আমার একটা গ্রুপ আছে ফেসবুকে। ক্রিয়েটিভ লোকজনদের জন্য। কেউ নিজের লেখা গদ্য, নিজের সৃষ্ট পদ্য, কেউ কলাম, কেউ বা নিজের আঁকা কার্টুন পোস্ট করে। গ্রুপটির নাম ক্যানভাস।
ক্যানভাসের কার্টুনিস্ট Rafael Mursalin একটি চমত্কার কার্টুন পোস্ট করেছেন।
সারমর্ম হচ্ছে, দেশকে বদলানোর আগে নিজেকে বদলানো জরুরী। তার সাথে সম্পূর্ন সহমত পোষন করছি। নিজে না বদলালে দেশ বদলাবে কী করে? নিজেকে বদলানোটাই কিন্তু সবচেয়ে সহজ। ইচ্ছে থাকলেই সেটা সম্ভব। সবসময়ের মতই নিজেরই একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, দেশে কাজের লোক সহজলভ্য। ঘরের টুকিটাকি কাজের জন্য মায়েদের সবসময়েই হিমশিম খেতে হয়। তাদের সাহায্য করতেই একজন কাজের লোক রাখা হয়। যে ঘর ঝাড়ু দিয়ে, কাপড় কেঁচে, আসবাবপত্রের ধূল ঝেড়ে, মাঝে মাঝে বাজার করেও সাহায্য করে থাকে। এই ব্যপারটাই আবার আমাদের দেশের জন্য একটা অভিশাপ।
আমরা সবাই কাজের লোকের উপর নির্ভরশীল হয়ে যাই। তাই দেখা যায় ভ্যাকুয়াম মেশিন, ওয়াশিং মেশিন, ডিশ ওয়াশার এইসব গৃহস্থালী যন্ত্রপাতির সৃষ্টি সেসব দেশেই হয়, যেসব দেশের গৃহিনীদের (সাথে গৃহকর্তাদেরও) নিজের কাজ নিজেদেরই করতে হয়। একটা সময় আমাদের খানদানি কাজের লোক ছিল। আমার দাদার আমলে তাদের মা কাজের মেয়ে হিসেবে আমাদের পরিবারে আসে। কাজের মেয়েটির বিয়ে হয় আমাদেরই আরেক কাজের লোকের সাথে।
তাদের বাচ্চা-কাচ্চাও আমাদের কাজের লোক হয়। সময়মত ওদের মেয়েগুলোর বিয়েশাদী দেয়া হয়। মোটামুটি ভাল জায়গাতেই তাদের বিয়ে হয়েছে। তাদের নিজেদের বাসাতেই এখন দুই তিনটা করে কাজের লোক আছে। ছেলে গুলোকে সৌদি আরব, দুবাই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
অনেকদিন তারা কোন যোগাযোগ করেনা, তবে খারাপ থাকার কথা না। ওরা চলে যাবার পরে আমাদের বাসায় অনেকদিন কোন 'আবাসিক' কাজের লোক রাখা হয়নি। কারণ ছিল, আমার আম্মুর সাংঘাতিক শুচিবায়ী স্বভাব। কাজের মেয়ে, সে যতই পরিষ্কার থাকুক না কেন, আম্মু তার হাতের রান্না খেতে পারেনা। আমাদেরও সেই স্বভাব ছিল অনেক বছর পর্যন্ত।
আর ঘরের অন্যান্য টুকিটাকির জন্য ছুটা বুয়াতো আছেই। একদিন আব্বু সুনামগঞ্জ থেকে এক মেয়ে নিয়ে আসলো। মেয়ের বয়স হবে নয়-দশ বছর, নাম জমিলা। সে আমাদের বাসায় কাজ করবে। খুবই ভাল! আম্মু প্রথম যে কাজটি করলেন তা হচ্ছে, তার হাতে একটা সাবান ধরিয়ে দিয়ে বাথরুম দেখিয়ে বললেন ভাল করে সাবান ঘসে গোসল করতে।
অনেকক্ষন হয়ে যাবার পরেও মেয়েটি বেরোচ্ছে না এবং বাথরুমে পানি ঢালার কোন শব্দ হচ্ছে না দেখে আম্মু বাথরুমে ঢুকে দেখে মেয়েটি তখনও বোকার মত বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না 'চাপকল' না থাকলে পানি কিভাবে আসবে? এই মেয়ে জীবনেও কল দেখেনি! শুধু তাই না। সন্ধ্যায় তার জন্য অপেক্ষা করছিল আরও বড় বিস্ময়। সে অবাক হয়ে টিউব লাইট, বাল্বের দিকে তাকিয়ে থাকতো। আগুন ছাড়াই যে শুধু মাত্র একটি বোতাম চাপ দিলে বাতি জ্বলা সম্ভব এ যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না।
ইলেক্ট্রিসিটির অস্তিত্ব সম্পর্কে তার আগে কোনই ধারনা ছিল না!আমার বয়স তখন আট কি নয়। বোধ শক্তি তেমন জন্মায়নি। বাচ্চারা নাকি ফেরেস্তা হয়ে থাকে। আমি বুঝতে পারলাম না, আমি কী কারনে শয়তান ছিলাম!এই মেয়েটিকে কারনে অকারনে আমি মারতাম। মেয়েটি প্রায় আমারই সমবয়সী ছিল।
তাই আমার আঘাতে তার ভালই ব্যথা পাবার কথা! আব্বু-আম্মু বুঝাতেন কাউকে শুধু শুধু মারলে আল্লাহ খুব রাগ করেন, গুনাহ দেন। তারপরেও আমার কোন পরিবর্তন হয়নি। কাউকে মারছি, অথচ সে কিছুই করতে পারছে না, এ এক অন্যরকম আনন্দ! অল্প বয়সে ক্ষমতাবান হয়ে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক ব্যপার!একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি জমিলা নাই। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা কিছুক্ষন রাস্তায় নেমে আসেপাশের বাড়িঘরে খোঁজ খবর নিয়েছি, কেউ দেখেনি।
মেয়েটি পালিয়ে গেছে ঘর ছেড়ে। খুব সম্ভব, আমারই অত্যাচারে। আব্বু আম্মু দুইজনই কিছুটা আপসেট ছিলেন। একটি 'জংলি' মেয়েকে নিজের পরিচিত পৃথিবী থেকে শহরে নিয়ে এলেন, এখন সে অচেনা একটা শহরে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কে জানে? আমার কোনই ভাবান্তর হয়নি। দূষিত শহরের আসল চেহারা আমি তখনও দেখিনি বলেও হতে পারে, আবার আমি ছোটবেলায় ফেরেস্তার পরিবর্তে শয়তান ছিলাম বলেও হতে পারে।
আমাদের বাড়িতে আরেকটা কাজের মহিলা রাখা হলো এরও কয়েক বছর পরে। মহিলার স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। মহিলা রাগ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, অথবা তাকে বের করে দিয়েছে, এখন মনে নেই। আম্মু খুব করে শাসিয়ে দিলেন, "খবরদার! একে মারধর করবে না!"আমি তাকে মারধর করার কথা চিন্তাও করিনি। মহিলা আমার চেয়েও বড়।
তেইশ-চব্বিশ বয়স হবে। একে মারতে গেলে যদি সে আমাকে ধরে মার দেয়, তাহলে আমার খবর আছে। তবে যেহেতু আমার মাথায় 'সমস্যা' ছিল, আমি অত্যাচারের জন্য বেছে নিলাম মহিলার ছয় সাত বছর বয়সী ছেলেটিকে। এইবার মারধর করলাম না, তবে অত্যাচারটা ছিল খুবই বিশ্রী ধরনের। তার মা কাজ করতো, আর সে সারাদিন একা একা বসে থাকতো।
টিভি দেখাই ছিল তার কাছে একমাত্র বিনোদন। আমি টিভি ছাড়লেই সে এসে উপস্থিত হত। আমি কেন যেন সেটা সহ্য করতে পারতাম না। ছেলেটিকে বলতাম চলে যেতে। এমন ছিল না যে সে কোন কথা বলতো।
সে চুপচাপ ঘরের এক কোণে পড়ে থাকতো। একটা কাঠের চেয়ারের সাথে তার কোনই পার্থক্য ছিল না। তবু আমার সেটা সহ্য হত না। সে না গেলে আমি টিভিই বন্ধ করে দিতাম। সে গেলে পরে আবার ছাড়তাম।
তারপর ধরা যাক ভাল কিছু খাবার সময়ে ইচ্ছে করেই তাকে লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে খেতাম। ও আমার খাবারের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, দেখতেও আনন্দ লাগতো! এছাড়াও টুকিটাকি অত্যাচারতো ছিলই। 'নেওর আলী' এবং তার মাও একদিন আমাদের বাসা থেকে চলে গেল। তার স্বামীর সাথে বনিবনা হয়ে গেছে। সে স্বামীর ঘরেই ফেরত যাচ্ছে।
এর কয়েকমাস পরেই আমি উপলব্ধি করলাম আমি কী করেছি! একটা হাদীছে পড়লাম, বান্দার মনে কষ্ট দিলে সেই বান্দা মাফ না করা পর্যন্ত স্বয়ং আল্লাহও মাফ করেননা। আমি বুঝে গেলাম আমি দোযখে যাচ্ছি। নেওর আলীর কাছে আমি কিভাবে মাফ চাইবো? তারতো ঠিকানা আমি জানিনা। আর জমিলা? কে জানে, পাপী শহর তাকে কোথায় কিভাবে গ্রাস করে নিয়েছে! কারও বাড়িতে সে কাজ পেয়েছে? নাকি তার আশ্রয় হয়েছে কোন এক নিষিদ্ধ পল্লীতে? যদি তাই হয়, মেয়েটি কখনও আমাকে ক্ষমা করবে? আমি নিজেও কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো? কখনই না!সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। আমি শুরু করলাম নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা।
সব কাজের লোকতো বটেই, সব মানুষের সাথেই আমি দুর্ব্যবহার করা বন্ধ করে দিলাম। তবু মনে খচখচে একটা ভাব থেকেই গেছে। জমিলার জীবনের পরিণতির জন্য যে আমিই দায়ী!বিয়ের জন্য দেশে গেলাম। আমার বিয়ের জন্য আমার আপুও দেশে আসলো। সাথে আমার ফুটফুটে একবছরের ভাগ্নে।
আমার আব্বু আম্মুর কাছে পুরা পৃথিবী এক দিকে, তাদের নাতি আরেকপাশে। ইহানের দাদা দাদির ক্ষেত্রেও একই। স্নেহ নিম্নগামী!ইহানের দাদার বাড়ি থেকে একটা কাজের ছেলে নিয়োগ দেয়া হলো যে ইহানের সার্বক্ষনিক সঙ্গী। নাম হৃদয়। কাজের ছেলের নাম হয়ে থাকে আব্দুল, করিম, রহিম, আকবর ইত্যাদি।
হৃদয় নামটা একজন কাজের ছেলের জন্য বেশ আধুনিক এবং রোমান্টিক। আমরা বেশ মজা পেলাম। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার নামে 'খান' যোগ করে দিল। হৃদয় খান নামে নাকি বাংলাদেশে একজন গায়ক আছেন, বিখ্যাত। আমার কাছে মনে হলো প্রায়শ্চিত্তের এই একটা সুযোগ এসেছে।
আমি হৃদয় খানের সাথে কোন অসদাচরণ করলাম না। তাকে এক সেট সম্পূর্ন নতুন জামা কিনে দিলাম। তার তখন বাড়ন্ত শরীর। জামার সাইজ ছোট হয়ে গেছে। সেই ছোট জামা পড়েই তার কী আনন্দ! একটা দাঁতও ঠোঁট দিয়ে ঢেকে রাখতে পারছে না।
ভাল ব্যবহার কোথাও কোথাও এমন মাত্র ছাড়িয়ে গেল যে মাঝে মাঝে সেটা চোখেও লাগতে লাগলো। যেমন, আপু এবং তার ননদ পরী আপু গেছেন নিউমার্কেট গাউছিয়া এলাকায় শপিং করতে। অস্ট্রেলিয়ান এবং আমেরিকান ডলার আয় করা লোকজন দেশে খরচ করতে খুব ভালবাসে। দুইজন দুইহাতে খরচ করতে লাগলো। পরী আপুর স্বামী শিপলু ভাইয়া এবং আমার হাত ভরে যেতে লাগলো শপিং ব্যাগে।
হৃদয়ের হাতে নিজেরই একটা লাগেজ। সিলেট থেকে সরাসরিই চলে এসেছে গাউছিয়ায়, ব্যাগে তার দুই সপ্তাহের কাপড় চোপর। তারউপর একটার পর একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে সে হিমশিম খাচ্ছে। তার বয়স তখন নয় দশ হবে। এত ওজন দুই হাতে নিয়ে সে ঠিক মত হাঁটতেই পারছে না।
আমি তখন হাত দিয়ে টেনে তার লাগেজটা নিয়ে নিলাম। সে লজ্জায় শেষ। "ছিঃ ছিঃ ভাইয়া! কী করেন! আমারে দ্যান! কোনই অসুবিধা নাই!"আমি বললাম, "আমার অসুবিধা নাই। তুই অন্য ব্যাগ গুলি নে। "আমি আমেরিকা থেকে গিয়েছি।
আমার কাছে তখন শ্রমের মর্যাদা অনেক! এবং একই সাথে প্রতিটা মানুষকে সম্মান করার ট্রেনিং আছে। এটাও এই 'কাফির নাসারাদের' দেশে এসেই প্রাপ্ত। হযরত উমরের (রাঃ) একটা ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। সবাই জানেন, তবু প্রাসঙ্গিক বলেই মনে করিয়ে দেয়া। তিনি তখন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা।
মরুভূমির উপর দিয়ে উটের পিঠে চড়ে যেতেন। একজন গোলাম থাকতো সেই উটের রশি টেনে নিয়ে যাবার জন্য। মরুভূমির প্রচন্ড গরমে সেই গোলাম হাঁপিয়ে উঠতো। পিপাসায় তার বুক ফেটে যেত। হযরত উমর সেটা খেয়াল করার সাথে সাথেই নিজে নেমে উটের রশি সামলাতেন।
গোলামকে পানি খাইয়ে উটের পিঠে চড়াতেন এবং উটকে ততদূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতেন যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি নিজে ক্লান্ত হচ্ছেন। হযরত উমর (রাঃ) ইসলামের শ্রেষ্ট বীরপুরুষ যোদ্ধাদের একজন। তিনি সহজে হাঁপিয়ে উঠতেন না। একটা ছোট ব্যাগ বহন করায় সেদিন আমার কি খুব একটা অসিবিধা হয়েছিল? কিন্তু ছোট ঐ ছেলেটার নিঃসন্দেহে অনেক কষ্ট লাঘব হয়েছিল। সে যদি দোয়া নাও দিয়ে থাকে, তবু উপরওয়ালার দরবারে নেওর আলীর সাথে করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়তো আমার হয়ে গিয়েছিল।
এখন বাকি জমিলার সাথে করা পাপের শাস্তি মওকুফের পালা। খুব সহজে সেটা হবে বলেও মনে হচ্ছে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।