ণের দয়ারেই ব্যবহার করবে কুন্তী...
প্রতিদিন ভোরে নদীতীরে সূর্যপূজা করা কর্ণের নিত্য অভ্যাস। গঙ্গার তীরে সূর্যোদয়ের নির্জন কালটাই কুন্তী বাইছা নেয় কর্ণের লগে দেখা করার সময় হিসাবে। কর্ণ তারে চিনে; তার পরিচয়ও জানে তবু পূজা শেষে তার নিজস্ব গম্ভীর অহংকার নিয়া নিজের পরিচয় দেয়- শূদ্র পিতা অধিরথ আর শূদ্রাণী রাধার সন্তান কর্ণ তোমারে প্রণাম করে গো অর্জুন জননী।
কিছু যদি চাওয়ার থাকে তবে নির্দ্বিধায় চাইতে পারো রাধেয় কর্ণের কাছে...
কুন্তী চিৎকার দিয়া উঠে- রাধেয় না বাপ। কৌন্তেয় তুই... তুই আমার কানীন সন্তান। পঞ্চপাণ্ডবের বড়ো ভাই...
কর্ণ হাসে- যখন তোমারে আমার দরকার ছিল তখন তুমি আমারে লুকাইয়া দূরে সরাইয়া দিছ। আর আইজ যখন আমারে তোমার দরকার তখন আবার লুকাইয়া আসছ আমারে কুড়াইয়া নিতে। অদ্ভুত মানুষ তুমি।
কিন্তু একটা বিষয় তোমার বোঝা দরকার; তোমারও যেমন পোলার অভাব নাই; তেমনি তুমি ফেলাইয়া দিলেও রাধার কারণে মাতৃত্বেরও অভাবও হয়নি আমার। তাই আইজ যখন রাধার সন্তানের সাথে কুন্তীর পোলাগো দ্বৈরথ নিশ্চিত তখন কর্ণ আর শত্রুমাতা কুন্তীর মাঝে নতুন সম্পর্ক পাতাইয়া জননী রাধারে কষ্ট দেওয়া যেমন অনুচিত; তেমনি অনুচিত বীর পাণ্ডবগো অপমান করা...
কুন্তী অনুনয় করে- সম্পর্ক নতুনও না। পাতানোও না। তোর সাথেই সবথিকা পুরানা মাতৃত্বের সম্পর্ক আমার...
- হ। আমার সাথেই সবথিকা পুরানা মাতৃত্বের সম্পর্ক তোমার।
আবার আমার সাথেই সবথিকা পুরানা অবিচারের সম্পর্কও তোমার...
কুন্তী অনেকক্ষণ চুপ কইরা থাইকা মুখ খোলে- তুই আমার কোনো যুক্তিই শুনবি না জানি। তবু তরে একটা জিনিস ভাইবা দেখতে অনুনয় করি। নিজের ভাইদের চিনার পরেও তুই ক্যান তোর ভাইদের শত্রু দুর্যোধনের পক্ষ নিবি?
- পক্ষ নিমু; কারণ তুমিই আমারে ঠেইলা দিছ দুর্যোধনের পক্ষে। তুমি আমার ক্ষত্রিয় পরিচয় ছিনাইয়া নিছিলা বইলাই আমারে দুর্যোধনের কাছ থিকা ক্ষত্রিয় পরিচয় ধার নিতে হইছে। সেই থাইকাই আমি দুর্যোধনের পক্ষে।
অথবা বলতে পারো তোমার পোলাদের বিপক্ষে...
- তুই তোর ভাইদের পক্ষে আয় বাপ। বড়োভাই হিসাবে তুইই হবি হস্তিনাপুরের রাজা...
কুন্তীরে থামায় কর্ণ- যতরকম লোভ আর ভয় দেখানো যায় সব তোমার ভাতিজা কৃষ্ণ দেখাইয়া গেছে গো অর্জুন জননী। অনুরোধ করি এই দুইটা জিনিস বাদ দিয়া যদি অন্য কিছু কইবার থাকে তয় কও...
- তুই একবার অন্তত আমারে মা বইলা স্বীকার কর বাপ
- তা হয় না। কারণ তাতে আমার রাধামায়ের অপমান হয়
- আমি তোর জন্মদাত্রী কর্ণ
- তাতে কিছু যায় আসে না আমার। কারণ নিজের ইচ্ছায় তুমি জন্ম দিয়া অদরকারি মনে কইরা যারে ফালাইয়া দিছ; তারে কুড়ায়ে এনে দিনের পর দিন লালন পালন করছে রাধা।
এখন শুধু জন্মদিবার কারণে তোমারে মা বইলা স্বীকার করলে রাধার দুধের সাথে বেইমানি হয়। ...আমি তোমারে মা ডাকতে অপারগ অর্জুন জননী...
কুন্তী অনেকক্ষণ ঝিম মাইরা থাইকা কয়- যোগ দিস না পাণ্ডবগো লগে। আমারে মা ডাকারও দরকার নাই। কিন্তু তারপরেও তোরে জিগাই- যুদ্ধ কইরা কি শান্তি হবে তোর? নিজের ভাইদের হত্যা কইরা কি শান্তি পাবি তুই?
- শান্তি হবে না। কে কারে হত্যা করবে তাও জানি না; হয় আমি পাণ্ডবদের অথবা তারা আমারে।
...কিন্তু তারপরেও যুদ্ধ হওয়া লাগবে। কারণ আইজ যদি আমি দুর্যোধনরে ছাইড়া যাই তবে আমার পরিচয় হবে ভিতু লোভী আর বেইমান। আমি মৃত্যু মাইনা নিতে প্রস্তুত; তবু সমস্ত দুনিয়ার বিনিময়েও লোভী কাপুরুষ কিংবা বেইমান পরিচয় না...
কুন্তী ভাইবা পায় না আর কী বলা যায়। বলে- দিবার সময়ে তোরে কিছুই দেই নাই আমি; স্বীকার করি। এখন দিতে চাইলেও তা দরকার নাই তোর।
তবু তোরে আমি জন্ম দিছি; সেই অধিকার থাইকা প্রার্থনা করি; তোর বীরত্বের মতো দয়ার সংবাদও সকলেই জানে। হতভাগি জন্মদাত্রীরে অন্তত একটা দয়া কর বাপ...
- অর্জুনের প্রাণভিক্ষা চাইও না শুধু। আসন্ন মহাযুদ্ধে অর্জুনের দ্বৈরথে আমার কোনো বিকল্প দুর্যোধনের হাতে নাই...
কুন্তী একটু ভাবে- ঠিকাছে। অর্জুন বিষয়ে তোরে কোনো অনুরোধ করব না। তবে দয়া কইরা তোর জন্মদাত্রীরে অন্তত এইটুকু কথা দে; যে তোর বাকি চাইর ভাইরে হত্যা করবি না তুই...
একটা নিঃশব্দ হাসি খেইলা যায় কর্ণের মুখে- আমারে জন্ম দিবার দায় নিতে চাও নাই তুমি; অথচ আইজ তুমি আমারেই দিতে চাও জন্ম নিবার দায়? ...আইচ্ছা নিলাম।
কথা দিলাম তোমার পাঁচ পোলার মধ্যে রাধেয় কর্ণের হাতে যুধিষ্ঠির ভীম নকুল আর সহদেবের কোনো মৃত্যুর আশঙ্কা নাই...
চোখ মুইছা কুন্তী ফিরে। পিছন থিকা ডাক দেয় কর্ণ- অর্জুন জননী। মরণপণ যুদ্ধ হবে শুধু কর্ণে আর অর্জুনে। যুদ্ধের পরে তোমার বাকি চাইর পোলার লগে বাইচা থাকব হয় অর্জুন না হয় কর্ণ। সেই হিসাবে সারা জীবন যে পাঁচ পোলা হিসাব করতা তুমি; যুদ্ধের পরেও কিন্তু তোমার পোলার সংখ্যা থাকব পাঁচ।
হয় কর্ণরে নিয়া পাঁচ; না হয় অর্জুনরে নিয়া পাঁচ। ...ছয় পোলা যখন জীবনেও গুনো নাই তখন বাকি জীবন না হয় আর নাই গুনলা পাণ্ডব মাতা...
পালকপিতা কুন্তীভোজের বাড়িতে কুমারী কুন্তীর হইবে সন্তান প্রসব। দাঁতে দাঁত চাইপা সেইদিন প্রসব চিৎকারটা সামলাইছিল যাদববংশজাত কুন্তী। আইজ অন্তত এক পোলার নিশ্চিত মৃত্যু আশঙ্কায় বৃদ্ধা কুন্তীর কণ্ঠ থাইকা বাইর হইয়া আসে তেষট্টি বছর আগেকার সেই বকেয়া প্রসব চিৎকার- কর্ণ...। কর্ণরে... বাজান আমার...
২০১২.১১.২৯ শুক্রবার
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী।
২। কুন্তী। পর্ব ৪
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী।
পর্ব ৮
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৭
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩।
দ্রৌপদী। পর্ব ৬
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৫ [ঘটোৎকচ ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী।
৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৪: ঘটোৎকচ ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী।
[পর্ব ৩: ঘটোৎকচ]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ২
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩।
দ্রৌপদী। পর্ব ১
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২।
কুন্তী [পর্ব ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ১]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ১। সত্যবতী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।