আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রথম ভাস্কর্য ও প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ

কোন দেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখতে নানা ধরনের কাজ করে থাকে। এর মধ্যে সবার উপরে থাকে ভাস্কর্য তৈরি। জার্মানী ও রাশিয়ার রাস্তায় এ ধরনের ভাস্কর্য অনেক বেশি করেই চোঁখে পড়ে। রাস্তায় রাস্তায় বীরদের বীরত্ব আর দেশের ইতিহাসের কাহিনী। সেদিক থেকে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও পিছিয়ে ছিল।

সে সময় অনেকের চোঁখে দেশকে নতুন করে গড়ার চিন্তা থাকলেও কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন। যাদের চিন্তা ভাবনায় থাকত কিভাবে স্মৃতিকে সমুজ্জল করা যায়। জাগ্রত চৌরঙ্গী মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের অসামান্য আত্মত্যাগের স্মরণে নির্মিত তেমনি একটি ভাস্কর্য। মতিঝিলের শাপলা চত্বরের ভাস্কর আবদুর রাজ্জাক জাগ্রত চৌরঙ্গীর ভাস্কর। এ স্মৃতিসৌধটি ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় নির্মিত এটিই প্রথম ভাস্কর্য।

গাজীপুরের জয়েদেবপুর চৌরাস্তায় অবস্থিত প্রথম ভাস্কর্য জাগ্রত চৌরঙ্গী
জাগ্রত চৌরঙ্গীর জেগে ওঠার কাহিনী
শহীদ হুরমত উল্যাহ, মনু খলিফাদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্যে মেজর জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী একটি ভাস্কর্য তৈরির উদ্যোগ নিলেন। তিনি দেখা করলেন আর্ট কলেজে সবে মাত্র চালু হওয়া ভাস্কর্য বিভাগের প্রধান আব্দুর রাজ্জাকের সাথে। তিনি ছিলেন মুলত চিত্র শিল্পী, ভাস্কর্য তৈরির প্রস্তাবে তিনি রাজি হয়ে গেলেন। ভাস্কর্যটি বানাতে প্রয়োজন ছিলো তিরিশ হাজার ইট, ইটের গুড়া, রড আর প্রায় তিনশো ব্যাগ সিমেন্ট।

মেজর জেনারেল আমিন চৌধুরীর সুবাদারকে জানাতেই তিনি ছয় হাজার ইট ও ছয়শো ব্যাগ সিমেন্ট ম্যানেজ করে ফেললেন।
আর্ট কলেজে ভাস্কর্য তইরি হোল। এর ভাস্কর ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক, সহকারি ভাস্কর হামিদুজ্জামান ও প্রকৌশলী ছিলেন আব্দুর রশিদ। এছাড়া জয়নুল আবেদিনরাও এগিয়ে এসেছিলেন, করেছিলেন সাধ্য অনুযায়ি সাহায্য। আর্ট কলেজে ভাস্কর্যটি তইরি হোল।

তখন ঢাকায় একটি মাত্র ক্রেন ছিলো। সেটি ক্রেনে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হোল জয়দেবপুরে। কিন্তু সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর দেখা গেলো হাটুর কাছে ফাটল ধরেছে। এটিকে উঠিয়ে জয়দেবপুরের চৌরাস্তায় স্থাপন না করে স্থাপন করা হোল জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে।
এরপর ১৯৭৩ সালে এক বছরে ধরে তৈরি করে স্থাপন করা হয় জয়দেবপুরের চৌরাস্তায়।

আর্ট কলেজ থেকে এটিকে চৌরাস্তায় নিতে সময় লেগেছিলো দুই দিন। এর ভিত দেয়া হোল বাইশ ফুট, ফাউন্ডেশন দেয়া হোল এগারো ফুট আর উচ্চতা হোল উনিশ ফুট। অনেক বড় ভাস্কর্য এটি।
এখানে একটি মজার কাহিনী আছে। এক প্রকৌশলী আনা হোল যিনি বললেন ফাউন্ডেশন দিতে লাগবে দুই লাখ টাকা যা যোগাড় করা ছিল অসম্ভব।

তখন মেজর জেনারেল আমিন আহাম্মেদের সুবাদার বীর উত্তম আফতাব বললেন, “স্যার, এই সব ইঞ্জিনিয়ার বাদ দেন। আমরা গ্রামের পোলা। রড এনে বিছিয়ে দিচ্ছি। এই রড যতই নিচে যাবে ততই তো ঠিক হয়ে যাবে। শুধু শুধু লাখ টাকা কেন দিতে যাবেন”।

সে এগারো ফুট নিচ থেকে একটার পর একটা রড ঢালাই দিয়ে একদম মাথা পর্যন্ত উঠিয়ে দিল। যেহেতু রডের কোন নির্দিস্ট মাপ ছিল না তাই ভাস্কর্যের পায়ের কাছটা বাঁকানো সম্ভব হয় নি। পাটা ভিত্তির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাস্কর্যটি বানানো শেষ হলে তারা আসতে আসতে মোড়ক উন্মোচন করলেন। তারা এর আগ পর্যন্ত ভাস্কর্যটি দেখননি।

মসজিদের ইমাম বাধা দিতে এলে বিভিন্য কথা বলে তাকে বোঝানো হোল। তিনি বুঝলেনও।
ভাস্কর্য তৈরি শেষে এখন নাম লেখার জন্যে লাগবে মার্বেল পাথর। তখন মার্বেল পাথর পাওয়া যেত শেরে বাংলা নগরে। সেখানে সংসদ ভবন হচ্ছিলো পাকিস্তান আমলে।

সংসদ ভবন নির্মানের জন্যে আনা মার্বেল পাথর তখন পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো। সুবাদার সাহেব গিয়ে রক্ষীকে বললেন, “তোমরা অন্য দিকে তাকিয়ে থাকো। আমি মার্বেল পাথর নিয়ে যাই। রিপোর্ট করবে না”। এরপর তিনি প্রায় ২০০ টি মারবেল পাথর নিয়ে আসেন।


মুলত ভাস্কর আব্দুর রাজ্জাক অনেক কষ্ট ও শ্রম দিয়েছেন এই ভাস্কর্যটি নির্মানের পেছনে। তিনি দিন রাত মেজর জেনারেল সাহেবের বাসায় থেকে কাজ করে গিয়েছেন। এভাবেই ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরের ৮ বা ৯ তারিখে সৃষ্টি হোল দেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রথম স্রিতিস্তম্ভ “জাগ্রত চৌরঙ্গী”। মেজর জেনারেল আমিন আহাম্মেদ চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে শহীদ হুরমত উল্লার মা’কে দিয়ে উদ্বোধন করাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয় নি।

এতো পরিশ্রমের ফসলে নির্মিত হয়েছে যেই ভাস্কর্যটি তা আজও উদ্বোধন করা হয় নি।
অবস্থান
ডান হাতে গ্রেনেড, বাঁ হাতে রাইফেল। লুঙ্গি পরা, খালি গা, খালি পা আর পেশিবহুল এ ভাস্কর্যটি গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর চৌরাস্তার ঠিক মাঝখানে সড়কদ্বীপে অবস্থিত।
আকার
ভিত বা বেদিসহ জাগ্রত চৌরঙ্গীর উচ্চতা ৪২ ফুট ২ ইঞ্চি। ২৪ ফুট ৫ ইঞ্চি ভিত বা বেদির ওপর মূল ভাস্কর্যের ডান হাতে গ্রেনেড ও বাঁ হাতে রাইফেল।

কংক্রিট, গ্রে সিমেন্ট, হোয়াইট সিমেন্ট ইত্যাদি দিয়ে ঢালাই করে নির্মিত এ ভাস্কর্যটিতে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ নম্বর সেক্টরের ১০০ জন ও ১১ নম্বর সেক্টরের ১০৭ জন শহীদ সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম উৎকীর্ণ করা আছে।
স্থাপত্য তাৎপর্য
১৯৭১ সালের মার্চ মাস। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর পরই পাকিস্তান সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে তৎপর হয়। পাশাপাশি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করা শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে ১৯ মার্চ, শুক্রবার দুপুরে ঢাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একদল সৈন্য পাঁচটি ভ্যানে জয়দেবপুরে অবস্থিত সেনাবাহিনীর ছাউনিতে পৌঁছে।

তারা ছাউনিতে পৌঁছার পর পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর একটি দলকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সেনাবিদ্রোহের সংবাদ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই স্থানীয় জনগণ জয়দেবপুর শহরে জমায়েত হয় ও তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বড় বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে জনগণ জয়দেবপুর শহরে ঢোকার বা বের হওয়ার একমাত্র রাস্তাটি বন্ধ করে দেয়।

এতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় জনগণের সংঘর্ষ বেধে যায়। একদিকে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, অন্যদিকে মাত্র তিনটি বন্দুক নিয়ে স্থানীয় জয়দেবপুরবাসী। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে ১৪ বছরের হুরমত উল্লাহ, মনু খলিফা সহ ২০ জন নিহত হন ও ১৬ জন আহত হন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা অস্বীকার করে।

সরকারি হিসাব মতে, তিনজনকে নিহত ও পাঁচজনকে আহত দেখানো হয়। বিকেল পৌনে ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এ প্রতিরোধ-গুলিবর্ষণ চলে। এরপর সন্ধ্যা ৬টা থেকে জয়দেবপুরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে বাঙালি হতাহতের ঘটনা ঘটলেও এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ।

আর এই প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ হুরমত উল্যা ও অন্য শহীদদের অবদান এবং আত্মত্যাগকে জাতির চেতনায় সমুন্নত রাখতে জয়দেবপুর চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে স্থাপন করা হয় দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্ম জাগ্রত চৌরঙ্গী।
তথ্যসুত্রঃ ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ- মহাম্মদ আসাদ ও মিল্লাত হোসেন।
=সৌ রভ

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.