মুসাফির। হাঁটছি পৃথিবীর পথে পথে, অনিশ্চিত গন্তব্যে। কাগজের নৌকা দিয়ে সাগর পাড়ি দেবার দুরন্ত প্রয়াস।
একজন নারী সাংবাদিক, শুধু বিতর্কিতই নন, ব্যাপক সমালোচিতও। অবশ্য বিতর্কিত ও সমালোচিত হলেই কেউ খারাপ হয়ে যান না।
তার নামটি বলছি না লজ্জিত হতে পারেন ভেবে। প্রায় সবার কাছে তিনি সম্ভবত একটু পরিচিতই হবেন, আর পরিচিত মানেই ভালো- এমনও নয়। কাদের মোল্লা, এরশাদ শিকদার, হিটলার, এরাও ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। পরিচিতি অর্জন করা অনেকের কাছেই কোনো কঠিন কাজ নয়। তো ধরা যাক তার নাম গিন্নি বালা।
তিনি সেদিন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন, আমি আইনজীবী হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু হলাম সাংবাদিক। সাংবাদিক হয়ে ভালোই আছি। আমি চাই এ দেশে লাখ লাখ গিন্নি বালা তৈরি হোক। আপনারা সবাই গিন্নি বালা হয়ে যান।
হাসব না কাঁদব তাৎক্ষণিক বুঝে উঠতে পারিনি।
এ স্ট্যাটাসেও রীতিমতো ভক্তদের উপচেপড়া ভিড়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য : দুনিয়ার অনেক জায়গায় লেংটা পাগলেরও কিন্তু ভক্ত-মুরিদের অভাব হয় না। তো আমি জিজ্ঞেস করলাম, "গিন্নি বালা কে?" আমি আশা করিনি আমার মতো নগণ্য কারো প্রশ্নে তার মতো একজন ডাকসাইটে সাংবাদিক নিজ স্ট্যাটাস ডিলিট করবেন। আমি অবশ্যই তার কাছ থেকে একটি উত্তর আশা করেছিলাম। কিন্তু পরে এসে এ স্ট্যাটাসটি আর খুঁজে পাইনি।
তিনি বা তার ভক্তরা কোনো উত্তর দিয়েছিলেন কি না তাও জানতে পারিনি। তার স্ট্যাটাসটাও হুবহু মনে নেই।
যাহোক, আমি মূলত তার ব্যক্তিগত বা কর্মত পরিচয় জিজ্ঞেস করিনি, জানতে চেয়েছিলাম "মানুষের পরিচয় গ্রহণের সূত্র কি? রাস্তার একজন ফকির কিংবা আদুরীদের মতো ডাস্টবিনে পড়ে থাকাদের আমরা 'মানুষ' হিসেবে ভাবতে পারি কি না, অর্থাৎ এ যোগ্যতাটা এ যুগেও কারও মধ্যে অবশিষ্ট আছে কি না।
একজন পেশাজীবী সাংবাদিক, পেট পালাই যার ধর্ম, তার সঙ্গে একটি কুকুরের পার্থক্য কি আমার জানা খুবই প্রয়োজন। আমার জানামতে উভয়েই পেটপূজায় জীবন উৎসর্গ করে।
বরঞ্চ কুকুরটিকেই আমার উত্তম মনে হয়। কারণ কুকুরের জন্য বিদ্যালয় লাগে না, হাসপাতাল, পুলিশ-র্যাব জেলখানা ইত্যাদি লাগে না। তারা দিব্যি সুখে-শান্তিতে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। কুকুর হয়ে তারা 'ভালোই' আছে। আর মানুষ, শুধু পেট পালার জন্য কামড়া-কামড়ি করলেও তেমন দোষের কিছু ছিল না।
কিন্তু যখন অহংবোধ, প্রশংসাপ্রিয়তা আর কথিত ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, তাদের প্রতিযোগিতা বড় বিশ্রী। তখন সদম্ভে ঘোষণা দিতে পারে, "আইন নিজের হাতে তুলে নেব। " কত ভয়ঙ্কর!
মানুষের পরিচয় গ্রহণের মূল সূত্র কি বা মানুষের পরিচয় কিসে? ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, কর্ম, আকৃতি? এইসব শ্রেণিভেদ? আজ যারা ধর্মের বিভক্তির কথা শুনলে ছিঃ ছিঃ করেন, তারাই "কর্ম" দিয়ে নিজের পরিচয় দেন- আমি সাংবাদিক, আমি লেখক, সুশীল, উপর তলার লোক ইত্যাদি। তাহলে সমাজের ফেলানী ও আদুরীদের পরিচয়টা আমরা কিভাবে নেব? হিন্দু না মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন এটা কবেকার কথা? কিন্তু আজও- সে পরিচিত মুখ, না রাস্তার কেউ- এ চর্চা চলে। কেন? অর্থ, ক্ষমতা ও কর্মের মানদণ্ডে মানুষের পরিচয় নেয়া যায়? মানুষ হিসেবে কি সবাই এক সারিতে নয়? প্রতিটি মানুষ দুর্গন্ধযুক্ত এক বিন্দু পানি থেকে সৃষ্টি হয়নি? আবার সবাআ মাটির সাথে মিশে যাবে না?
আজকের মূল সমস্যা এখানেই, "মানুষের" পরিচয় আমাদের জানা নেই।
আমরা মানুষ চিনি না। সাংবাদিক চিনি, লেখক চিনি। যে চ্যানেল মালিকরা গরীব-দুঃখীদের টাকা মেরে আজ টিভি চ্যানেলের মালিক, তাদের টাকা খেয়ে যেসব সুশীল ও বুদ্ধিজীবীরা মানবতার আওয়াজ তুলেন, আমরা তাদের খুব ভালো করে চিনি, সম্মান করি, তাদের সামনে মাথা নিচু করি, তাদের প্রশংসা করি। সুতরাং সাংবাদিক নামের সেই গিন্নি বালাদের অহংকারে আমি বিন্দুমাত্র আশ্চর্যবোধ করিনি। যারা মনে করে ক্যামেরার সামনে কথা বলে, টকশো করে আর পত্রিকায় দিনের পর দিন বা রাতের পর রাত কলাম লিখে সমাজ পরিবর্তন করবেন, তাদের মুখে ছাই।
বুদ্ধিজীবী পিয়াস করিম, মান্না, তুহিন মালিক, আরও কে কে যেন (আমি নাম জানি না, টকশো দেখিও না), তাদের বলব সব চ্যানেল ও পত্রিকা বয়কট করে অথবা তাদের কাছ থেকে এক পয়সাও না নিয়ে জনতার কাতারে আসুন। আমাদের সবার আদুরী বা ফেলানী হতে হবে, গিন্নী বালা নয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : আজ একদল মানুষকে সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মানুষের অধিকার, পরিচয় ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে "সংখ্যায়" আমি বিশ্বাসী নই। তাই 'সংখ্যালঘু' শব্দটি যেমন ব্যবহার করি না, 'সংখ্যাগুরুর' যুক্তিও দেখাই না।
এ শব্দগুলো 'গণতন্ত্রের' দান। কথিত গণতন্ত্র যতদিন দুনিয়ায় থাকছে, এ দুটি শব্দও ততদিন থাকবে। আর এর সুযোগ নেবে একদল কুকুর, কিংবা তার চেয়ে নিকৃষ্ঠ এক প্রকার জীব। আমার ক্ষুদ্র প্রতিবাদের কোনো মূল্য কারও কাছে আছে কি না জানি না, তবুও বলছি, কোনো দলীয় বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, একান্তই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিতদের উপর যে বা যারাই এসব হামলা করছে, এর প্রতিবাদের ভাষা নেই। এটা চরম পাশবিকতা।
এ থেকে উত্তরণে আমরা কে কী করতে পারি তা সাধ্যের সর্বোচ্চ মাত্রায় ভেবে তারপর দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
আজ শুধুই নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে চাই, আর কিছু নয়। কেননা মধ্য যুগের বিশেষ একটা সময়কে আমরা "আইয়ামে জাহেলিয়াত" বলে অভিহিত করি। কিন্তু এ যুগের মূর্খতাকে চিহ্নিত করার কোনো ভাষা আমাদের জানা নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের দাবিদার, সর্বোচ্চ সভ্যতার দাবিদার আজকের বিশ্বে এ ধরনের পাশবিকতা চলতে পারে এটা কল্পনারও অতীত।
এরপরও কেউ স্বীকার করবে না আজ মানুষের মূর্খতা কোথায় পৌঁছেছে। বুঝি না যে তাও বুঝি না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।