যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই
প্রিয়তমা মিলি,
একটা চুম্বন তোমার পাওনা রয়ে গেলো...সকালে প্যারেডে যাবার আগে তোমাকে চুমু খেয়ে বের না হলে আমার দিন ভালো যায় না। আজ তোমাকে চুমু খাওয়া হয় নি। আজকের দিনটা কেমন যাবে জানি না... এই চিঠি যখন তুমি পড়ছো, আমি তখন তোমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। ঠিক কতোটা দূরে আমি জানি না।
মিলি, তোমার কি আমাদের বাসর রাতের কথা মনে আছে? কিছুই বুঝে উঠার আগে বিয়েটা হয়ে গেলো।
বাসর রাতে তুমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যখন কাঁদছিলে, আমি তখন তোমার হাতে একটা কাঠের বাক্স ধরিয়ে দিলাম। তুমি বাক্সটা খুললে... সাথে সাথে বাক্স থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকী বের হয়ে সারা ঘরময় ছড়িয়ে গেলো। মনে হচ্ছিলো আমাদের ঘরটা একটা আকাশ... আর জোনাকীরা তারার ফুল ফুটিয়েছে! কান্না থামিয়ে তুমি অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলে, "আপনি এতো পাগল কেনো!?" মিলি, আমি আসলেই পাগল... নইলে তোমাদের এভাবে রেখে যেতে পারতাম না।
মিলি, আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন প্রিয় কন্যা মাহিনের জন্মের দিনটা। তুমি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলে।
বাইয়ে আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি... আমি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে কষ্টে পুড়ে যাচ্ছি। অনেকক্ষণ পরে প্রিয় কন্যার আরাধ্য কান্নার শব্দ... আমার হাতের মুঠোয় প্রিয় কন্যার হাত! এরপর আমাদের সংসারে এলো আরেকটি ছোট্ট পরী তুহিন.... মিলি, তুমি কি জানো... আমি যখন আমার প্রিয় কলিজার টুকরো দুই কন্যাকে এক সাথে দোলনায় দোল খেতে দেখি, আমার সমস্ত কষ্ট - সমস্ত যন্ত্রণা উবে যায়। তুমি কি কখনো খেয়াল করেছো, আমার কন্যাদের শরীরে আমার শরীরের সূক্ষ একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায়? মিলি... আমাকে ক্ষমা করে দিও।
আমার কন্যারা যদি কখনো জিজ্ঞেস করে, "বাবা কেনো আমাদের ফেলে চলে গেছে?" তুমি তাঁদের বলবে, "তোমাদের বাবা তোমাদের অন্য এক মা'র টানে চলে গেছে... যে মা'কে তোমরা কখনো দেখো নি। সে মা'র নাম 'বাংলাদেশ'; মিলি... আমি দেশের ডাককে উপেক্ষা করতে পারি নি।
আমি দেশের জন্যে ছুটে না গেলে আমার মানব জন্মের নামে সত্যিই কলঙ্ক হবে। আমি তোমাদের যেমন ভালোবাসি, তেমনি ভালোবাসি আমাকে জন্ম দেওয়া দেশটাকে। যে দেশের প্রতিটা ধূলোকণা আমার চেনা। আমি জানি... সে দেশের নদীর স্রোত কেমন... একটি পুটি মাছের হৃৎপিন্ড কতটা লাল, ধানক্ষেতে বাতাস কিভাবে দোল খেয়ে যায়....!
এই দেশটাকে হানাদারের গিলে খাবে, এটা আমি কি করে মেনে নিই? আমার মায়ের আচল শত্রুরা ছিঁড়ে নেবে... এটা আমি সহ্য করি কিভাবে মিলি? আমি আবার ফিরবো মিলি... আমাদের স্বাধীনদেশের পতাকা বুক পকেটে নিয়ে ফিরবো। আমি, তুমি, মাহিন ও তুহিন... বিজয়ের দিনে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়াবো সবাই।
তোমাদের ছেড়ে যেতে বুকের বামপাশে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে... আমার মানিব্যাগে আমাদের পরিবারের ছবিটা উজ্জ্বল আছে... বেশি কষ্ট হলে খুলে দেখবো বারবার।
ভালো থেকো মিলি... ফের দেখা হবে। আমার দুই নয়ণের মণিকে অনেক অনেক আদর।
ইতি,
মতিউর।
২০ আগস্ট, রোজ শুক্রবার, ১৯৭১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।