আমি সত্য জানতে চাই
আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর স্থান এখন প্রায় শীর্ষে। শুধু বাংলাদেশের নয়, পৃথিবীর সমগ্র বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়) পর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পাশাপাশি তাঁর নাম সর্বাগ্রে উচ্চারণ করতে হবে। লেখকি সততা, নির্মোহ দৃষ্টি ভঙ্গি, গভীর জীবনবোধর মতো বিরল গুণাবলি বাংলা সাহিত্যের যে ক’জন লেখক অর্জন কতে সক্ষম হয়েছেন তাঁদের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অন্যতম। ষাটের দশকে লেখালেখি শুরু করে আমৃত্যু তিনি লিখেছেন এবং বাংলা গদ্যসাহিত্যকে শক্তিশালী ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে গেছেন।
যদিও তিনি ছিলেন স্বল্পপ্রজ লেখক। মাত্র দুইটি উপন্যাস, গোটা পাঁচেক গল্পগ্রন্থ আর একটি প্রবন্ধ সংকলন এই নিয়ে তাঁর রচনাসম্ভার। তবে তাঁর লেখায় বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ তাঁর রচনাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী সুষমা। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ'র পরেই তিনি সর্বাধিক প্রশংসিত বাংলাদেশী লেখক। তাঁর প্রথম উপন্যাস ’চিলেকোঠার সেপাই’ পাঠক মহলে তুমুল জনপ্রিয়তা অজর্ন করে।
এই গুনী কথা সাহিত্যিক ১৯৯৬ সালের ৪ জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরন করছি আমাদের গভীর শ্রদ্ধায় ।
আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ১৯৪৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম মঞ্জু।
পুরো নাম আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। তাঁর বাবা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৪৭-১৯৫৩) এবং মুসলিম লীগে পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম বেগম মরিয়ম ইলিয়াস। আখতারুজ্জামান ১৯৪৯ সালে ঢাকার সেন্ট ফ্র্যান্সিস জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন।
১৯৫০ সালে এ স্কুলটি ছেড়ে ঢাকার কেএল জুবিলি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। তৃতীয় শ্রেণীতে না পড়েই ১৯৫১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াশুনা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে তাঁর পরিবার ঢাকা থেকে বগুড়াতে চলে যায়৷ তখন আবার ইলিয়াসকে স্কুল পরিবর্তন করতে হয়। বগুড়াতে গিয়ে তিনি ভর্তি হন বগুড়া জেলা স্কুলে। ১৯৫৮ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করার পর আবার ঢাকায় চলে আসেন ইলিয়াস এবং ভর্তি হন ঢাকা কলেজে।
তখন পরিবারের সবাই বগুড়াতে থাকার কারণে ঢাকা কলেজের নর্থ ছাত্রাবাসে থাকতেন তিনি। ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বে পড়ার আগ্রহ ছিল ইলিয়াসের। কিন্তু সে বছর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তুপক্ষ সমাজতত্ত্বে কোনো ছাত্র ভর্তি করলেন না। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁকে ভর্তি হতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।
থাকতেন ফজলুল হক মুসলিম ছাত্রাবাসে। ১৯৬৪ সালে ইলিয়াস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ পাস করেন।
আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াসের কর্মজীবন শুরু হয় জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে। এরপর তিনি মিউজিক কলেজের উপাধ্যক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক, ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
কর্মজীবনে আখতারুজ্জামান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম সুরাইয়া তুতুল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন, গোপনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তাঁর লেখা প্রতিশোধ, অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, মিলির হাতে স্টেনগান, অপঘাত, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, রেইনকোট প্রভৃতি গল্পে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা।
১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলেও সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে বাকশালে যোগ দেওয়ার চাপ থাকলেও যোগ দেননি।
(১৯৯৩ সালে আহমদ ছফা ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস)
দায়বন্ধতা থেকেই তিনি পরম দরদে তুলে এনেছেন সমাজের নিচু তলার নিষ্পেশিত মানুষের শ্রেণী জীবন। এনেছেন তাদের বিচিত্র জীবনযাত্রা, বিশ্বাস, দুঃখ-আনন্দ, ক্ষোভ, সংস্কার, অনুভুতি, সংলাপ। যেন রাষ্ট্রের চরিত্র ও মানুষের গণসংগ্রামের মিথস্ক্রিয়া। ক্ষণজন্মা এই লেখক কখনোই সস্তা জনপ্রিতা বা বণিক বুদ্ধিতে লিখেন নি।
দু’টি উপন্যাস, পাঁচটি ছোট গল্পগ্রন্থ আর একটি প্রবন্ধ গ্রন্থই তাঁর রচনা সম্ভার। তাঁর কালোত্তীর্ণ লেখা জন্ম-মৃত্যু নির্ধারিত জীবন অবলীলায় ছাড়িয়ে যায়। সমাজ বাস্তবতা, শ্রমজীবি মানুষের কথা বারবার ফিরে এসেছে। তার তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমুহের মধ্যে রয়েছেঃ
উপন্যাসঃ ১। চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৭), ২।
খোয়াবনামা (১৯৯৬)
ছোট গল্প সংকলনঃ ১। অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬), ২। খোঁয়ারি (১৯৮২), ৩। দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৫), ৪। দোজখের ওম (১৯৮৯), ৫।
জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল (১৯৯৭)
প্রবন্ধ সংকলনঃ ১। সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু (২২টি প্রবন্ধ)
রাজনীতি আমাদের জীবনের একটি প্রধান নিয়ামক হলেও আমাদের সাহিত্যে সরাসরি রাজনৈতিক প্রসঙ্গিক প্রসঙ্গ ব্যাপকভাবে বিবেচিত হয়নি। রাজনীতির সঙ্গে লেখকরা সবসময়ই নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখেছেন। ইলিয়াসই প্রথম এতটা সার্থক শিল্পসম্মতভাবে প্রধান দুটি আন্দোলনকে তার দুই উপন্যাসে ধারন করলেন। চিলেকাঠার সেপাই উপন্যাসে তিনি উপজীব্য করেছেন এ দেশের রাজনীতির পাকিস্তান পর্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ঊনসত্তরের গণআন্দোলনকে।
এটি অবলম্বনে পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার শেষ ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস খোয়াবনামার মূল প্রসঙ্গ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি জনপদে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রভাব। এই উপন্যাসের জন্য ১৯৯৬ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও সাহিত্যে অসমান্য অবদানের জন্য আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৯৭৭ সালে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে আনন্দ পুরস্কার, সাদাত আলী আখন্দ পুরস্কার. কাজী মাহবুবুল্লাহ স্বর্ণপদক এবং ১৯৯৯ সালে মরোণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন।
১৯৯৭ সালে ৪ জানুয়ারি ঘাতকব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে এ শক্তিমান লেখকের মহাপ্রয়াণ ঘটে।
শারীরিক মৃত্যুহলেও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যের শীর্ষে অধিষ্ঠিত থেকে অমর হয়ে থাকবেন। আজ এই গুনী কথা সাহিত্যিকের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরন করছি আমাদের গভীর শ্রদ্ধায় ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।