টানা তিন বছর ধরে ধান বিক্রি করে লোকসান গুনেছেন কৃষক। কিন্তু এবার আমন ধানের দাম বাড়ায় কৃষকের মুখে কিছুটা হলেও হাসির রেখা ফুটে উঠছিল। দুই দিন বিরতি দিয়ে টানা ১০ দিনের অবরোধে কৃষকের মুখে আবারও দুশ্চিন্তার ছায়া। আবারও গতকাল শনিবার থেকে শুরু হয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি।
দেশে সারা বছরে যে ফসল হয়, তার প্রায় ৭০ শতাংশ উৎপাদিত হয় নভেম্বর থেকে মার্চে, এই পাঁচ মাসে।
মাঠে বোরোর বীজতলা প্রস্তুত, গম ও আলুর চারা রোপণ শুরু হয়েছে। চলছে ভুট্টা ও সরিষা চাষের কার্যক্রমও। সেচ ও সারের এখনই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়। কিন্তু অবরোধ কৃষকের কাছে তেল, বীজ ও সার পৌঁছাতে দিচ্ছে না।
এই সময়টাকে বোরো ও রবি ফসল উৎপাদনের সবচেয়ে বড় মৌসুম হিসেবে উল্লেখ করেছেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ মাহবুব হোসেন।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই সময়ে যদি কৃষক উৎপাদনে বাধা পান, তাহলে তার নেতিবাচক ফল সারা বছর ভোগ করতে হবে। এটি সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও খাদ্যনিরাপত্তায় সংকট তৈরি করবে। তিনি বলেন, খাদ্যশস্য ও কৃষি-উপকরণ সরবরাহের বিষয়টি অবরোধের আওতার বাইরে রাখা উচিত।
নয়টি জেলা ও ছয়টি উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সপ্তাহে প্রতি মণ ধানের দাম ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। সবজি বিক্রি করে উৎপাদন খরচ উঠছে না।
মাঠে মাঠে শীতের সবজি গড়াচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে। মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় তা ভোক্তাদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারছে না।
আবার শহরে যাঁরা চাল ও সবজি কিনে খান, তাঁদের খরচও বেড়ে যাচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক মাসে চালের দাম ৪ থেকে ৯ শতাংশ বেড়েছে। পেঁয়াজ, মুরগি, ডাল, ভোজ্যতেল, সবজি, আদা, রসুনসহ বেশির ভাগ খাদ্যপণ্যের দাম ৪ থেকে ২৪ শতাংশ বেড়েছে।
বিপদের এখানেই শেষ নয়। কৃষক টাকা নিয়ে সার ও বীজের জন্য ডিলার এবং ডিজেলের দোকানে দোকানে ঘুরছেন। কিন্তু নির্ধারিত দামে তা পাচ্ছেন না। বাড়তি দাম দিয়ে ওই কৃষি-উপকরণ পাওয়া গেলেও তা দিয়ে প্রয়োজন মিটছে না।
টানা অবরোধের ফলে চট্টগ্রাম বন্দর, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী, দিনাজপুরের পার্বতীপুরের ডিপো থেকে ডিজেল সরবরাহ প্রায় বন্ধ রয়েছে।
দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় এ সময়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ডিজেলের দরকার হয়। বাঘাবাড়ী ডিপো থেকে ডিসেম্বরে মাসে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ থেকে ৪০ লাখ লিটার ডিজেল সরবরাহ করা হয়। অবরোধের দিনগুলোতে এক লিটারও সরবরাহ করা হয়নি। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার ৭৫ লাখ লিটার তেল সরবরাহ করা হয়েছে।
দেশের নয়টি জেলা থেকে প্রথম আলোর প্রতিবেদকদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী সার, প্রতি বস্তা ইউরিয়া সারের নির্ধারিত মূল্য ৮০০ টাকা হলেও ডিলাররা তা ৯০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি করছেন।
এক হাজার ১০০ টাকা দামের ট্রিপল সুপার ফসফেট বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৩০০ টাকায়। ৭০০ টাকার পটাশ সার দাম ৯০০ টাকা।
দেশের উত্তরাঞ্চলে ডিসেম্বরে ১৬টি জেলার জন্য প্রয়োজনীয় ৬০ হাজার টন সার সরবরাহ হয় বাঘাবাড়ী ঘাট দিয়ে। এই ঘাটে বর্তমানে ৫০ হাজার টন সার খালাসের অপেক্ষায় পড়ে আছে। অথচ গত বছর একই সময়ে ওই সারের ৯০ শতাংশই উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার ডিলারদের কাছে পৌঁছানো হয়েছিল।
বোরো চাষের জন্য প্রয়োজনীয় এক লাখ ২০ হাজার টন বীজের ৬০ শতাংশ বিএডিসি ও বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো সরবরাহ করে থাকে। সরবরাহ-সংকটের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে বীজের অভাব দেখা দিয়েছে। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি বীজ ১০ থেকে ২০ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। তাও সব কৃষক পাচ্ছেন না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার ফারুক জানান, জেলা পর্যায়ে বীজের যথেষ্ট মজুত থাকলেও অবরোধের কারণে অর্ধেকের বেশি উপজেলায় সময়মতো বীজ পৌঁছানো যাচ্ছে না।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে এক লাখ ৬০ হাজার টন চাল ও গম সরবরাহ করার পরিকল্পনা ছিল খাদ্য বিভাগের। খাদ্য বিভাগের মহাপরিচালক আহমদ হোসেন খান বলেন, ‘অবরোধের ফলে খাদ্য সংগ্রহ ও বণ্টনের ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হলেও স্থানীয় গুদামগুলোর মজুত দিয়ে আমরা প্রয়োজন মেটাচ্ছি। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।