আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাদিবার প্রতি শ্রদ্ধা

‘If you want to make peace with your enemy, you have to work with your enemy. Then he becomes your partner’. উক্তিটি আজীবন শান্তির জন্য কাজ করে যাওয়া একালের বিস্ময়, মুক্তিসংগ্রামী, শান্তিকামী, নোবেল বিজয়ী নেলসন ম্যান্ডেলার। বিশ্বে নোবেল বিজয়ী অনেকেই আছেন। কয়জন নোবেল বিজয়ীকে বিশ্ব মনে রেখেছে? একসময় বর্ণবাদ দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য ভয়াবহ সমস্যা ছিল। শ্বেতাঙ্গরা কালোদের ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন চালাত এবং এ নিয়ে অগণিত মানুষ অসংখ্য দাঙ্গায় নিহত ও আহত হয়। শ্বেতাঙ্গরা সভ্যতার নামে বর্ণবাদের আবর্তনে মানবতাবোধকে যখন বিলীন করে চলছিল তখন সর্বশ্রদ্ধেয় মানব এবং বর্ণবাদবিরোধী নেতা ম্যান্ডেলা তীব্র প্রতিবাদ জানালেন।

ম্যান্ডেলা প্রথম কালো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সবাই ধরে নিয়েছিল, এবার শ্বেতাঙ্গদের ভয়াবহ শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু ম্যান্ডেলা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন এবং বৃহত্তর ঐক্যের ডাক দিলেন, সাদাকালো ভেদাভেদ ভুলে দেশ গড়ার কাজে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে অংশ নিতে বললেন। মহৎ মানুষের এমন বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে দক্ষিণ আফ্রিকা ভয়াবহ দাঙ্গা হতে রক্ষা পেল। তাই আজ ম্যান্ডেলা শুধু একটি নাম নয় বরং সৃজনশীলতা, ধৈর্য, ঐক্য, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলা। পুরো নাম নেলসন রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা।

জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই। শৈশব কাটে নানার বাড়িতে। ম্যান্ডেলা তার পরিবারের প্রথম সদস্য, যিনি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। স্কুলের এক শিক্ষক তার নাম দিয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। স্কুল থেকে পাস করার পর ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস কোর্সে ভর্তি হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের শেষে ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্র সংসদের ডাকা আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন। এর জন্য তাকে ফোর্ট হেয়ার থেকে চলে যেতে বলা হয়।

ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার ছাড়ার পর জোহানেসবার্গে চলে যান। সেখানে একটি খনিতে প্রহরী হিসেবে কাজ নেন ম্যান্ডেলা। বিয়ে এড়াতে জোঙ্গিন্তাবার থেকে পালিয়ে আসার বিষয়টা খনির মালিক জেনে যাওয়ায় তাকে কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়।

পরবর্তীকালে জোহানেসবার্গের আইনি প্রতিষ্ঠান উইটকিন, সিডেলস্কি অ্যান্ড এডেলম্যানে কেরানি হিসেবে যোগ দেন। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময়ে ম্যান্ডেলা ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকার দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব উইটওয়াটার্সরান্ডে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু করেন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৪৮-এর নির্বাচনে বর্ণবাদে বিশ্বাসী ও বিভিন্ন জাতিকে আলাদা করার পক্ষপাতী থাকা আফ্রিকানদের দল ন্যাশনাল পার্টি জয়লাভ করে। ন্যাশনাল পার্টির ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটে ম্যান্ডেলা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ১৯৫২ সালের অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৫ সালে জনগণের সম্মেলনেও তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি হিসেবে মুক্তি সনদ প্রণয়ন করেন তিনি। মাদিবা তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথমভাগে মহাত্দা গান্ধীর দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি প্রথম থেকেই অহিংস আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন।

কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ১৯৫৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ম্যান্ডেলাসহ ১৫০ জন বর্ণবাদবিরোধী কর্মীকে দেশদ্রোহিতার মামলায় গ্রেফতার করে। সুদীর্ঘ ৫ বছর (১৯৫৬-১৯৬১) ধরে মামলা চললেও পরে সব আসামি নির্দোষ প্রামণিত হয়। ১৯৬১ সালে এএনসির সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন "উমখোন্তো উই সিযওয়ে" (অর্থাৎ দেশের বল্লম) এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ম্যান্ডেলা।

১৯৬৪ সালে ম্যান্ডেলার কারাবাস শুরু হয় রবেন দ্বীপের কারাগারে। এখানে তিনি তার ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান।

এ সময় বিশ্বজুড়ে তার খ্যাতি বাড়তে থাকে। তিনি সারা বিশ্বে দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সশ্রম কারাদণ্ডের অংশ হিসেবে রবেন দ্বীপের কারাগারে ম্যান্ডেলা ও তার সহবন্দীরা একটি চুনাপাথরের খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হন। কারাগারের অবস্থা ছিল বেশ শোচনীয়। কারাগারেও বর্ণভেদ প্রথা চালু থাকায় কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদের সবচেয়ে কম খাবার দেওয়া হতো।

সাধারণ অপরাধীদের থেকে রাজনৈতিক বন্দীদের আলাদা রাখা হতো। রাজনৈতিক বন্দীরা সাধারণ অপরাধীদের চেয়েও কম সুযোগ-সুবিধা পেত। ম্যান্ডেলা তার জীবনীতে লিখেছেন, তাকে ডি-গ্রুপের বন্দী হিসেবে গণ্য করা হতো অর্থাৎ সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন্দীদের তালিকায় তাকে রাখা হয়েছিল। কারাগারে থাকার সময়ে ম্যান্ডেলা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় পড়াশোনা শুরু করেন এবং আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৮২ সালে তাকে রুবেন দ্বীপের কারাগার থেকে পোলস্মুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।

১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপতি পি ডব্লিউ বোথা তাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির প্রস্তাব দিলে সে প্রস্তাব ম্যান্ডেলা ফিরিয়ে দেন। তিনি বলেন, "কেবল মুক্ত মানুষই আলোচনায় বসতে পারে। বন্দীরা কখনো চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে না। " ১৯৮৮ সালে তাকে ভিক্টর ভার্সটার কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয়। মুক্তির আগ পর্যন্ত ম্যান্ডেলা এখানেই বন্দী ছিলেন।

ম্যান্ডেলার কারাবন্দিত্বের সময় তার মুক্তির জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের ওপরে চাপ বাড়তে থাকে। ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি বোথা হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তার স্থলাভিষিক্ত হন ফ্রেডেরিক উইলেম ডি ক্লার্ক। রাজনৈতিক এ পটপরিবর্তনের পরই ১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসসহ অন্যান্য বর্ণবাদবিরোধী সংগঠনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ভিক্টর ভার্সটার কারাগার থেকে ম্যান্ডেলাকে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেওয়া হয়।

ম্যান্ডেলার কারামুক্তির ঘটনাটি সারা বিশ্বে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। অবশেষে বর্ণবিরোধী আন্দোলনের জয় হলো। আফ্রিকা এক নতুন রাজনীতির ধারায় রূপ নিল এবং বহুবর্ণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো। কারামুক্তির পর ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ অবসানের লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।

এই শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়ার পর ১৯৯৪ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৪ সালে তিনি আফ্রিকায় গণতান্ত্রিকভাবে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৯৯ সালে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। গত চার দশকে ম্যান্ডেলা ২৫০টিরও অধিক পুরস্কার পেয়েছেন।

এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অবদান রাখার জন্য ম্যান্ডেলা এবং রাষ্ট্রপতি এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ককে ১৯৯৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়।

"এই পৃথিবী যে রকম দেখছ, তোমাকে সেটাই মেনে নিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আমাদের কাজ হবে আমরা যে রকম পৃথিবী চাই, যে পৃথিবী আমাদের পছন্দ, তা খুঁজে নেওয়া"। তরুণ সমাজের প্রতি তার স্পষ্ট আহবান এরকমই ছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকেই আফ্রিকান এই অবিসংবাদিত নেতা শুরু করেন এইডসবিরোধী সংগ্রাম।

তিনি The Nelson Mandela Foundation, The Nelson Mandela Children’s Fund and The Nelson Mandela Rhodes Foundation নামে সমাজসেবামূলক সংগঠন গড়ে তোলেন। বিশ্বব্যাপী মুক্তিকামী ও শান্তিকামী জনতার প্রেরণার উৎস ম্যান্ডেলা। বিশ্বের শত কোটি মানুষ তাদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্থায়ী আসনটি দিয়েছেন এই জীবন্ত কিংবদন্তিকে। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় নয়, বরং বিশ্বে তার প্রশংসনীয় কৃতকর্ম এবং অসাধারণ নেতৃত্বের জন্য তিনি আজীবন মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন।

লেখক : গবেষক ও সাবেক কূটনীতিবিদ, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড কাউন্টার টেরোরিজম।

Email: wali.heritage@gmail.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।