আবার আসিব ফিরে এই বাংলায় আঁধার ঘরে ইঁদুর নাচে বেড়াল বাজায় ঢোল,
ছাগল বলে ঘোড়ারে তোর ডিমটা কেন গোল?
ঘোড়া সাহেব হেসে বলেন শুনরে বেটা গাধা-
এইটে হলো এই জগতের সবচে বড় ধাঁধা।
লিখার হাত মোটেও ভাল নয় আমার। অভ্যাসও নেই তেমন। কিভাবে শুরু করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই অপ্রাসঙ্গিক ছড়া মতন কিছু একটা দিয়ে শুরু করলাম।
আগেই বলে নিচ্ছি, লিখার হাত আমার একদম ভাল না। কেউ কষ্ট করে পড়ে যদি আমাকে বোকা ভাবেন, কিংবা কারো চোখ যদি কপালে উঠে যায়, অথবা কেউ যদি রেগে গিয়ে তেড়ে আসেন- আমার কিচ্ছুটি করার নেই। কেননা লিখতে পারি আর না পারি, কেউ পড়ুক আর না পড়ুক, আজ আমাকে লিখতেই হবে। যাহোক, কথায় কথায় অনেক কথাই বলে ফেললাম। এবার আসল কথায় আসি।
কথাটা হচ্ছে- আরেকটা কথা। বানান ভুল, উপমার ভুল প্রয়োগ কিংবা সাধু-চলিত মিশ্রণের জন্য বরাবরই পরীক্ষার খাতায় নম্বর কম পেতাম আমি। পুরনো অভ্যাস। আজও হয়তো ব্যতিক্রম হবেনা। কি করব, লিখার হাত আমার একদম ভাল না।
২৬ ডিসেম্বর, ২০১২। দুপুর দুইটা বেজে দশ মিনিট। অপরাজেয় বাংলার পাশে দাড়িয়ে সহিদুল ভাই তার এক মেয়ে বন্ধুর সাথে কথা বলছিলেন। মেয়ে বন্ধু, ‘গার্ল ফ্রেন্ড’ বলতে আমি যা বুঝি তা কিন্তু নয়। কলা অনুষদের ডীন অফিসের সামনে আমি দাড়িয়ে।
আমার মতো অনেকেই সেখানে। সবাই গল্প গুজব করছে। ভাইভা রুমে কখন ডাকবে, আড়াইটা বাজতে আর কতক্ষণ, ওর বাড়ি কই, তার পজিশন কতো, সে কোন্ কলেজের স্টুডেন্ট, ঐ ছেলেটা হাসছে কেন, ঐ মেয়েটা একটু বেশিই লম্বা ইত্যাদি হাবিজাবি আরো কতো কি! আমি একদম চুপচাপ দাড়িয়ে। একেতো গ্রামের ছেলে, তার ওপর ছোটবেলা থেকেই খানিকটা গুমড়ো মুখো ভাব। কারো সাথেই মিশতে চাইনা।
কি করে মিশতে হয় জানিনা হয়তো। যাহোক, ঠায় দাড়িয়ে রয়েছি এমন সময় সামনে থেকে একজন জিজ্ঞেস করলো ভর্তি পরীক্ষায় আমার মেধাক্রম কতো। আমি সামান্য লজ্জিত হয়েই জবাব দিলাম। ওপাশ থেকে আরেক জন জানতে চাইলো বাংলা-ইংরেজিতে কতো নম্বর পেয়েছি। আমি উত্তর দেবার আগেই সে বলতে লাগলো আমাদের ভর্তি পরীক্ষার মেধাক্রমের চেয়ে কন্ডিশনটাই (বাংলা-ইংরেজিতে প্রাপ্ত নম্বর) বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তারপর প্রথম জন সামনের নোটিসটা দেখিয়ে বলল যে তখনো মোটামুটি ভাল কয়েকটা সাবজেক্টের আসন খালি রয়েছে। এবং কয়েকটা সাবজেক্টের নাম বলে আমাকে আশ্বস্ত করলো আর বলল যে আমার কন্ডিশন মোটামুটি ভাল হওয়ায় সেসব থেকে একটা সাবজেক্ট আমি অবশ্যই পাবো। আমি শুধু বললাম বাংলা হলেই আমার যথেষ্ট। শুনে দু’জনেই একটু বিস্মিত হলো। একজন বলল, আজব! বাংলা কেন, এর চেয়ে ভালটাই পাবা।
তারপর জানতে চাইলো সাবজেক্ট চয়েস ফর্মে কোন্ কোন্ সাবজেক্ট দিয়েছি। কিন্তু তা আর বলা হলো না। কেননা ততোক্ষণে ভাইভা কক্ষে আমাদের ভাইভা শুরু হয়ে গেছে।
হাতে মনোনয়ন ফর্ম আর মুখে কৃতিত্বের হাসি। বের হয়ে আসলাম ভাইভা কক্ষ থেকে।
উৎসুক শিক্ষার্থীদের কয়েক জন জানতে চাইলো কি সাবজেক্ট পেলাম। আমি উৎফুল্লের সঙ্গে জবাব দিলাম। কিন্তু একি কাণ্ড! কারো মুখেই আর কোনো কথা নেই। যাদের ওপর দৃষ্টি পড়লো, দেখলাম সবার চেহারাতেই তাচ্ছিল্যের ভাব। যেন এই সাবজেক্টে পড়ার চেয়ে গার্লস্ স্কুলের গেইটে চার চারটা বছর পার করে দেওয়াও ঢের সম্মানের কাজ! যাহোক বাইরে এসে মনোনয়ন ফর্মটা সহিদুল ভাইয়ের হাতে দিলাম।
উনি ইতিবাচক ভাবেই সাড়া দিলেন এবং পরবর্তী ভর্তি কার্যক্রম সম্পর্কে আমাকে খানিকটা ধারনা দিলেন। এখানে সহিদুল ভাই সম্পর্কে একটু বলি। উনি ঢাবিতে ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। আমার দুর সম্পর্কের মামাতো ভাই। যদিও কোনো রকমে ঠেলেঠুলে ঢাবিতে চান্স পেয়েছি আমি।
এক্ষেত্রে সহিদুল ভাইয়ের ভূমিকা আসলেই অনস্বীকার্য। তার উৎসাহ আর পরামর্শ পেয়েই সর্বনিম্ন যোগ্যতাটুকু নিয়েও আমার ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার মতো স্পৃহা তৈরি হয়েছিল। অবশ্য অনেকের কাছে ঢাবিতে চান্স পাওয়াটা হয়তো ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়াবার মতো সাফল্যের বিষয় নয়। তবে আমার কাছে সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার মতোই সাফল্য বটে। যাহোক, অতঃপর সহিদুল ভাই জানতে চাইলেন ভাইভা কক্ষে কি কি করলাম।
আমি বলতে থাকলাম- প্রথমে ঢুকলাম। চেয়ারে বসতে বলা হলো, বসলাম। ধাপে ধাপে কয়েকজন লোক আমার কাগজপত্র চেক করলেন। তারপর আরেকটি কক্ষে যেতে বলা হলো, গেলাম। সেখানে একজন শিক্ষক আমাকে একটি ফর্মে কতগুলো সাবজেক্টের নাম দেখিয়ে বললেন যে এই এই সাবজেক্ট গুলো থেকে যে কোনো একটিতে আমি ভর্তি হতে পারবো।
এতক্ষণ সহিদুল ভাইয়ের সেই মেয়ে বন্ধুটি তেমন খেয়াল করেন নি। হঠাৎ অনেকটা বিস্মিত হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আর কি কি সাবজেক্ট ছিল? যে কয়টা মনে ছিল সে কয়টা সাবজেক্টের নাম বলে আমি উনার দিকে উৎসাহের দৃষ্টিতে তাকালাম। কিন্তু বিধি বাম! উনি যেন রীতিমত ভিরমি খেলেন। ইয়া আল্লাহ!! এসব সাবজেক্ট থাকতে তুমি বাংলা? বাংলাতে? বাংলার ভবিষ্যৎ কি? কি করবা বাংলা পড়ে?
উনার প্রশ্নের উত্তর দিতে মোটেও ইচ্ছে হচ্ছিলনা আমার। শুধু বললাম, ভবিষ্যৎ আর কি; ডালভাত জুটলেই হলো।
আমি আশাহত নই। এতটুকুন শঙ্কিতও নই। শুধুমাত্র খানিকটা হতাশাগ্রস্ত। হতাশা আমার সাবজেক্টের জন্য নয়। কিংবা কারো নেতিবাচক মন্তব্যের জন্যও নয়।
আমি হতাশ কেবল সেইসব অথর্ব দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন মানুষদের মানসিকতা দেখে যারা মনে করে, জগতের সকলেরই তাদের মতো অর্থ পিয়াসী হওয়া উচিৎ। কিন্তু আমি বলি কি- সবাই তো আর এক গোয়ালের গরু নয়।
বাড়ি ফেরার পথে বাসে একজনের সঙ্গে পরিচয়। দেখতে খুব সুদর্শন। কোন্ এক মেডিকেল কলেজে যেন ডাক্তারি পড়ছেন আমার ঠিক মনে নেই।
তার সঙ্গেও বাংলা পড়া নিয়ে একটা মাঝারি রকমের চাপা তর্কযুদ্ধ হয়ে গেলো। আসলে আবেগ দিয়ে জীবন চলেনা। ভাবের দুনিয়ায় পড়ে থাকলে অনেক সময় খাবারও জোটেনা। মানুষ শিক্ষার্জন করে সুন্দর ও সুখী একটা জীবন Lead করার জন্য। জীবনে বড় হওয়ার জন্য।
এক্ষেত্রে ভাল একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগোপযুগী একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশুনা করা আসলেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তুমি বরং ভর্তির পর সাবজেক্ট মাইগ্রেশনের জন্য অ্যাপ্লিকেশন করো। মোটামুটি জুতসই একটা সাবজেক্ট পেলেও পেতে পারো।
এভাবেই দক্ষ চিকিৎসকের মতন উনি আমাকে ভাল-মন্দ আর সুখ-দুঃখের ট্যাবলেট খাইয়ে দিলেন। আমি তখন তেমন কিছুই বলতে পারিনি।
কিংবা বলিনি হয়তো।
এখন আপনাকে আপনিই প্রশ্ন করি- জীবনে বড় হওয়ার মানে কি? জীবনে বড় হওয়ার মানে যদি হয় অগাধ সম্পদ আর কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জন; তবে আমি বলবো- কখনোই বড় হতে চাইনা। আমি গোটা জীবনটাকে বড় করতে চাই। আমি বুঝতে চাই এবং বুঝাতে চাই; জীবনে খাওয়া-পড়া, ভোগ-বিলাস ছাড়াও আরো অনেক কিছু করার থাকে। যা উপলব্ধি করার জন্য শরৎ বাবুর কোনো একটা উপন্যাসের অতি সাধারণ কোনো একটা চরিত্র হতে পারলেই যথেষ্ট।
লিখার হাত আমার একদম ভাল নয়। কেননা আমি লেখক নই। কখনো আমাকে দিয়ে লেখালেখি হবে- এমনটাও ভাবা যায় না। আমার ছোট্ট মাথায় অত ভাবনা ধরবে কেন? আমি অত মেধাবী নই। যাহোক, সেই সুদক্ষ ডাক্তারের দেয়া ভাল-মন্দ আর সুখ-দুঃখের ট্যাবলেট আমার মতিভ্রম অসুখটাকে একটুও সারাতে পারেনি।
কিন্তু তবুও ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেন জানি ভয় পেতে শুরু করেছি। দশচক্রে ভগবান ভূত! কথাটা আসলেই মিথ্যে নয়। দিনদিন স্পৃহা কমে যাচ্ছে। কি মনে করে যে ওরা বায়ান্নতে প্রাণ দিতে গেলো। রক্ত দিয়ে নাকি বাংলাকে করেছে রাষ্ট্রভাষা! সেই ভাষা, সেই ভাষার সাহিত্য; সেসবের একটুখানি স্পর্শ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল আমি ঢাবির বাংলা বিভাগে ভর্তিচ্ছু এক শিক্ষার্থী।
কেন জানি আজ আমারো খুব জানতে ইচ্ছে করছে- আমার ভবিষ্যৎ কি?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।