তিন দিনে ২০টির বেশি বৈঠকে টানা আলোচনার পর প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে কিছুটা ছাড় দিয়ে সংলাপে বসার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের আওতার মধ্যে থেকে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কিছুটা খর্ব করে সমঝোতায় পৌঁছানোর বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন তিনি।
আওয়ামী লীগ বরাবরের মতো আলোচনার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারানকোর উপস্থিতিতে এই আলোচনা শুরু করারও প্রস্তাব ছিল দলটির। তবে তারা শেখ হাসিনাকেই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী রাখার অবস্থানে অনড় আছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে রেখে কোনো সমঝোতা সম্ভব নয়। এর বাইরে আলোচনা হলে তারা অংশ নেবে। আলোচনায় যুক্ত দুই দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তারানকো বলেন, ‘চলমান অচলাবস্থার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি। রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা থাকলে, তাঁদের মাঝে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকলে এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনায় বসার আগ্রহ থাকলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
’
দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, তারানকো সংবিধানের আওতার মধ্যেই সংকট নিরসনে দুই দলকে আলোচনায় বসার পরামর্শ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি দুই পক্ষে আলোচনা শুরুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কিছুটা কমিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনকে কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনার কথা বলেন।
গতকাল বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা গওহর রিজভীর গুলশানের বাসভবনে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গেও দ্বিতীয় দফা বৈঠক করেন তারানকো। ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতারা ২৪ জানুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দেন। তাঁরা সংসদ ভেঙে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বিপক্ষে তাঁদের যুক্তি তুলে ধরেন।
তারানকো সংবিধানের মধ্যে নির্বাচনের যুক্তি সমর্থন করলেও দুই দলের সমান সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব করেন। তিনি এ বিষয়ে দুই দলের মধ্যে সংলাপের প্রস্তাব দেন।
বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলীয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, গওহর রিজভী, মাহবুব উল আলম হানিফ ও ফারুক খান।
খালেদা-তারানকো বৈঠক: বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবরই শেখ হাসিনাকে সরকারপ্রধান না রাখার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে তারানকোকে বলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, তারানকো বিএনপিকে জানিয়েছে, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে সমাধান করার কোনো পন্থা থাকলে তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে বলে আওয়ামী লীগ জানিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারানকো নির্বাচনের সময় জাতিসংঘের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও ‘স্বল্প-ক্ষমতার’ প্রধানমন্ত্রীর কথা বলেন।
নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকলে সমঝোতা সম্ভব নয়। সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনাকে সরে যেতে হবে বলে তারানকোকে জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।
গতকাল সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারানকোর দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয়।
বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও সাবিহ উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির দুজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, তারানকোর সফরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে—এখন পর্যন্ত এটা বলা যাবে না। তাঁরা মনে করছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তারানকোর এই সফরে সমাধান আসবে না। তবে বিএনপি তারানকোকে আশ্বস্ত করেছে, তারা আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে।
বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে তারানকো প্রস্তাব তুললে খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করা যায় না।
তাঁর ক্ষমতা সংবিধানে দেওয়া আছে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী পদের গুরুত্ব কখনো কমানো সম্ভব না। তাই যিনি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, তাঁকে অ-গুরুত্বপূর্ণ বা ক্ষমতাহীন করা বাস্তবসম্মত নয়।
বৈঠক শেষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আমাদের বিষয়গুলো তুলে ধরেছি। আলোচনা অব্যাহত আছে।
এ মুহূর্তে বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না। ’
এর আগে দুপুরে গুলশানে শমসের মবিনের সঙ্গে তারানকোর একান্তে বৈঠক হয়।
জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক: তারানকোর সঙ্গে বৈঠকের পর রাতে খালেদা জিয়া দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি নেতাদের রাজপথের আন্দোলন জোরদার করার নির্দেশ দেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। তিনি ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশে সব নেতাকে উপস্থিত থাকতে বলেন।
বৈঠকে উপস্থিত স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, দলীয় প্রধানের কথা শুনে মনে হয়নি, তারানকো-তৎপরতা কোনো সমাধান দিতে পারবে।
ওই বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁরা দাবি আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। আলোচনাও অব্যাহত রাখবেন।
তবু আশাবাদ: এই অবস্থায়ও চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান নিয়ে আশাবাদী জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব তারানকো। নির্বাচন কমিশনে সিইসির সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে তিনি গতকাল দুপুরে মুখ খোলেন।
তিনি আশাবাদের কথা জানালেও সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দেননি।
সিইসি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এখনো চলছে। দেখা যাক কী হয়। এ নিয়ে এখন আর কোনো মন্তব্য করব না। ’
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগের আলোচনার তুলনায় গতকালের আলোচনাটি ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত।
নির্বাচনের তফসিল নিয়ে সংশ্লিষ্ট নানা পক্ষের মতগুলো সিইসির কাছে তুলে ধরেন তারানকো। এ সময় সিইসি জানান, এসব মতের সঙ্গে তিনিও একমত। একমাত্র প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মাঝে সমঝোতা হলেই তফসিল পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু সমঝোতা না হলে আগেভাগেই আইনের বাইরে গিয়ে ইসি তফসিলে কোনো পরিবর্তন আনার পক্ষপাতী নয়।
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠক: তারানকোর কাছে আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামী।
গতকাল সকালে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল রাজধানীর একটি হোটেলে তারানকোর সঙ্গে বৈঠক করে।
বৈঠক শেষে আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের জানান, সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়েও কথা হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে আবদুর রাজ্জাক বলেন, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি না হলে সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। সহিংসতা কীভাবে বন্ধ হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি না হলে সহিংসতা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না।
জামায়াত নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর তারানকো ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন ড্যানিলুইৎজের সঙ্গে বৈঠক করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।