আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেগম রোকেয়া ভার্সেস পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়া

https://www.facebook.com/blogger.sadril

৯ ডিসেম্বর রাত্রিবেলা টিভির চ্যানেল মোড়াচ্ছি। কোন এক দেশীয় চ্যানেলে খবরের শেষাংশ দেখানো হচ্ছে,সেখানে জানানো হলো আজ ছিলো বেগম রোকেয়া দিবস,১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি জন্ম লাভ করে ১৯৩২ সালের একই দিনে(তথা ৯ ডিসেম্বরেই) তিনি গত হয়েছেন। দিবস উপলক্ষে কে কী বাণী দিয়েছে তা খবরে উল্লেখিত হলো। তখন মনে পড়লো সকালে উঠে পত্রিকার কোন এক চিপাতেও এরকম কিছু পড়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ আর হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন এলে মিডিয়াতে বিয়েবাড়ির ন্যায় সাজ সাজ রব পড়ে যায়, অথচ বাঙ্গালী নারীমুক্তির আন্দোলনের পথিকৃতকে নিয়ে মিডিয়ার এতো অবহেলা কেন কিংবা উল্টিয়ে বলা যেতে পারে হুমায়ুন রবীন্দ্রদের নিয়ে মিডিয়ারই বা বাড়তি উতসাহ কেন? আমাদের এই তথাকথিত আধুনিক যুগটি হলো পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়া প্রনোদিত কনসিউমার সোসাইটির নিদর্শন।

খুনাকুনীর খবর কিংবা চটকদার বিজ্ঞাপনের দ্রব্য, সবই মিডিয়ার কাছে পণ্য। মিডিয়াতে সেটাই প্রদর্শিত হয় যা মানুষ গিলবে। এবং পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়ার কাছে রোমান্টিসিজম হলো সেই পন্য যা সহজেই যেকোনকিছুর সাথে গুলিয়ে মানুষকে গেলানো যায়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রোমান্টিক কবি, নারীকে কখনো দেবী কখনো প্রেয়সী বানিয়ে তিনি রচনা করেছেন অজস্র রোমান্টিক গান। রবীন্দ্র রচিত রোমান্টিসিজম যে সাহিত্যিক রস আস্বাদনের ক্ষেত্রে অনেক উচ্চমানের সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়ার কাছে রবীন্দ্ররচিত রোমান্টিসিজম হলো স্রেফ ভোগ্যপণ্য।

রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিবসে রবীন্দ্র ভক্তরা রবীন্দ্রসংগীত শোনার আশা নিয়ে টিভি সেটের সামনে বসবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ বিষয়টিকে মিডিয়া দেখবে, যে ঐদিন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর দর্শক বা কনসিউমার বিদ্যমান,তাই সারা বছর রবীন্দ্রনাথের পাত্তা না থাকলেও ঐদিন রবি ঠাকুরকে নিয়ে হৈ চৈ করলে জুটে যাবে বিজ্ঞাপনের স্পন্সর। এই বিজ্ঞাপনই মিডিয়াকে পুরুষতান্ত্রিক রূপ দেবার পেছনে মূল কারিগর। বিজ্ঞাপনে পন্যের উপযোগীতা বর্ণনায় নারী নিজেই পণ্যরুপে আবির্ভুত হয়। টিস্যু পেপারের মতো স্বচ্ছ শাড়ির আচল উড়িয়ে এক নারী ঘরময় হেটে বেড়াচ্ছে,দেখে মনে হলো এটা বুঝি শাড়ির বিজ্ঞাপন, বড়জোর টিস্যু পেপারের বিজ্ঞাপন হতে পারতো কিন্তু পরে বোঝা গেলো,নারীর হাতে রয়েছে মশা তাড়াবার স্প্রে,এটা আসলে মশার স্প্রে-এর বিজ্ঞাপন।

ওয়েস্টার্ণ বিজ্ঞাপনগুলোতে অবস্থা আরো ভয়াবহ, আমাদের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় নারী নেচে গেয়ে স্প্রে ছিটাবার পরে মশারা দৌড়ে পালাচ্ছে, আর বিদেশী বিজ্ঞাপনে একজন পুরুষ বাথরুমের বেসিনে দাঁড়িয়ে বডি স্প্রের শিশিখানা বের করলেই সেই বাথরুমে দুনিয়ার তাবত নারীর সমাবেশ ঘটে যায়। তবে পশ্চীমা বিশ্বর মিডিয়াতে নারীর শারীরিক উপস্থাপনা যেমন তীব্র তেমনি সেই উপস্থাপনা নিয়ে গবেষণা এবং সমালোচনাও তীব্রতর। আমাদের দেশের নারীবাদিরা নির্বিষ। তারা সেই পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়ার পত্রিকাতে লিখে অথবা টিভি চ্যানেলের টকশোতে এসে হয় সেই একই গতবাধা কথা বলেন যার চার লাইন শুনলে আমরা দশবার হাই তুলি অথবা উনারা আকস্মিক কিছু বলে ফেলে অযথা বিতর্ক তৈরী করেন (যেমন মিতা হোক কিছুদিন আগে করেছিলনে)। অবশ্য নারীবাদ ব্যাপারটাই বা কি তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।

সে নিয়ে আলোচনা আরেকদিন হবে। রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিসিজম নিয়ে মিডিয়াতে যা ঘটে, সেই একই ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে হুমায়ুন আহমদে কে নিয়েও (বিশেষ করে তার মৃত্যুর পরে)। হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিনে চ্যানেল আই পালন করে হিমু দিবস। হুমায়ুন ভক্তদের মাঝে হিমুর পাশাপাশি মিসির আলীও অনেক জনপ্রিয় কিন্তু চ্যানেল আই হিমুকে পিক করেছে কারণ হিমু হলো একটি তরুন রোমান্টিক চরিত্র, পিস্তল হাতে ভয়ঙ্কর খুনী কিংবা জোছনা রাতে তরূনী সবাই হিমুর সামনে আবির্ভুত হয় রোমান্টিক আবহ নিয়ে। অন্যদিকে মিসির আলী হলো মিডীয়ার কাছে একজন রোমান্টিসিজিম বর্জিত বুড়ো লোক যে কিনা সারাদিন ভূত-পেত্নী খুজে বেড়ায়।

সাহিত্যিক একইসাথে সমাজকে চ্যালেঞ্জ করে আবার সমাজের কাছে সে আত্নসমর্পণ করতেও বাধ্য থাকে। সেই কারনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সাহিত্যেও পাওয়া যায় পুরুষতন্ত্রের সুবাস। নারী চরিত্রগুলোর প্রাধান্য নির্ধারিত হয় পুরুষতন্ত্রের মাপকাঠিতে। হিমুর বান্ধবী রূপা হলো অপরূপা, জীবানন্দের বনলতা রহস্যময়ী, হৈমন্তি নিষ্পেষিত নারীর প্রতিচ্ছবি কিন্তু আইবড়ো হয়েও যে সে কতটা সুন্দরী সেটা বলতে তার স্বামী ভুলে নি। বেগম রোকেয়াকে “প্রেম-রহস্য” গল্প হতে উদ্ধৃতি করছি “যাবতীয় উপন্যাসের নায়িকাই “সুন্দরী” হইতে বাধ্য হইয়াছে।

নাহিলে নায়িকা প্রথমে দর্শকদের নয়নরঞ্জন, অতঃপর চিত্তরঞ্জন করিতে সমর্থ হইতে পারে না”। একজন সাহিত্যিক নিজে মতো করে সাহিত্য রচনা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল,শরতচন্দ্র, জীবানন্দ, এবং হুমায়ুনরা এসেছিলেন বলেই আমাদের সাহিত্য এতটা ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর,তাদেরকে নিয়ে তুলুনা করাটাও অমূলক,কিন্তু যখন প্রশ্ন আসে মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেশনের তখন পর্দার আড়ালে উকি দেয় অসমতা। সেই অসমতা রবীদ্রনাথ এবং বেগম রোকেয়ার মাঝে নয় বরং নারী-পুরুষের অসমতাতে কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মাপকাঠিতে নারীর এক্সট্রিম প্রেজেন্টেশনটাই বিজ্ঞাপনমুখী মিডিয়ার নিকট মুখ্য বিষয়। বেগম রোকেয়ার রচনায় সেরূপ প্রেজেন্টশনের কোন উপাদান নেই, বরং তিনি ছিলেন নারীর রূপচর্চা কেদ্রিক সৌন্দর্য্য-এর সমালোচক।

মিডিয়ার সাথে রোকেয়ার আদর্শিক দ্বন্দ্বটা এখানেই। মিডিয়ার কোন আদর্শের দরকার নেই, তার দরকার ব্র্যাণ্ডের সিল বা ছাপ্পড় যা বিজ্ঞাপনে প্রসাধনী ও অলঙ্কারিক সৌর্দয্যে উপস্থাপিত নারীর দেহে অদৃশ্যভাবে লেপ্টে থাকে। অন্যদিকে নারী অলঙ্কার সম্বন্ধে বেগম রোকেয়া মতিচুর গ্রন্থে বলেন “ আমাদের অতিপ্রিয় অলঙ্কারগুলি-এগুলি দাসত্বের নির্দশন বিশেষ। কারাগের বন্দীগণের হাতকড়ি লৌহ নির্মিত, আমাদের হাতকড়ি স্বর্ণ-বা রৌপ্য নির্মিত চুড়ি। এই অলঙ্কারের জন্য ললনাকুলের কত আগ্রহ।

মাদক দ্রব্যের যতই সর্বনাশ হউক না কেন,মাতাল তাহা ছাড়িতে চাহে না সেইরূপ আমরা অঙ্গে দাস্বতের নির্দশন ধারণ করিয়াও আপনাকে গৌরবান্বিত মনে করি-গর্বে স্ফীতা হই”। প্রশ্ন আসতে পারে, মিডিয়াকে কেন পুরুষতান্ত্রিক বলা হয়? মিডিয়া তো প্রচুর নারীর কর্মসংস্থানও বটে। তবুও মিডিয়াকে পুরুষতান্ত্রিক বলা হয় ক্রণ মিডিয়া যে দর্শন প্রচার করে তা সমাজের নারী পুরুষের অসমতাকেই প্রকট করে তোলে। একদিকে যেমন পত্রিকার চিপায় কেন বেগম রোকেয়ার স্থান তা নিয়ে হা হুতাশ করা যায় অন্যদিকে পত্রিকার পাতায় বেশ বড় আকারেই দেখা যায় সিনেমার নায়িকাদের গ্ল্যামারাস ছবি এবং তাদের প্রেম-কেচ্ছা নিয়ে চটকদার সব খবর। পুরুষেরা যেমন এ সকল খবরের ভোক্তা তেমনি নারীরাও।

কারণ মিডিয়া নারীকে দেখিয়ে দিচ্ছে এই হলো সৌন্দর্যের মাপকাঠি, আপনি এই ক্রীম মাখুন, ঐ সাবান ব্যাবহার করুন। সমাজবিজ্ঞানী বদরিলার “consumer society” বইতে এ প্রসঙ্গে বলেন “Woman is sold to women…while doing what she believes in preening herself, clothing herself, scenting herself, in a word creating herself, she is, in fact, consuming herself. বেগম রোকেয়ার আদর্শ ধারণ করে নারী শিক্ষার আহবান নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে কি পৌছানো সম্ভব হয়েছে? BANBEIS-এর তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালে প্রাইমারী স্কুল থেকে মেয়েদের ড্রপ-আউট রেট ৫৯.৮৪ শতাংশ(ছেলেদের ক্ষেত্রেও আশঙ্কাজন, ৫২.২২ শতাংশ)। এস.এস.সি-তে বেগম রোকেয়া রচিত “জাগো গো ভগিনী” পড়েছিলাম। এক বড়ভাই একদিন দুষ্টূমি করে সেটাকে বলেছিলেন “ভাগো গো ভগিনী”। কথাটি রসিকতা হলেও মিডিয়ার ক্ষেত্রে এটি বাস্তব।

এখন পণ্য বিক্রির আসায় নারীর পণ্যমাফিক উপস্থানপনা নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে কড়া নেড়ে মিডিয়া উতসাহ দিচ্ছে অমুক-তমুক পণ্যের পেছনে যেন ভগীনিগণ ভাগিতে থাকে। শিক্ষার আলো বঞ্চিত যে নারী আগে ছিলো নিজ গৃহে অবরোধবাসীনি,সেই নারী পুনরায় বন্দী হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়ার বডি স্প্রে-এর বিজ্ঞাপণী শিশিতে। সেই একই মিডিয়া যে রোকেয়া দিবসে রোকেয়ার কিছু অবদান খবরের শেষ পর্যায়ে এসে মনে করিয়ে দিয়েছে এইতো অশেষ কৃপা। নারীমুক্তির পথ দেখিয়ে বেগম রোকেয়া আজ নিজেই তার নিজ রচনায় বন্দীনি, রোকেয়া দিবসে বছরে একটিবার উনার আদর্শের প্যারোলে মুক্তি ঘটে। (রোকেয়া দিবসের জন্য লেখাটি লিখেছিলাম, বিভিন্ন কারণে পোস্ট দিতে দেরী হয়ে গেলো বলে দুঃখিত)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।