আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ১। সত্যবতী

মাহবুব লীলেন বাপে মরলে পোলায় রাজ্য পায়। বড়োপোলা আতুড় ল্যাংড়া আন্ধা লুলা হইলে ছোটপোলায় পায়। কিংবা বাপের ইচ্ছা হইলে অন্য পোলা কিংবা অন্য কারো পোলারে রাজ্য দিয়া যায়। তারপর সেই রাজায় লাঠি দাবড়াইয়া- এলাকাবাসীর চামড়া ছিলা খাজনাটাজনা আদায় করে স্বর্ণের মুকুট-সিংহাসন বানিয়ে রাজত্ব করে। কোনো রাজার হেডম থাকলে নিজের পোলা-শালা-ভাইভাতিজা নিয়া আশপাশের রাজ্য দখল করে মহারাজ হয়; না হলে অন্যের আক্রমণে নিজের ঘটিবাটি হারিয়েও জীবিত থাকলে বনে গিয়ে জটাজূটধারী সন্ন্যাসী হয়... রাজা শান্তনু পর্যন্ত মহাভারতে রাজনীতিবিহীন রাজাদের ইতিহাস এরকমই।

এক্কেবারে সরল সোজা। হাজারে হাজারে রাজা। মাঝে মাঝে মনে হয় বাড়ির বয়স্ক বুড়ারেও এরা কইত রাজা। কাঠুরের দলনেতাও সেখানে যেমন রাজা; গোষ্ঠীর বুড়াও তেমন রাজা; শিকারি দলের প্রধানও রাজা। আবার বহু ক্ষেমতাশালি ইন্দ্রও সেখানে একজন রাজা।

মহাভারতে রাজার কোনো সংজ্ঞাও নাই; মাপজোকও নাই। এক্কেবারে বর্তমান কালে বাংলাদেশের গ্রামের মতো। গ্রামেরও কোনো মাপজোক নাই; সংজ্ঞাও নাই। দুই ঘর মানুষ নিয়াও যেমন বাংলাদেশে গ্রাম আছে তেমনি লাখের উপর জনসংখ্যা আর আস্ত একটা উপজেলার সীমা নিয়া বাইন্যাচঙ্গও বাংলাদেশের একটা গ্রাম... মাঝেমাঝে মনে হয় সেইকালে গ্রামবুড়াদেরই অন্য নাম ছিল রাজা... তো জোয়ান পোলার বাপ বুইড়া রাজা শান্তনু পর্যন্ত মহাভারতের রাজারা ওইরকমই ছোটতে বড়োতে মিলামিশা রাজনীতি বিহীনই ছিল। তারপরেও ওইরকমই থাকার কথা ছিল; কেননা সকলেই জানত শান্তনু মরে গেলে জোয়ান শক্তিমান এবং বুদ্ধিমান একমাত্র পোলা দেবব্রতই হবে হস্তিনাপুরের রাজা।

শান্তনু নিজেও তা জানত তাই পোলারে যুবরাজ কইরা তার হাতে রাজ্যের বেশিরভাগ দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে বুড়াকালে সে প্রায় ধাম্মিক জীবন যাপন করে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াত। আর এই ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই সে মহাভারতের রাজাদের মধ্যে প্রথমবারের মতো পড়ে গেলো রাজনীতির মুখোমুখি... সেই বুড়া রাজা শান্তনুর তখন বৌ নাই। দেবব্রতের মা তার এই বৌয়ের নাম গঙ্গা। যারা তারে দেবী মানে তারা বলে দেবী গঙ্গা শান্তনুরে পোলা দিয়ে আবার ফিরা গেছে গাঙে... মানে সে থাকলেও শান্তনুর সংসারে নাই। সাদা চোখে মনে হয় তখন শান্তনুর বৌ মইরা গেছে গা অথবা এক্কেবারে বুড়া; হইলেও হইতে পারে গঙ্গা তখনও জীবিত; হয়ত সে শান্তনুর বাড়িতে একটা ঘরে থাকে কিংবা দূরে কোথাও নিজের বাপের বাড়িতে থাকে।

কারণ মহাভারতে পোলা দেবব্রতের বিপদে আপদে পরেও তারে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। যদিও শান্তনুর সাথে তারে আর কোনোকালে কোনো কথাবার্তা কইতে দেখছি বলে মনে হয় না আমার.... তো সেই বুড়িগঙ্গা কিংবা মরাগঙ্গার স্বামী রাজা শান্তনু একদিন হাঁটতে হাঁটতে যমুনার তীরে গিয়া আছাড় খাইয়া পড়ল তরতাজা মাইমলকন্যা সত্যবতীর সামনে। ওরে বাপরে বাপ; কী মাইয়া দেখল রে রাজা। যেমন তার তেজ তেমন তার ধার। বয়স আর রূপের কথা তো বলারই কারণ নাই কেননা সেই যে চিৎ হইয়া পড়ছিল রাজা; মণিমুক্তা মাখানো পোশাক কাদায় ছেড়াবেড়া তবু সে ভুইলা গেছে হামাগুড়ি দিয়া উঠবার কথা।

বুইড়া হাবড়া আর চিতপটাং হইলেও সে হস্তিনাপুরের রাজা আর যেহেতু তারই রাজ্যে বৈঠা ধইরা মাইনসেরে নদী পারাপার করে সেহেতু এই মাইয়া নিশ্চিত এক পাটনি কন্যা; মানে তার প্রজা ...মানে কাদাকুদা মেখেও রাজা তারে যে কোনো কিছু কইতে পারে... শরীরে আগুন জ্বইলা উঠলে কাদার মধ্য থেকে লাফ দিয়ে উঠে গলায় রাজকীয় গাম্ভির্য এনে রাজা শান্তনু তারে সরাসরি প্রস্তাব দিলো- শোনো কইন্যা। আমি রাজা শান্তনু। তোমারে বিয়া করবার চাই... একজন রাজা হইয়া মাইমলের মাইয়ারে এর থেকে ভালো করে বলার কোনো কারণ নাই। হোক সে বুড়া; তবু রাজায় তারে বিয়া করতে চায় এইটা শুনলে শুধু সে কেন; তার গুষ্ঠিসুদ্ধা খুশিতে বগবগা হইয়া ধন্যধন্য করার কথা। কিন্তু রাজা যেরাম ভাবছিল এই পাটনি সত্যবতী সেরাম মাইয়া না।

ন্যাড়া হইয়া সে একবার বেলতলায় গিয়া বহুত হ্যাপা সামলাইছে। তার যখন আরো বয়স কম; বুদ্ধিশুদ্ধিও অত বেশি নাই। তখন এরকমই আরেকজন তার ঘাটে আইসা পরিচয় দিছিল- শোনো কইন্যা আমি বশিষ্ঠ পরাশর... আমি তুমার লগে শুইবার চাই... জটাজূটধারী সেই লোক জাতে ব্রাহ্মণ। একহাতে লোটা অন্যহাতে ত্রিশূল; মুনি বশিষ্ঠের নাতি... এইরকম একখান দাবি করে বসছে; নমশূদ্র মাইমল গোষ্ঠীর উপর যা তার ধার্মিক অধিকার.... নৌকার সব লোক এই কথা শুনে থ মাইরা গেলো। আশেপাশেও তার গোষ্ঠীর বহুত লোক ছিল।

মাইয়া তাগোর সকলের দিকে তাকায়; কিন্তু নিরুপায় সকলেই যেন কিছুই শোনে নাই সেই ভান করে এদিক সেদিক হাঁটে। সত্যবতীর নৌকায় যারা উঠছিল নদী পার হইতে তারা ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া নৌকাতেই বইসা থাকে। নৌকার একদিকে নদী অন্যদিকে ব্রাহ্মণ পরাশর। তাদের যাইবার কোনো জায়গা নাই। আশেপাশে তাকাইয়া পরাশর বুঝে বাতাস তার অনুকূলে আছে।

সত্যবতীর নৌকার যাত্রীদের সে আদেশ করে নৌকা থেকে নেমে যেতে- আমি একাই যাত্রী হবো আজ... পাব্লিকের জানে পানি আসে। হুড়মুড় করে তারা নৌকা থেকে নেমে গেলে পরাশর উঠে সত্যবতীরে আদেশ করে- নৌকা ছাড়ো... হতভম্ব সত্যবতীর নৌকা যখন মাঝ নদীতে তখন পরাশর আদেশ করে- কাছে আইস কইন্যা। নৌকা ভাসুক গাঙে...। পাটনিবিহীন নৌকা ভাসে গাঙে আর পরাশর সাঁতরায় তরুণী পাটনি সত্যবতীর দেহে... তারপর দুইখান বাণী আর ভংচং আশীর্বাদ দিয়া পরাশর চইলা যায় কিন্তু সেইদিন মাঝ নদীতে গর্ভবতী হওয়া সত্যবতীরে লোকলজ্জার ভয়ে দূরের চরে গিয়া জন্ম দিয়া আসতে হয় এক পোলা... পরাশর তো গেছে। কিন্তু বিয়ার বাজারে সত্যবতীর দামও সে নামাইয়া দিয়া গেছে এক্কেবারে তলায়।

এক পোলার মায়েরে বুড়াধুড়া ছাড়া কোনো জোয়ান মানুষ বিয়া করতে চায় না। তাও যে দুয়েকজন চায় তারা কন্যাপণ দিতে এক্কেবারেই নারাজ... কারণ তারে বিয়া করলে তার আগের ঘরের পোলারেও খাওন পরন দেওন লাগব সেই স্বামীর... বুইড়াদের কামচক্ষু পড়া সে শিখেছে পরাশরকে দেখেই। শান্তনুর চোখেও তার শরীর। পার্থক্য শুধু এই ব্রাহ্মণরা কাম ছাড়ে হাটে মাঠে ঘাটে আর রাজারা কাম ফলায় মেয়েদের ঘরে নিয়ে গিয়ে। খারাপ না।

এক পোলার মায়েরে যেখানে কোনো জোয়ান মরদ বিয়া করতেই চায় না সেখানে রাজা শান্তনু খারাপ কীসে। বুইড়া হইলেও তো সে রাজা। পয়সা পাত্তির অভাব নাই। তার পোলার ভরণপোষণেও তার ঝামেলা থাকার কথা না। কিন্তু না।

এক বাক্যেই রাজি হওয়া ঠিক না। শান্তনু যখন বঁড়শি গিলছে তখন তারে নিয়া কিছু খেলতে সমস্যা কোথায়... সত্যবতীর শরীরে হুমড়ি খেয়ে পড়া হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনুর দিকে সত্যবতী চোখ তুলে চায়- রাজার বিয়ার প্রস্তাব কি হাটে মাঠে ঘাটে দেওয়া মানায়? বাড়িতে আমার বাপে আছে। সে আমার অভিভাবক। কইন্যার বিয়ার প্রস্তাব তার কাছে দেওয়া যেমন রাজার উপযুক্ত তেমনি কন্যাদানের অধিকারও একমাত্র তার... ঠিক কথা। ঠিক কথা।

মাইমলের মাইয়া হইলেও বুদ্ধিশুদ্ধি যেমন তার আছে তেমনি রাজার সম্মানও সে বোঝে ষোলো আনা। বাপের কাছেই গিয়া কন্যাপ্রার্থনা করা উপযুক্ত কাজ। প্রার্থনা একটা ফরমালিটি মাত্র। রাজায় তার মাইয়ারে চায় এইটা শুনলে দাসের বেটা সুড়সুড় করেই মেয়েরে পাঠিয়ে দেবে হস্তিনাপুরে শান্তনুর হেরেমে। কিন্তু শান্তনু সত্যবতীর বাপের কাছে যাবার আগেই নিজের বাপেরে সে সকল বিত্তান্ত বুঝিয়ে ফেলে।

কিছুক্ষণ পরে মাইমল পাড়ায় এসে রাজা যখন সত্যবতীর বাপেরে বললেন- শোনো মাইমল; তোমার মাইয়ারে আমি বিয়া করতে চাই। তখন জোড়হাত করে মাইমল হাসে- মহারাজ। আপনার তো একখান জোয়ান পোলা আছে। সে যদি ঝামেলা করে? আপনের সাথে মাইয়ার বিবাহ সাত জন্মের সৌভাগ্য আমার। কিন্তু কেমনে বলেন বাপ হয়ে নিজের মাইয়ারে এমন ঝামেলার ঘরে পাঠাই? ধুশশালা বলে এখান থেকে যেমন চইলা আসা যায়; তেমনি চুলের মুঠায় ধইরা সত্যবতীরেও নিয়া আসা যায়।

কিন্তু সত্যবতীর রূপে শইল যেমন উচাটন হইছে তেমনি মান সম্মান বইলাও একখান কথা আছে। মাইমল বেটারে পাত্তা না দিলেও নিজের জোয়ান পোলার ভাবসাব একবার যাচাই করা দরকার। পোলায় যদি সৎমা মাইনা না লয় তবে সত্যিই তো ঝামেলার কথা... মাইমলের কথা শুনে বাড়ি গিয়া শান্তনু নিজের পোলার সামনে আনচান করে। পোলায় জিগায়- কী হইল বাপ? আবার কেউ তোমার রাজ্য হরণের হুমকি দিছে নাকি? বাপে কয়- নারে বাপ; তুই যে দেশের যুবরাজ সেই দেশেরে হুমকি দিবার সাহস কার আছে বল? পোলায় জিগায়- তবে কেন মন বেচইন বাজান? বাপে কয়- মনটা বড়োই বেচইন ভিন্ন কারণে বাপধন। আমি বুড়া মানুষ; সংসারে একা একা থাকি।

কেমনে কী করি বল? তোর মতো বয়স থাকলে যুদ্ধটুদ্ধ কিংবা অস্ত্র অনুশীলন কইরাও সময় কাটাইতে পারতাম। কিন্তু... বুঝিসই তো বাপ; বাপে তোর একলা একটা বুড়া মানুষ... তাছাড়া তুই একটাই মাত্র পোলা আমার। শাস্ত্রে কয় এক পোলা থাকা আর পোলাহীন থাকা পিরায় সমান... বড়োই চিন্তিত আছি রে বাপ; যদি তোর কিছু হইয়া যায় তো আমার পিণ্ডি দিবারও থাকব না কেউ... বুদ্ধিমান পোলায় বোঝে বাপের গতর টাডাইছে তাই বিয়া করতে চায়। কাউরে দেইখা নিশ্চয় বুড়ার রক্ত উচাটন। ...পোলায় আর বাপেরে কিছু কয় না।

বাপের সঙ্গী সাথিদের গিয়া জিগায়- কারে দেইখা আমার বাপে উতলা হইছে কন তো দেখি? বাপের সঙ্গীসাথিদের কাছ থিকা সত্যবতীর নামধাম শুনে পোলায় ভাবে অসুবিধা কী? করুক না বিয়া। বুইড়া মানুষ মরবার আগে একটু রং তামাশা করতে চায় করুক না... পোলায় নিজেই দায়িত্ব নেয় বাপের বিয়ার ঘটকালির। বাপেরে নিশ্চিন্ত করে সে মিত্র অমাত্য নিয়া মাইমলের উঠানে দাঁড়ায়- শোনো মাইমল। আমার পিতা হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু তোমার মাইয়ারে বিবাহ করতে ইচ্ছুক। আমি তার প্রস্তাব নিয়া আসছি তোমার কাছে... দেবব্রতের এই প্রস্তাবেও মাইমল হাসে- শোনো যুবরাজ।

নিঃসন্দেহে রাজরানি হইবার এই প্রস্তাব আমার মাইয়া আর আমার গোষ্ঠীর জন্য মহা সৌভাগ্য আর সম্মানের বিষয়। কিন্তু তোমার বাপের সাথে যদি আমার মাইয়ার বিবাহও হয়; তবু আমার নাতিপুতিরা কেউই রাজা হতে পারব না। কেননা বড়ো পোলা হিসাবে তোমার পিতার পরে তোমারই রাজা হইবার কথা। তুমিই বলো; বাপ হইয়া কেমনে আমি নিজের কইন্যার এমন অধস্তন ভবিষ্যৎ মাইনা লইতে পারি? দেবব্রত পড়ে মহা ফাপড়ে। বাপেরে বইলা আসছে সত্যবতীর লগে তার বিয়া করাইয়া দিবে।

পাত্র অমাত্যদেরও ভড়ং দেখাইয়া কইছে- বুইড়া বাপের লাইগা আমার এইটুকু করা উচিত; তাই আমি নিজেই যামু বাপের বিয়ার ঘটক হইয়া। কিন্তু এখন যদি তার কারণেই বাপের বিয়া ভাইঙ্গা যায় তয় মুখ দেখাইব কেমনে? সে মাইমলের হাত ধইরা কয়- আমি তোমারে কথা দিতাছি ভবিষ্যৎ নানা। যদিও আমি যুবরাজ এবং বাপের পরে রাজা হইবার দাবিদার। তবু আমি সকলেরে সাক্ষী রেখে স্বেচ্ছায় সেই রাজত্বের দাবি ছাইড়া দিলাম। তোমার মাইয়ার গর্ভে আমার যে ভাইয়েরা হবে; তারাই রাজা হবে আমার পিতার পরে... এইবার তুমি রাজি হও... মাছেরে নিয়া কারবার যে মাইমলের; সে ঠিকই বোঝে মাছে টোপ গিললেই সাথে সাথে বঁড়শিতে টান দিতে নাই।

টোপ গিলার পরেও কোন সময় টান দিলে মাছের বঁড়শি ছিড়া চলে যাবার সম্ভাবনা আছে আর কোন সময় টান দিলে বঁড়শিটা গিয়া মাছের মাংসে গাঁথবে তা মাইমলই জানে সবার থেকে বেশি। সে বলে- অতীব খুশির কথা যুবরাজ। নিজের পিতার একটা খায়েশ পূরণের লাইগা রাজত্ব ছাইড়া দিবার প্রতিজ্ঞার মতো তোমার যে ত্যাগ তা ইতিহাসে স্মরণীয় থাকব এই আমি বইলা দিতে পারি। কিন্তু তুমি একটা জোয়ান পোলা... সামনে বিয়াশাদি করবা। তোমারও পোলাপান হইব; কিন্তু কে কইতে পারে সকল পোলরাই বাপের মতো ত্যাগী আর উদার হয়? তুমি এক মহান মানুষ।

তুমি রাজত্বের দাবি ছাইড়া দিলেও তোমার ভবিষ্যৎ পোলাপান তা মানব কেন? তারা যদি ভাবে রাজত্ব তাদের পৈতৃক উত্তরাধিকার আর সেইজন্য আমার ভবিষ্যৎ নাতিগো লগে তোমার ভবিষ্যৎ পোলাপান কাইজা বাধায়? সেইটাওতো একখান চিন্তার বিষয়; নাকি কও? কী কুক্ষণে যে বাপেরে কথা দিয়া তার বিয়ার ঘটকালি করতে আসছিল দেবব্রত এইবার মনে মনে ভাবে। বাপের সঙ্গীসাথি অমাত্যরা তার দিকেই তাকিয়ে আছে; কারো কিছু কওয়ার নাই। হীরামণি মাণিক্য কিংবা কন্যাপণ নিয়া আলোচনা হলে অমাত্যরা কিছু বলতে পারে। কিন্তু হালার মাইমল যা কয় সব কিছু যুবরাজরে নিয়াই কয়। এইসব কথার উত্তর তো যুবরাজ ছাড়া তার বাপেরও দিবার সাধ্য নাই... যুবরাজ দেবব্রত পড়ে মাইনকার চিপায়।

সক্কলের চোখে সে দেখে একটাই ভাষা- বাপধন। বাপের বিয়াটা যদি হয়; তবে একমাত্র তুমিই তা করায়া দিতে পারো। আর যদি না হয় তবে সেইটাও একমাত্র তোমার লাইগা ভাইঙ্গা যাইতে পারে... এইবার দেখো বাপধন... কী করবা না করবা সব তুমিই বুইঝা লও... নাহ। দায়িত্ব নিয়া আইসা পিছানোর থাইকা মইরা যাওন ভালো। সব দিক ভাইবা চিন্তিয়া দেবব্রত আগাইয়া যায় মাইমলের দিকে- আমি গঙ্গাপুত্র দেবব্রত।

তোমার গোষ্ঠীগাড়া এবং আমার বাপের এই সঙ্গীসাথি অমাত্যদের সামনে প্রতিজ্ঞা করতাছি যে বাপের খায়েশ পূরণ আর তোমার আশঙ্কা দূর করার লাইগা আমি সারাজীবন ব্রহ্মচারী হইয়াই থাকমু। জীবনেও বিয়াশাদি করব না। আর যদি বিয়াশাদি না করলে আমার যেহেতু পোলাপান হইবারও কোনো সম্ভাবনা নাই; সেহেতু তাগোর লগে তোমার ভবিষ্যৎ নাতিপুতির মারামারি কাইজারও কোনো আশঙ্কা নাই। এইবার তুমি রাজি? - হ রাজি... ভীষণ কঠিন প্রতিজ্ঞা করার লাইগা দেবব্রতরে সক্কলে ভীষ্ম খেতাব দিয়া ধন্যধন্য করে আর যোগ্য বড়ো পোলা থাকতেও ভবিষ্যতে নিজের গর্ভজাত পোলাপানের রাজত্ব আর বড়োপোলারে নির্বংশ রাখার সিস্টেম করে সত্যবতী রাজনীতিরে লইয়া আসে শান্তনুর ঘরে... ব্যাপার খানা বিশাল দারুণ। বাপের আশ্রমে বিদ্যাশিক্ষা কইরা মাইমল কন্যার বড়ো পোলায় হইছে ব্রাহ্মণ।

এই ছুডুকালেই জ্ঞানগম্যির লাইগা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন কইয়া তার বেশ নামডাক। পরের ঘরে আরেক পোলা যদি রাজা হয় তবে বেশ দারুণই হইব কইতে হয়... সত্যবতীর গর্ভে দুইখান পোলা জন্ম দিয়া রাজা শান্তনু মইরা গেলে নিজের প্রতিজ্ঞা স্মরণ কইরা দেবব্রত সত্যবতীর বড়ো পোলা চিত্রাঙ্গদরে বসাইল ক্ষমতায়। কিন্তু কী সব যুদ্ধমুদ্দ করতে গিয়া বিয়াশাদির আগেই চিত্রাঙ্গদ মইরা গেলে সত্যবতীর ছোটপোলা নাবালক বিচিত্রবীর্যই হইল রাজা... সতিনের পোলা ভীষ্ম থাকল উপদেষ্টা আর অভিভাবক... সেই পোলা বড়ো হইলে বাপের ঘটকালিতে অভিজ্ঞ ভীষ্ম ছোট ভাইয়েরও একসাথে দুইখান বিবাহ করাইয়া দিলো। কিন্তু সত্যবতীর কপাল খারাপ। দুই পোলাই রাজা হইল কিন্তু রাজত্ব করতে পারল না কেউ।

বড়োটা লড়াই করতে গিয়া মরল বিয়াশাদির আগে আর ছোটটা বিয়াশাদি করলেও দুইটা বৌ রাইখা যক্ষ্মায় মইরা গেলো পোলাপান জন্ম দিবার আগে... সত্যবতী পড়ল ঝামেলায়। নিজে রাণী হইল; তার বুদ্ধিতে বড়ো ভাইরে বাদ দিয়া ছোট ভাইরা রাজাও হইল তার কিন্তু এখন তো তার আর কোনো পোলাও নাই; নাতিপুতিও নাই। এখন তো সেই ভীষ্মই শান্তনুর একমাত্র উত্তরাধিকার... সিংহাসন ছাইড়া দিলেও রাজার একমাত্র বংশধর। নিয়মমতো ভাইয়ের বিধবাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের দায়িত্ব আর অধিকার তারই... কিন্তু... ভীষ্মতো প্রতিজ্ঞা করেছেন সন্তান জন্ম না দেবার... তার পরেও তারে একবার জিজ্ঞেস করা উচিত... সত্যবতী যাইয়া ভীষ্মরে জিগায়... ভীষ্ম নিজের ব্রহ্মচারীত্বের প্রতিজ্ঞা মনে করে বিধবাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য কোনো ব্রাহ্মণকে ভাড়া করার কথা বলে। কিন্তু নিজের আরেক পুত্র থাকতে সত্যবতী ব্রাহ্মণ ভাড়া করতে যাবে কোন দুঃখে? সে তার বিবাহপূর্ব কানীন সন্তান দ্বৈপায়নকেই ডাকে... দ্বৈপায়নের ঔরসে ছোট ভাইয়ের দুই বিধবার গর্ভে জন্ম নেয় দুইটা পোলা।

শান্তনুর রাজত্ব পোলাদের পরে আবারও থাকে সত্যবতীর নাতিদের হাতে... ভীষ্মরে নিয়া সত্যবতীর আর কোনো চিন্তা নাই। ভাতিজারা বড়ো হইলে তারাই রাজা হইব। বড়োটা আন্ধা বইলা ক্ষমতা পাইব না; ছোট পাণ্ডুই হইব পরের রাজা... বড়ো ভাতিজার বিয়ার ঘটকালিও ভীষ্ম করে। নিজে বিয়া শাদি না করলেও বাপ ভাই ভাতিজা সকলের বিয়ার ঘটক ভীষ্ম নিজে। শান্তনু বংশে নিজের বিয়া নিজে নিজে করার নিয়ম নাই।

শান্তনুর প্রথম বৌ গঙ্গারে পোলার লাইগা পাত্রী ঠিক করছিল তার বাপ প্রতীপ। সত্যবতীর সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ের সব কিছুই তো কইরা দিলো পোলায়। ভাইয়ের লাইগাও পাত্রী আইনা দিলো ভীষ্ম। ভাতিজা ধৃতরাষ্ট্রের লাইগাও পাত্রী জোগাড় করল সে। কিন্তু পাণ্ডুটা ঝামেলা বাধাইল।

কাউরে কিছু না কইয়া নিজে নিজে স্বয়ংবরায় গিয়া কুন্তীরে আইনা তুলল ঘরে। ভীষ্ম ভালোই ক্ষেপছিল। কিন্তু ভাতিজায় বিয়া কইরা ফালাইছে; এইখানে তো আর কিছু কইবার নাই। এখন তো আর গিয়া কইতে পারে না যে আমি থাকতে তুমি নিজের পছন্দে বিয়া করলা ক্যান? মনে মনে সে ক্ষেপলেও কিছু কয় না। কিন্তু কিছুদিন পরে ভীষ্ম পয়সা দিয়া মাদ্রীরে কিনা আইনা পাণ্ডুরে কইল- তোর পয়লা বৌয়ের গর্ভে কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয় না।

তাই বংশ রক্ষার জন্য তোর দ্বিতীয় বিবাহের আয়োজন করছি আমি। এরে তুই বিয়া কর। যদিও তখনো ভীষ্মের ঘটকালিতে বহুদিন আগে বিয়া করা ধৃতরাষ্ট্রের বৌ গান্ধারীর গর্ভেও কোনো বাচ্চাকাচ্চা নাই। কিন্তু ভীষ্ম পাত্রী নিয়া হাজির... কে তার সাথে তক্ক করে? দাদি সত্যবতী কিংবা মা অম্বালিকাও এতে কোনো দোষ দেখেন না। যেহেতু বড়োভাই আন্ধা তাই পাণ্ডুই শান্তনু বংশের রাজা; সেহেতু রাজার একাধিক বৌ থাকা দোষের কিছু না... পাণ্ডুর বৌ কুন্তীরও বেশি কিছু বলবার নাই।

নিজে সে রাজকন্যা না। রাজার পালিত কন্যা সে। তার বাপ চাষাভুসা শূর ছোটকালেই তারে দান কইরা দিছিল নিঃসন্তান রাজা কুন্তীভোজের কাছে। তাই রাজার মেয়ে না হয়েও সে রাজকন্যার মতো স্বয়ংবরা করে রাজা পাণ্ডুরে বিয়া করছে পছন্দ কইরা। পাণ্ডুর সন্তান হয় না বইলা সকলে তারে দুষলেও সে জানে সন্তান জন্মদানে তার কোনো সমস্যা নাই।

কারণ বিয়ার আগেই তার একটা পোলা হইছে। দাদি সত্যবতীরও বিয়ার আগের পোলা ছিল কিন্তু তা ছিল প্রকাশ্য। কিন্তু কুন্তী নিজে কিছু দুই নম্বরী করছে এই ক্ষেত্রে। পোলার মা হইয়াও পোলার কথা লুকাইয়া কুমারী হিসাবেই সে স্বয়ংবরা করছে। এখন বেশি কচলাইতে গেলে মিথ্যা কুমারী সাইজা রাজা পাণ্ডুরে বিয়া করার অপরাধে ভীষ্ম তারে কাইট্টাও ফালাইতে পারে।

এতে আমও যাবে ছালাও যাবে। তার চেয়ে থাক। পাণ্ডু না হয় বিয়াই করুক আরেকখান। সামলাইয়া চলতে পারলে এইটা কোনো সমস্যা না... পাণ্ডু দুই বিয়া কইরাও পোলাপান পায় না। বহুদিন আগে বিয়া কইরাও পোলাপান হয় না ধৃতরাষ্ট্রের।

ধৃত রাষ্ট্রেরে নিয়া কারো তেমন কোনো মাথাব্যাথা নাই। কারণ সে রাজা না। একান্ত যদি পাণ্ডু নিঃসন্তান না হয় তবে ধৃতরাষ্ট্রের পোলাপানও রাজা হইবার তেমন দাবিদার হইব না। দাদি সত্যবতীর সন্দেহ হয় পোলাপান জন্ম দিবার ক্ষেত্রে তার নাতির ক্ষেমতায়। তিনি সরাসরি গিয়া নাতবৌ কুন্তীরে ধরেন- পোলাপান না থাকলে রাজবাড়িতে রাণীর মর্যাদা প্রায় দাসীগো সমান হয় এইটা বোঝো না তুমি? নাতি আমার রাজা।

নাতিবৌর গর্ভে যে জন্মাবে সেই হবে নাতির পরে রাজত্বের দাবিদার। নাতির আমার সমস্যা থাকতেই পারে। কিন্তু তোমার তো সমস্যা থাকার কথা না নাতির পরে যে রাজা হবে তারে জন্ম দিতে? নাতি কিন্তু আমার আরেকটা আছে। বিদুর। দাসীর গর্ভে জন্ম নিলেও কিন্তু সেও আমার পুত্র দ্বৈপায়নের বংশধর।

দেবর হিসাবে তার সাথে তোমার সম্পর্কও তো জানি খুব হাসিখুশি। প্রয়োজন পড়লে তুমি তারও সাহায্য নিতে পারো। কথাটা কি বুঝাইতে পারছি আমি? - হ দাদি। পুরাপুরিই বুঝাইতে পারছেন যা বুঝাইবার চান... ২০১২.১১.০৯ শুক্রবার ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।