এক. ১৬ ডিসেম্বর বিকালের দিকে বাংলাদেশজুড়ে অস্ত্রবিরতি ঘটে গেল। আর কোনো যুদ্ধ নয়। এখন থেকেই সব যুদ্ধের শেষ। আশুগঞ্জে তখন হালকা ঠাণ্ডার আবেশ প্রকৃতিজুড়ে। বিদায়ী সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে।
আর সব দিনের মতোই মেঘনা বহমান। ওপারে ভৈরবে কেমন যেন এক ধরনের নীরবতা। এমন সুনসান নীরবতা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে কেউ সম্ভবত দেখেনি। অনেকটা অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল। এই পরিসমাপ্তির মধ্যে এক ধরনের সুপ্ত উল্লাসের পাশাপাশি ভিন্ন এক ধরনের যন্ত্রণাবোধের উপস্থিতিও টের পেলাম নিজের মধ্যে।
এতদিন যুদ্ধের প্রচণ্ডতার ভেতর যে রক্তপাত আর জীবনহানি দেখে শঙ্কিত হয়েছি, আজ সেই নৃশংসতা হঠাৎ থেমে যাওয়ার খবর শুনেও কম মর্মাহত হলাম না। যে কারণে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আলামত টের পাওয়ার পরও আমাদের মর্টারগুলো তাদের গোলাবর্ষণ বন্ধ করল না। অবশ্য এটা না হওয়ার অন্য একটি কারণও ছিল। আর তা হলো, রণাঙ্গনে কোনো যুদ্ধবিরতি পালনের ব্যাপারে তখন পর্যন্ত আমরা কারও কাছ থেকেই আনুষ্ঠানিক কোনো নির্দেশ পাইনি। কাজেই ভারতীয়রা যুদ্ধ বন্ধ করলেও তাদের কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী আমাদের অস্ত্র সংবরণের কোনো কারণ নেই।
উপরন্তু সেখানকার পরাজিত পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত তাদের ওপর আমাদের আক্রমণ বহাল রাখাই যুক্তিসঙ্গত।
কিন্তু বাস্তবে ঘটনা গড়াল অন্যভাবে। যে কারণে বেতার তরঙ্গে পাক-ভারত যুদ্ধবিরতির খবরটি ভেসে আসার পর আশুগঞ্জ রণাঙ্গনে আমাদের অবস্থানের সর্বত্র একটি হকচকিয়ে যাওয়ার ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল সবার মধ্যেই। মনে হলো আকস্মিক এই যুদ্ধ বন্ধ ঘোষণার ঘটনা কোনো মুক্তিযোদ্ধাই যুদ্ধ বিজয়ের পরিতৃপ্তির সঙ্গে মেনে নিতে পারছে না। অথচ তখনো বারুদ আর পচা লাশের গন্ধের সঙ্গে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে যুদ্ধের উত্তাপ।
দূরের আকাশে বিক্ষিপ্তভাবে উড়ছে মাংসভুক শকুনেরা। মানুষের অগণিত মরদেহ ভাসছে মেঘনার জলে। রণাঙ্গনজুড়ে ব্যাংকারেও মুক্তিযোদ্ধারা তাদের শক্ত আঙ্গুল ট্রিগারে চেপে শত্রু হননের উন্মাদনায় তখনো কাতর। সব কিছু ঠিকঠাক রয়েছে আগের মতোই। তবে এর পাশাপাশি রেডিওতে কোনো এক ভারতীয় ঘোষক অনবরত ঘোষণা দিচ্ছে যুদ্ধবিরতির।
এ অবস্থায় প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে আমাদের অপেক্ষা করতে হলো আরও কিছুক্ষণ। শেষ বিকালের দিকে অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি প্রদত্ত অস্ত্র সংবরণের নির্দেশ পাওয়া গেল। এর পরপরই রণাঙ্গনজুড়ে এক অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এলো। ভৈরবের দিকে তাক করে বসানো আমাদের মর্টারগুলো এখন থেকে অসাড় হয়ে গেল স্থায়ীভাবে। রণাঙ্গনের সর্বত্র বাংকারে অবস্থান নেওয়া সৈনিকরা প্রায় প্রত্যেকেই মাথা উঁচু করে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওপারে ভৈরবের দিকে।
সেখানে শান্তির সাদা পতাকাগুলো বাতাসে উড়ছে স্বাধীনতার মতোই। মনে হলো যেন অবিরাম যুদ্ধের একটি অক্লান্ত রণাঙ্গন আকস্মিক এক ভূমিধসে মুহূর্তে হারিয়ে গেল অদৃশ্যে। যেন যুদ্ধে কোনো পক্ষই আর অবশিষ্ট নেই যুদ্ধক্ষেত্রের কোথাও।
রণাঙ্গনে আর সবার মতো আমিও সহসা নির্জীব হয়ে পড়লাম অস্ত্র বিরতির নির্দেশ পাওয়ার পর। যুদ্ধময়গত জীবনের এই আকস্মিক ফলাফল আমাকে হতবাক করে দিল।
মুক্তিযুদ্ধের এই পরিসমাপ্তি যেন আমি চাইনি। যে আমি অনবরত এবং অনিশ্চিত যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে এতদিন যুদ্ধ পরিসমাপ্তির জন্য ব্যাকুল হয়েছি, সেই আমি আজ যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার ঘোষণা শুনে ভিন্ন রকমের এক ব্যাকুলতা উপলব্ধি করছি নিজের মধ্যে। বোধ করি যুদ্ধজয়ের অতৃপ্তিই আমার মধ্যে এই অন্তর্গত দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করে তুলেছে। আজ আশুগঞ্জ রণাঙ্গনে প্রতিটি যুদ্ধক্লান্ত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন আমারই হুবহু দ্বন্দ্বমুখর মুখচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। পরস্পরবিরোধী এই দ্বন্দ্ব শুধু আমার একার নয়, বোধকরি আজ প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকেই মনে হয় তা সমানভাবে আক্রান্ত করেছে।
রক্তস্রোতবাহী একটি প্রলম্বিত নদী পার হয়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেলাম তাও ঠিক আমাদের অর্জিত কোনো পাওয়া নয়। এ যেন অন্য কারও সোর্পদ করা পাওয়া। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার কাছে এই পাওয়ার আবেদন ক্রমেই ফিকে হয়ে আসতে লাগল। বুকের ভেতর ম্লান হয়ে এলো যুদ্ধ বিজয়ের সমূহ অহংকার।
দুই . একাত্তর পার হয়েছে আজ সাড়ে তিন যুগ।
সেটি ছিল জাতির জন্য বিজয়ের বছর। তারপর থেকে বছর ঘুরে ডিসেম্বর এলেই আমরা অনেকে একে বিজয়ের মাস বলি। হ্যাঁ, কথাটির মধ্যে আংশিক হলেও সত্যতা রয়েছে। এই ডিসেম্বরেই পাকিস্তানি শাসকরা পরাভূত হয়েছিল। তাদের ২৩ বছরের শাসনের অবসান হয়েছিল।
পরাভূত হলেও তারা পরাজিত হয়নি। অন্তত আমাদের কাছে নয়।
পাকিস্তান আত্দসমর্পণ করেছিল ভারতীয় বিজয়ী বাহিনীর কাছে। কারণ দৃশ্যপটে বিজয়ী হয়েছিল ভারতীয় সেনারা। তারা ছিল অগ্রভাগে।
বাংলাদেশের জনগণ এবং একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর সামনে তারা দৃশ্যত প্রমাণ করেছিল যুদ্ধ বিজয়ের সমস্ত কৃতত্বই তাদের। এমনকি আত্দসমর্পণের যে অনুষ্ঠান, সেখানে তারাই ছিল একচেটিয়া। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বর্ষীয়ান ওসমানীর বিতর্কিত অনুপস্থিতি খুব সহজেই প্রশ্নসাপেক্ষ করে তুলল অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠান। সেই অপমানকর প্রশ্নের সঠিক জবাব স্বাধীনতার এত বছর পর এখনো পায়নি এ দেশের মানুষ।
আমাদের বেলায় মেঘনার পূর্ব-পাড়ের আশুগঞ্জ ছিল এগিয়ে আসার শেষ সীমানা।
নির্দেশ ছিল এমনই কঠোর যে, মেঘনা পার না হওয়ার দেওয়া সিদ্ধান্ত অমান্য হলেই বন্ধ হবে খাবারের সরবরাহ। তারপরও সাহসে ভর করে এগিয়ে যান কর্নেল সফিউল্লাহ ঢাকার পথে তার বাহিনী নিয়ে, শাস্তি পেতে হবে জেনেও। তার পথ ধরে পরবর্তী সময়ে আমরা অর্থাৎ ১১ ইস্ট বেঙ্গলও নিজস্ব সিদ্ধান্তে এগিয়ে যাই ঢাকার দিকে লালিত স্বপ্নকে একটু ছুঁব বলে। এসবই সত্য। দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাই সেই সত্য অবলোকনের অস্পষ্ট ছায়াগুলোকে।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা পরাজয় মেনে নিয়েছিল। আর এই পরাজয় মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল নয় মাসের যুদ্ধ।
সেদিন উদ্বেলিত ছিল বাঙালি জনতা। তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। অপশাসন, সন্ত্রাস আর দুঃশাসনের অবসান হয়েছে।
বাঙালিরা আর পরাধীন (!) নয়। মুক্তির নেশায় তারা উন্মাতাল। সেদিন কে 'লিবারেটর' আর কে 'লিবারেটর' নয়, সেই বিভাজনে প্রবেশের সুযোগ ছিল না বাঙালিদের। আনন্দে আত্দহারা বাঙালিরা ভারতীয় সেনাদের ফুলেল শুভেচ্ছায় অভিষিক্ত করল। মুক্তিপাগল লাখো মানুষ অভূতপূর্ব সংবর্ধনায় ভারতীয় বাহিনীকে তাদের কৃতজ্ঞতা জানাল।
স্বতঃস্ফূর্ত জনগণের ওই সংর্বধনা দেখে মনে হতে পারে, যুদ্ধজয়ের একক কৃতিত্ব যেন কেবল ভারতীয়দেরই আর এই উল্লাসের মধ্যে বুঝিবা ম্লান হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের সব গৌরবগাথা।
রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্দসমর্পণের পর ঢাকার নিয়ন্ত্রণ হাতবদল হয়ে গেল ভারতীয় বাহিনীর কাছে। অথচ এটা মুক্তিবাহিনীর হাতেও যেতে পারত কিংবা সম্মিলিত বাহিনীর সমনিয়ন্ত্রণেও।
ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণ এরপর কঠোর থেকে আরও কঠোর হলো। এমন মনে হতে লাগল যে, কালো পর্দার আড়াল থেকে বন্দী নিয়াজিই হয়তো তখনো নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে দেশ।
তিন. ভারতীয় সেনাপতিদের নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি হিসেবে সিদ্ধান্ত হলো আমাদের আশুগঞ্জে ফিরে যেতে হবে। অর্থাৎ যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে আমরা যেখানে ছিলাম। আর তা না হলে যেতে হবে খুলনায়। বাংলাদেশের সমর নেতারা ভারতীয়দের দেওয়া সিদ্ধান্ত বদলাতে ব্যর্থ হলেন।
এক হাজার সৈনিক নিয়ে খুলনা যেতে মোটামুটি একটি বড় জাহাজের প্রয়োজন।
আর সে কারণেই যেতে হলো ঢাকার তখনকার জেলা প্রশাসক কামাল উদ্দিনের দফতরে। তার দফতরে আগে থেকেই বসা দুজন ভারতীয় বেসামরিক কর্মকর্তা। একজন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মনোনীত ঢাকার জেলা প্রশাসক এবং তিনি কামাল উদ্দিনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন। কামাল উদ্দিন অনড়। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে লিখিত নির্দেশ না পাবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠবেন না।
এ নিয়ে বিবাদ যখন চরমে, তখন আমি উঠে দাঁড়ালাম। ভারতীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে বললাম, 'এই যদি হয় বাংলাদেশের জনগণকে তার স্বাধীনতায় ভারতীয় সহায়তা দেওয়ার খেসারত, তাহলে আমরা আরেকটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। '
শাস্তি হিসেবে খুলনায় এসেছি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই। ততক্ষণে ভারতীয়দের চলে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। বন্দী পাকিস্তানি সেনাদের রাখা হয়েছে খুলনার রুজভেল্ট জেটিতে।
জাহাজে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভারতে। ভারতীয় এক ক্যাপ্টেন জানাল, ২৯ ক্যাভেলরি রেজিমেন্টের প্রায় সবাইকে জড়ো করা হয়েছে সেখানে। রংপুরে এই রেজিমেন্টেই ছিল আমার পোস্টিং। মানুষ হত্যায় এদের দুর্নাম ছিল সর্বজনবিদিত। বন্দী অবস্থায় নিরস্ত্র একবার দেখতে ইচ্ছে হলো তাদের।
৪ নাগা রেজিমেন্টের বেষ্টনীর মধ্যে তারা। এক বোতল বিদেশি মদের বিনিময়ে শেষমেশ ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মিলল। তাদের খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হলো না। শীতের সকালে কালো ইউনিফর্মে জেটির একদিকে বসে ভোরের রোদ পোহাচ্ছে। আমাকে চিনতে কষ্ট হলো না কারও।
প্রায় এক বছর একসঙ্গে কাজ করেছি। অনেকে আড়ষ্ট ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভাবতে অবাক লাগল সময় সব কিছু কেমন আমূল বদলে দেয়।
চার. ৪ নাগা রেজিমেন্ট খুলনা ছেড়ে যাবে ২৬ মার্চের আগেই। নির্দেশ পেলাম এই রকম, ৪ নাগা রেজিমেন্ট বাংলাদেশের যেসব যানবাহন দখলিকৃত হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল, তা আমাদের ফেরত দিয়ে যাবে।
নির্দেশের বাস্তবায়নে আমি ৪ নাগা রেজিমেন্টের অধিনায়কের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেগুলো হস্তান্তরের কথা বললাম। ভ্রু-কুঞ্চিত অধিনায়ক কি যেন হিসাব করলেন। তারপর খানিকটা তাচ্ছিল্য নিয়ে সেদিন থেকে দুদিন পর আমাকে আসার কথা বললেন।
তাই হলো। দুই দিন পর স্বসৈন্যে হাজির হলাম ৪ নাগা রেজিমেন্টের আবাসস্থলে, যেখানে মাত্র দিন দুয়েক আগেই দেখা হয়েছিল ৪ নাগার অধিনায়কের সঙ্গে।
খা খা করছে চারদিক। জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। অবিন্যস্ত পড়ে রয়েছে কেবল কিছু আবর্জনা।
সব কিছু মিলিয়ে মনে হতে লাগল, একটি বিজয়ই কেবল অর্জিত হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা তার অপার আনন্দ নিয়ে তখনো ছুঁয়ে যায়নি জাগ্রত বাংলাদেশকে।
একটু একটু করে ঘুম ভাঙছে। ২৩ বছরের জমে থাকা ক্লেদ আর গ্লানি ঝেড়ে ফেলতেও তো খানিকটা সময়ের প্রয়োজন।
কিন্তু বিষদৃশ্য ঠেকল অল্প কদিনেই সবকিছু একাকার হয়ে যাওয়ার দৃশ্য থেকে। এত ধ্বংস, এত বিনাশ, এত সংহার আর এত বিভক্তির পরও শত্রু আর মিত্রে বিভেদ থাকল না। সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো যেন কোনো যুদ্ধই হয়নি। সব যেন আগের মতোই রয়ে গেছে। সেই হাজার বছরের ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা, সেই জনবিরোধী প্রশাসন যন্ত্র, সেই আগের মতোই সমাজপতি শাসিত গ্রামীণ পরিবেশ, সেই ঔপনিবেশিক বিচারিক কাঠামো কোনো কিছুরই কোনো পরিবর্তন নেই। কেবল পরিবর্তন 'পাকিস্তানের' পরিবর্তে একটি নামের। ভাবতে অবাক লাগল যে এই এতটুকু পরিবর্তনের জন্য এত রক্তপাত?
পাঁচ. স্বাধীনতা লাভের মাত্র কয়েক দিনের মাথায় অদৃশ্য শক্তির আশীর্বাদে অলৌকিক সব ঘটনা ঘটতে লাগল।
বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে শত্রু আর মিত্রে কোনো বিভক্তিই থাকল না। ক্যাপ্টেন হাকিম একজন গোলন্দাজ অফিসার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২৭ ব্রিগেডের ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্টে কর্মরত থেকে যুদ্ধের ন'মাস হবিগঞ্জের নোয়াপাড়া অবস্থানে গোলন্দাজ অফিসার হিসেবে যুদ্ধরত থেকেছেন মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে। শত শত মানুষ হত্যা করেছেন তিনি তার নিক্ষিপ্ত গোলায়। স্বাধীনতার পর তিনি শুধু চাকরিই ফেরত পেলেন না, তিনি দায়িত্ব পেলেন মিলিটারি পুলিশ বিভাগের প্রধান হিসেবে।
একইভাবে চাকরি ফেরত পেলেন লেফটেন্যান্ট মোদাব্বের ও লেফটেন্যান্ট আল ফরিদ। এরা দুজনই পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ জায়গাটি দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন পরবর্তীতে।
সেনাবাহিনীর সদর দফতরে চাকরি পেলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম রহমান। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ১ নং সামরিক আদালতের প্রধান কর্মকর্তা, মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়। আরও চাকরি পেলেন কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব হিসেবে।
আরও যারা চাকরি পেলেন তারা হলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন আমিনুল ইসলাম, বেসামরিক গোয়েন্দা দফতরের প্রধান সাফদার, রাজাকার বাহিনী প্রধান রহিম এবং আরও অনেকে। এরা সবাই শুধু চাকরিই ফেরত পেলেন না, পেলেন রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ দফতর।
৭ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে আমি যখন সরাইলের কাছাকাছি, তখন ভারতীয় অধিনায়ক আমাকে সরাইল আক্রমণ করে সরাইলের দখল নিশ্চিত করতে বললেন। ভারতীয় গোলনদাজ বাহিনীর ছত্রছায়ায় আক্রমণের সূচনা হলো। হালকা যুদ্ধের পর সরাইলের পতন হয়।
সেখানে আমার ঠিক সামনেই যুদ্ধে নিহত হন দুজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা- একজন মেজর ফরিদ এবং অপরজন ক্যাপ্টেন ফখরুল আহসান। তারা যুদ্ধ করছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। আমার তত্ত্বাবধানেই তাদের সমাহনপর্ব সম্পন্ন হয়। তাদের শায়িত করা হয় তাদেরই বাংকারের ভেতর যেখান থেকে তারা যুদ্ধ করছিলেন। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে লড়েও ক্যাপ্টেন ফখরুল আহসান আজ শহীদের মর্যাদায় অভিষিক্ত।
সেনানিবাসের ‘Heroes Live for Ever’-এ তার নাম জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা রয়েছে আরও অনেক শহীদের পাশে।
ছয়. ইতোমধ্যে স্বাধীনতার চার দশক পার করেছে জাতি। হিসাবে চার দশকের খানিকটা বেশিই হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কেবল আমারই নয়, আমার মতো আরও অনেকেরই প্রশ্ন- যে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাতি লালন করেছে যুগের পর যুগ ধরে, কাঙ্ক্ষিত সেই স্বাধীনতার এতটুকু সুফলও কি ভোগ করেছে এ দেশের মানুষ? স্বাধীনতার সুফল প্রাপ্তির প্রশ্নে এ দেশের জনগণ না হয় ভাগ্যবঞ্চিত এবং তা নিয়ে বোধকরি এখন কারও কোনো সংশয় বা দুঃখ নেই তেমন।
এ দেশের মানুষ কখনোই ভালো ছিল না।
সামাজিক বা রাজনৈতিকভাবে তো নয়ই। দশকের পর দশক, যুগের পর যুগ দুঃসহ অবস্থায় বাস করে করে একটু একটু করেই তাদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনার উন্মেষ ঘটে। তারা চেয়েছিল নিরাপদ ও অধিকারসম্পন্ন গণতান্ত্রিক একটি দেশ। এটাই ছিল বাঙালি জাতির বাসের আজন্ম স্বপ্ন। কিন্তু তারা ভুলটি করে বসেছে তাদের পথপ্রদর্শক নির্বাচনে।
তাদের 'প্যাথফাইন্ডাররাই' তো দেখেনি প্রকৃত স্বাধীনতা বা অধিকার। চর্চাও করেনি নিজস্ব গণ্ডিতে গণতন্ত্রের। অধিকার যে মানুষের জন্মগত দাবি, তা তারা বোঝার চেষ্টাই করেনি। আর সে কারণে তারা ব্যর্থ হয়েছে প্রকৃতির নিয়মে।
আসলে দুর্ভাগা এই দেশ।
আর দুর্ভাগা এই জাতি। স্বাধীনতার চার দশক পর তারা অসহায়ের মতো অবলোকন করেছে দুঃশাসনের পাশাপাশি কুশাসন। অপশাসন আর শোষণে তারা জর্জরিত হতে দেখেছে দেশের মানুষকে। তারা দেখেছে গত চার দশকে দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের উলঙ্গ আস্ফালন। গণতন্ত্রের আড়ালে তারা দেখেছে স্বৈরতন্ত্র।
দেশের মানুষ আজ অবসাদগ্রস্ত, ক্লান্ত। নৈরাজ্যের নিষ্পেষণে আজ দিশাহারা দেশের আপামর মানুষ।
আজকে স্বাধীনতার চার দশক পর আশাহীন এই জীবনের কথা বলতে হতো না বা লিখতেও হতো না। যদি না আমি বা আমরা এখন এমনভাবে অর্থাৎ উদ্ধারহীন, শ্বাসরুদ্ধকর, বদ্ধ অন্ধকারে বাস না করতাম। নিজের দেশে এমনভাবে বাস করছি যেন দণ্ডিত হয়ে আছি সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছে।
এমন কারাগারে আমি বা আমরা আগে কখনো বাস করিনি- একাত্তরেও না। সেটি ছিল আমাদের মুক্তির বছর, বিদেশি খুনিদের দিয়ে আক্রান্ত থেকেও আমরা মুক্ত ছিলাম। এভাবে আমার বা আপনাদের দম আগে কখনো বন্ধ হয়ে আসেনি।
বাংলাদেশে এখন কোনো জ্ঞানের চর্চা নেই। জ্ঞানের বিরুদ্ধে এখানে চলছে সোচ্চারিত সব কর্মকাণ্ড।
এখানে এখন কোনো সৃষ্টিশীলতা নেই, এমনকি মানুষের জন্য জীবনধারণের আশাটুকু পর্যন্ত নেই। পরিবর্তে কেবল আছে বর্বরতা যা মানুষকে পিষ্ট করে চলেছে নিয়ত, মিথ্যাচার একে দূষিত করে চলেছে, অনধিকার মানুষকে অসহায় পশুতে পরিণত করেছে। আমি বা আমরা যারা মুক্তির জন্য লড়েছি বা এখনো লড়ার শক্তি জুগিয়ে চলার চেষ্টা করি, কোনো মুক্তির লক্ষণ দেখি না। অন্তত আমার জীবনে মুক্তি দেখব, এমন আশা আমি আর করি না। আমাদের দেশের দিকে তাকিয়ে একটি প্রশ্ন কেবলই জাগে- বিংশশতক থেকে কত কত শতক পিছিয়ে গেল আমার দেশ এবং আমাদের দেশের মানুষ একবিংশ শতকে পেঁৗছেও?
আজ আতঙ্ক এমনই চরমে যে, এখন সব কিছুতে ভয়।
ঘরে থাকব? ভয়। রাস্তায় বেরোব? ভয়। নদীর পাড়ে দাঁড়াব? ভয়। মেঘের দিকে তাকাব? ভয়। কথা বলব? ভয়।
পুলিশ? ভয়। আমলারা? ভয়। রাজনীতিকরা? ভয়। তাদের গুণ্ডারা? ভয়। এমনকি বন্ধুরা? তারাও ভয়।
বাংলাদেশ এখন শিহরণ জাগানো ভয়ের এক দেশ।
আমরা আজ '৭১ থেকে এতটাই পেছনে চলে গেছি যে, তা হিসাব করাও কঠিন। সংবিধানের একের পর এক হাস্যস্পদ কর্তন, দফার পর দফা এবং শেষমেশ ভয়ঙ্করতম ১৩ দফা আমাদের মধ্যযুগও পার করে দিয়েছে।
এটা নির্জলা সত্যি যে, '৭১-এ জয়ী হওয়ার পরপরই আমরা করুণভাবে পরাজিত হয়েছি। জিতেও পরাজিত।
আমরা আলবদর, রাজাকার, সন্ত্রাসী, গুণ্ডা, বদমায়েশ, দুর্নীতিবাজ- সবার সঙ্গে একাকার হয়ে স্বাধীনতার শোচনীয় অপব্যবহার করেছি। আমরা আমাদের সব লক্ষ্যকে পরাজিত করেছি। আমরা শুরু থেকেই পরাভূত করে চলেছি আমাদের স্বাধীনতাকে।
ভাবতে বিস্ময় লাগে যে, আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম।
লাখ লাখ বাঙালি মৃত্যুবরণ করেছিল। লাখ লাখ নারী পীড়িত হয়েছিল। নিয়ত প্রশ্ন জাগে, আমরা কি সত্যিই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম? এদেশে কি কখনো মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? লাখ লাখ বাঙালি কি আদৌ নিহত হয়েছিল? লাখ লাখ মানুষ কি উদ্বাস্তু হয়েছিল? লাখ লাখ নারী কি উৎপীড়িত লুণ্ঠিত হয়েছিল? আমরা সত্যি সত্যিই কি অশুভের বিরুদ্ধে লড়েছিলাম?
এটা অবিশ্বাস্য কিন্তু তারপরও সত্য যে, আমার আজকের বাংলাদেশ বাস করছে ভয়ের এক মেঘমালার নিচে। আমরা এখানে বাস করছি ভয়ের এক জলবায়ুতে। এখানে শান্তিতে বাস করা যায় না, স্বস্তিতে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ করা যায় না।
মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীলতা, যুক্তিশীলতা এসব ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে বছরের পর বছর, দশকের পর দশকজুড়ে।
আজকের বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে একটি ত্রাসের জনপদ। এখানে কোনো উৎপাদন নেই শুধু ত্রাসের উৎপাদন ছাড়া। পুরো দেশ হয়ে উঠেছে অত্যাচারের স্বয়ংক্রিয় কারখানা। প্রতিহিংসার দানবকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে দেশজুড়ে।
আমাদের তরুণরা হচ্ছে সেই ত্রাসের অগ্রপথিক- 'প্যাথফাইন্ডার'। তারা এখন মানুষের রগ কাটা আর চাপাতি চালনায় সিদ্ধহস্ত। অন্ধের মতো তারা স্লোগান দিচ্ছে নিজেদের ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে। নষ্টভ্রষ্ট নেতাদের নামে স্লোগান দিয়ে, বই-পুস্তক, খাতা-কলম, নর্দমায় ছুড়ে ফেলে তারাও সন্ত্রাসের নেতা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একদিন তারাও মন্ত্রী হবে, তাই এখনই তাদের সন্ত্রাসের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে উঠতে হবে, এখনই তার শ্রেষ্ঠ সময়।
তাদের পিতা-মাতারাও নষ্ট। তারা আত্দতৃপ্তির হাসি হাসে এ জন্য যে, তাদের সন্তানরা সমাজের শ্রেষ্ঠ সন্ত্রাসী।
সকাল থেকে মধ্যরাত আবার মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত এই সোনার বাংলায় নিরন্তর গর্বিত মিথ্যাচারের পর মিথ্যাচারে ডুবে থাকতে হয় সোনার বাংলার সোনার মানুষদের। মিথ্যাচার এখন বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের আদর্শ। প্রতিনিয়ত এবং অব্যাহতভাবে এখানে শেখানো হয় মিথ্যাচারই সত্যাচার, দুর্নীতিই সুনীতি, অত্যাচারই জনগণকে সুখী করার পদ্ধতি, প্রতারণাই সুসমাচার, অবিচারই সুবিচার, অনধিকারই অধিকার, বর্বরতাই সংস্কৃতি, অন্ধকারই আলো, দাম্ভিকতাই বিনয়, সন্ত্রাসই শান্তি, মৌলবাদেই মুক্তি, মূর্খ অর্থাৎ অমার্জিত ভণ্ড রাজনীতিকদের একচ্ছত্র তাণ্ডব আর নিষ্পেষণই হচ্ছে গণতন্ত্র।
কি নির্মমভাবে আমরা আমাদের সব লক্ষ্যকে পরাজিত করেছি। কি লজ্জাহীনভাবে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে গলাচিপে হত্যা করেছি। প্রকারান্তরে অব্যাহতভাবে আমরা পরাভূত করে চলেছি আমাদের স্বাধীনতাকে।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধকালীন কোম্পানি কমান্ডার, ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।