মানুষ নিদ্রিত এবং মৃত্যুর পরপরই সে জেগে উঠবে।
সিকিম ভারতের উত্তরাংশে অবস্থিত তিব্বতের পাশের একটি রাজ্য। রাজ্যটির স্বাধীন রাজাদের বলা হত চোগওয়াল। ভারতে বৃটিশ শাসন শুরুর পুর্বে সিকিম তার পার্শ্ববর্তী নেপাল আর ভুটানের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। বৃটিশরা আসার পর তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নেপালের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় সিকিম।
এসময় রাজা ছিলেন নামগয়াল। কিন্তু বৃটিশরা তিব্বতে যাওয়ার জন্য এক সময় সিকিম দখল করে নেয় এবং ১৮৮৮ সালে রাজা নামগয়াল আলোচনার জন্য কলকাতা গেলে তাঁকে বন্দী করা হয়।
পরবর্তী সময়ে ১৮৯২ সালে তাকে মুক্তি দেয়া হয় এবং সিকিমের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়া হয়। প্রিন্স চার্লস ১৯০৫ সালে ভারত সফরে আসলে সিকিমের চোগওয়ালকে রাজার সম্মান দেয়া হয়। চোগওয়ালপুত্র সিডকং টুলকুকে অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করতে পাঠানো হয়।
টুলকু নামগয়াল ক্ষমতায় বসে সিকিমের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। বৃটিশের কাছে সিকিম তার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা লাভ করে।
পরবর্তী চোগওয়াল (রাজা) থাসী নামগয়ালের সময়ে বৃটিশরা ভারত ছেড়ে গেলে গণভোটে সিকিমের মানুষ ভারতের বিরুদ্ধে রায় দেয় এবং ভারতের পন্ডিত নেহরু সিকিমকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হন।
১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর সিকিমের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ১৯৬৩ সালে থাসী নামগয়াল এবং ১৯৬৪ সালে নেহরু মারা গেলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
চোগওয়াল হন পাল্ডেন থন্ডুপ নামগয়াল। এ সময় ভারতের প্রধানমস্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সর্বশক্তি নিয়োগ করেন সিকিমকে দখল করার জন্য। তিনি কাজে লাগান সিকিমের প্রধানমন্ত্রী কাজী লেন্দুপ দর্জিকে। ১৯৭০ সালে নেহেরু প্রভাবিত সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসকে লেন্দুপ দর্জি ব্যবহার করে অরাজকতা সৃষ্টি করেন। রাজপ্রাসাদের সামনে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে ইন্দিরা সরকার রাজার নিরাপত্তার কথা বলে ভারতীয় বাহিনী পাঠায়।
কিন্তু তারা রাজাকে গৃহবন্দী করেন। বহির্বিশ্বের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং বিএস দাশকে ভারত সরকার সিকিমের প্রধান প্রশাসক নিয়োগ করে। এই সময় আমেরিকান এক পর্বতারোহী গোপনে সিকিম প্রবেশ করেন এবং সিকিমের স্বাধীনতা হরণের খবর বিশ্বের নিকট তুলে ধরেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে যায়। সিকিম
জাতিসংঘের সদস্য পদভুক্তিরও প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
LENDUP DORJEE KHANGSARPA : The First Chief Minister of Sikkim (1975-1979)
এর মধ্যে ভারতের তাঁবেদার লেনদুপ দর্জির নেতৃত্বাধীন সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস (এসএনসি) ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পার্লামেন্টের ৩২ আসনের মধ্যে ৩১টি আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে জিতে ২৭ মার্চ ১৯৭৫ প্রথম ক্যাবিনেট মিটিং-এ প্রধানমন্ত্রী লেনদুপ দর্জি রাজতন্ত্র বিলোপ ও জনমত যাচাইয়ে গণভোটের সিদ্ধান্ত নেন। ততদিনে সিকিমে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে। তারা বন্দুকের মুখে ভোটারদের ‘হ্যাঁ' ভোট দিতে বাধ্য করে। পুরো ঘটনা ছিল সাজানো।
৬ এপ্রিল ১৯৭৫ সালের সকালে সিকিমের রাজা যখন নাস্তা করতে ব্যস্ত সে সময় ভারতীয় সৈন্যরা রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে এবং রাজাকে বন্দী করে প্রাসাদ দখল করে নেয়। তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে গ্রাস করে ভারতের প্রদেশে পরিণত করে। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো সিকিম সেনাবাহিনীকে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী।
ভারতীয় সাংবাদিক সুধীর শর্মা ‘পেইন অব লুজিং এ নেশন' (একটি জাতির হারিয়ে যাওয়ার বেদনা) নামে একটি প্রতিবেদনে জানান, ভারত তার স্বাধীনতার গোড়া থেকেই সিকিম দখলের পরিকল্পনা করেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহেরু অনেকের সাথে কথোপকথনে তার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র'-এর সাবেক পরিচালক অশোক রায়না তার বই ‘ইনসাইড স্টোরী অব ইন্ডিয়াস সিক্রেট সার্ভিস'-এ সিকিম সম্পর্কে লিখেন, ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৯৭১ সালেই সিকিম দখল করে নেয়া হবে। সে লক্ষ্যে সিকিমে প্রয়োজনীয় অবস্থা সৃষ্টির জন্য আন্দোলন, হত্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছিল। তারা ছোট ছোট ইস্যুকে বড় করার চেষ্টা করে এবং সফল হয়। তার মধ্যে হিন্দু- নেপালী ইস্যু অন্যতম। সাংবাদিক সুধীর শর্মা লিখেন, লেনদুপ দর্জি নিজেই শর্মাকে বলেছেন, ‘ভারতের ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর লোকেরা বছরে দু'তিনবার তার সাথে দেখা করে পরামর্শ দিত কিভাবে আন্দোলন পরিচালনা করা যাবে।
তাদের একজন এজেন্ট তেজপাল সেন ব্যক্তিগতভাবে তাকে অর্থ দিয়ে যেতো এআন্দোলন পরিচালনার জন্য। এ অর্থ দিয়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাস পরিচালিত হতো। 'শর্মা আরো লিখেছেন, এই ‘সিকিম মিশনের' প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা, যা সর্বত্র ‘র' নামে পরিচিত।
ক্যাপ্টেন ইয়াংজু লিখেছেন, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বেসামরিক পোশাকে রাজার বিরুদ্ধে গ্যাংটকের রাস্তায় মিছিল, আন্দোলন ও সন্ত্রাস করত। নেহেরুর পরামর্শ, মদদ ও উৎসাহে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠন করেছিলেন লেনদুপ দর্জি।
শ্লোগান তুলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলছে, চলবে'। লেনদুপ দর্জির গণতন্ত্রের শ্লোগান শুনে সিকিমের সাধারণ জনগণ ভাবতেই পারেনি, এই শ্লোগানের পিছনে প্রতিবেশী দেশ একটি জাতির স্বাধীনতা হরণ করতে আসছে। সিকিমের জনগণকে দ্বিধাবিভক্ত করে ভারত তার আগ্রাসন সফল করতে এবং এক পকে মতায় এনে তাদের দ্বারা দেশ বিক্রির প্রস্তাব তুলে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল। সিকিমের মত ঘটনার অবতারণা বাংলাদেশেও যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে দলমতনির্বিশেষে সকলকে সচেতন থাকতে হবে। কারণবাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের প্রতিরা ভারত দিনের পর দিন জোরদার করে চলেছে।
এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের ভেতরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে চলেছে। এই কার্যক্রমের আওতায় বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত সীমান্ত আউট পোস্টগুলোর (বিওপি) একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার
থেকে হ্রাস করে ৪/৫কিলোমিটারে নিয়ে আসা হচ্ছে এবং এগুলোতে বিএসএফ-এর শক্তি দ্বিগুণ করা হচ্ছে।
বিএসএফ এই সীমান্তে থারমাল নাইটভিশন ডিভাইস, টেলিস্কোপিক বন্দুকসহ উচ্চমানের হাতিয়ার মোতায়েন রেখেছে। এই সঙ্গে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার এলাকাকে কাঁটাতারের বেড়াসহ ফাড লাইটের আওতায় আনার এবং প্রশিতি কুকুর মোতায়েন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে অনেকটা এগিয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তের ২৭৭ কিলোমিটার এলাকা ফাড লাইটের আওতায় আনার কাজ দু'বছর আগেই সম্পন্ন হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৯৯ সালের কারগিল কনফিক্টের পর থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিরোধ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত- প্রতিরা শক্তিশালী করার এই উদ্যোগ
নেয়া হয়। ভারত তার বাংলাদেশ সীমান্তে প্রথম পর্যায়ে ৮৫৪ কিলোমিটার এলাকায় বেড়া নির্মাণ করে এবং একই সঙ্গে পাকা সড়ক নির্মাণ করে ২ হাজার ৬শ' ৬ কিলোমিটারের বেশী এলাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো ২ হাজার ৪শ' ৩০ কিলোমিটার এলাকায় বেড়া নির্মাণ, ৭শ' ৯৭ কিলোমিটার সড়ক এবং ২৪ কি.মি সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেছে । প্রকল্পের আওতায় পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম সীমান্তে বেড়া ও সড়ক নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে।
২০০৬ সাল নাগাদ ভারত মোট ২ হাজার ৫শ' ৩৬ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া এবং ৩ হাজার ২শ' ৫১ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণ সম্পন্ন করেছে বলে ভারতীয় একটি সূত্রে জানা গেছে।
যদিও ১৯৭৪ সালের ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোন প্রতিরোধ কাঠামো নির্মাণ করা নিষিদ্ধ, তবুও ভারত তা করে চলেছে। বলাবাহুল্য, কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ও সড়ক তৈরী প্রতিরা কাজের মধ্যেই পড়ে । ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত দু'দেশের বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হলেও তা কোন ফল দেয়নি। ভারতের বর্তমান প্রস্তুতি অনুযায়ী সীমান্ত সড়ক দিয়ে অনায়াসে সমর যানবাহন চলাচল করতে পারবে।
এরফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিরোধ ব্যবস্থাও জোরদার করতে পারবে। ভারতের বর্ডার আউট পোস্ট-বিওপি'র সংখ্যা পূর্বের তুলনায় অন্তত তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে এগুলোতে মোতায়েন জওয়ানের সংখ্যাও সে তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গেছে। একারণেই বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে ‘সিকিমফোবিয়া' কাজ করছে প্রবলভাবে। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের অবিশ্বাসের অন্যতম কারণ হলো বাংলাদেশও সিকিমের পরিণতি বরণ করে কিনা।
আর সে ধরনের পরিবেশ সৃষ্টিতে এজেন্ট তৈরীর নানা প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে । বড় দেশ হিসেবে ভারতের অন্যতম কৌশল হলো, ছোট দেশের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, কূটনীতিক পর্যায়ের প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তিবর্গের
মগজগুলো কিনে নেয়া। ভারত যদি বাংলাদেশকে স্বাধীন-স্বার্বভৌম দেখতে চায় তবে মাথা কেনার কৌশল বাদ দিতে হবে। এই বিষয়গুলোর ব্যাপারেও ভারতের কাছ থেকে ব্যাখ্যা-বক্তব্য আসা উচিত- যাতে বাংলাদেশের মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর হতে পারে । তাছাড়া নতুন বাঙালী প্রজন্মকে সিকিমের করুণ পরিণতির ইতিহাস জানাতে হবে।
ইতিহাস বলে,ভারত সিকিমে এ কৌশলে চেষ্টা করে সফল হয়েছে। এখানেও সেই চেষ্টা করছে বলে অনেকেই সন্দেহ করেন। এসব কাজ অব্যাহত থাকলে সেটা হবে অবন্ধুসুলভ। মূলতঃ সিকিমের ইতিহাস হলো ভারতের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরন ।
=======================
পিন্ডির শৃঙ্খল ভেঙেছি দিল্লীর গোলামীর জন্য নয়।
সিকিম কত দূর পাঞ্জেরী ?
========================
সমাপ্ত।
(সংগৃহীত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।