মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে...
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কোন এক বইতে পড়েছিলাম, 'যৌবনের ধর্ম নাস্তিক্য, আর বার্ধক্যের ধর্ম আস্তিক্য'।
সমসাময়িক সাহিত্যিকদের মধ্যে এই ভদ্রলোককে আমার সীমাহীন পছন্দের। এই পছন্দ কোন পর্যায়ের তা আমি বোঝাতে পারবো না। এটা আসলেই বর্ণনাতীত। কখনো কখনো মনে হয়, শীর্ষেন্দু আমার কাছে পৃথিবীর সেরা লেখক।
হ্যা, আমার কাছে। না, উপরের ওই বক্তব্যের জন্য শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে আমার এমন ভয়ংকর রকমের পছন্দ না। পছন্দ অন্য অনেকগুলো কারণে। যে কারণগুলোর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট কারণ হচ্ছে বর্ণনা শক্তি। সেটা চরিত্র হোক, কিংবা প্রেক্ষিত হোক, কিংবা হতে পারে কোন দৃশ্যও।
এই বর্ণনা শক্তির কারণেই মানিককেও আমার অসম্ভব পছন্দ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। পদ্মা নদীর মাঝি, চতুষ্কোণ এবং পুতুল নাচের ইতিকথা। যেন চোখের সামনে বইয়ের পাতায় অক্ষরে অক্ষরে জীবনের সব দিক, সব গলিঘুচি, সবগুলো পরত, দুর্দান্ত প্রামাণ্য চিত্রের মতন উদ্ভাসিত।
বিশ্ব সাহিত্যের এখানে ওখানেও একটু আধটু চোখ বোলানোর সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
মারকেজ, স্টেনবেইক, হেমিংওয়ে, লর্ড লিটন, রেমারক, ডিকেন্সসহ আরও অনেকের। তারপরও ওই শীর্ষেন্দুতে আমি বুঁদ হয়ে থাকি, বুঁদ হয়ে আছি, বুঁদ হয়েই থাকব। এক বই বারবার পড়বো, বারবার। কিন্তু কেন?
এই কেন'র উত্তর খোঁজা কঠিন। বেশ কঠিন।
তবে একটা কথা বলতে পারি, এতো দুর্দান্ত সংলাপ আমি কারো লেখায় দেখিনি, চরিত্রের এমন অসাধারণ গাঁথুনি এবং ঠিকরে পরা ব্যাক্তিত্ব! আমি সম্মোহিত হয়ে যাই। তাঁর যেকোন বইয়ের প্রত্যেকটা চরিত্রই হয়ে উঠতে ইচ্ছা করে। যখন যেই চরিত্রটা পড়ি, মনে হয়, আমি এর মতো হতে চাই, এর মতো কথা বলতে চাই, এর মতো ভাবতে চাই। আমি ঠিক ওই চরিত্রটিই হতে চাই।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতো কিছুর পরও শীর্ষেন্দুকে আমার এমন অন্ধ ভালোবাসার সুনির্দিষ্ট কারণ আমি দীর্ঘদিন খুঁজে পাই নি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কোন এক প্রবল মানসিক অস্থিরতা এবং বিচ্ছিন্নতার সময়ে আমার মনে হয়েছিল এই মানুষটি তাঁর লেখায় আমাকে স্থির করার ক্ষমতা রাখেন। মনে হয়, কেউ একজন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি কোন ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা গ্রামের পথে গাছের তলায় শুয়ে আছি। ঝিরঝিরে বাতাস ছুয়ে যাচ্ছে আমার শরীর জুরে, আমার নাকে ভেসে আসছে আদিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠের ফসলের ঘ্রাণ, ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ, বৃষ্টির শব্দ, এক অদ্ভুত আবেশে ঘুমে জড়িয়ে আসছে আমার চোখ। আমি যেন পরম প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ছি।
এই অনুভূতিটুকু খুব দরকার। এই নিদাঘ কালে এমন অনুভূতি আসলেই খুব দরকার। খুব দরকার। চারপাশ জুড়ে যে ভয়ংকর অস্থির সময়। প্রচণ্ড রোদে পুড়ে যাওয়া খা খা তৃষ্ণা।
পোড়া মাটির দহন। বুকের ভেতর দগদগে ক্ষত। এ সত্যিই অস্থির সময়।
আমার এক বন্ধু সোহান। গত একবছর ধরে আমার সাথে একবার দেখা করার জন্য প্রায় হাহাকার করছিল।
ও খুব ব্যাস্ত মানুষ। থাকে দূরে। আমিও নানা কারণে ব্যাস্ত। হয়ে উঠছিল না। আজ প্রায় নাছোড়বান্দা সোহান এসে হাজির আমার বাসায়।
একি! সোহানের এ কি হাল! এই সোহানকে আমি চিনি না। মনে হচ্ছে উদ্ভ্রান্ত এক বয়স বেড়ে যাওয়া ক্লান্ত মানুষ। যে তার জীবনটাকে আর বয়ে নিতে পারছে না। যে নাবিক হাল ভেঙ্গে হারায়েছে দিশা টাইপ অবস্থা!
অথচ সোহানের পুরোটা জীবন এখনও বাকী। ওতো এখনও বিয়েও করেনি!
আমি দীর্ঘ সময় ধরে ওর কথা শুনলাম।
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষটাকে আমার প্রবল ঝড়ে ডানাভাঙা এক পাখি মনে হোল। যে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। রাতে ঘুমাতে পারে না। খেতে পারে না। তার মাথা জুড়ে রাজ্যের চিন্তা।
জন্ম, মৃত্যু, সৃষ্টি, জীবন, সমাজ, সম্পর্ক। নানান চিন্তা। এ যেন এক ভয়াবহ পাজল। সেই পাজলে সোহান পুরোপুরি পাজলড। অনেকটা অপ্রকৃতস্থ।
তার ৫ মিনিট আগের কিছুও মনে থাকে না। হাতের কলমটা কোথায় রেখেছে মনে থাকে না। সিগারেটের উল্টোপাশে আগুন ধরায়। হলুদ চোখ। খুব প্রয়োজন না হলে কারো সাথে মেশেনা।
কথা বলে না। গ্রামে থাকা মা বাবার সাথে যোগাযোগ নেই দশ বছর! কারো সাথেই কথা বলে না। ওর নিজের একটা ছোটখাট বিজনেস আছে। ও সেই অফিসেই থাকে। খুব বেশি না হলেও মাঝে মাঝে ড্রাগও নেয়।
গত একবছর বলতে গেলে ও সেই অফিস ছেড়ে বাইরে বের হয়নি। বিভ্রান্ত এবং ভীত চোখ। সবশেষে, সেই করুণ চোখে কাপাকাপা গলায় বলল, 'দোস্ত আমি বাঁচতে চাই'।
আমি দীর্ঘ সময় ধরে ওকে বোঝার চেষ্টা করেছি। হয়তো সমস্যাটাও বুঝতে পেরেছি।
আমার সাধ্যমত, চেষ্টা করলাম, ওর সমস্যাগুলো ধরিয়ে দিতে। ওর অস্থিরতার কারণগুলো ধরিয়ে দিতে। তারপর কাঁধে হাত দিয়ে, কাল সকাল থেকেই ও ওর পরের দিনটা কিভাবে শুরু করবে, সব সব সব, আমার মতো করে ওকে বললাম। বললাম, নাথিং ঠু লেট ইন লাইফ! আমাদের প্রত্যেকের একটা জায়গা থাকা উচিত, নিজেকে সমর্পণের। নিজেকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণের।
একটা আশ্রয় দরকার। যেখানে নির্ভরতা পাওয়া যাবে। ক্লান্তিতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যাবে। সেই জায়গাটা হতে পারেন, মা, বাবা, ভাই, বোন, বন্ধু, প্রিয় মানুষ। তবে সবচেয়ে বড় বেশি যিনি হতে পারেন, তিনি হলেন ঈশ্বর! অবশ্যই ঈশ্বর।
যার কাছে সাবমিশনের নামই হোল স্থিরতা। সমর্পণের মানেই হল শান্তি। পরিপূর্ণ তৃপ্তি। প্রবল পিপাসা মিটে যাওয়া। সমর্পিত হওয়া।
এই সমর্পণ অদ্ভুত এক শান্তি দেয়। আশ্রয় দেয়। যে আশ্রয় ভয়হীন, শংকাহীন, চিন্তাহীন।
সবচেয়ে মজার বিষয় হোল, ক'বছর আগেও যেই সোহান ঈশ্বর ভাবনাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিত, গালমন্দ করত, ও আজ যেন কেমন মাথা নুইয়ে মিইয়ে গেল। মনে হোল, ওর অস্থির চোখ দিশা খুঁজে পাচ্ছে।
শুন্য খা খা তপ্ত মরুভূমির কোথাও সবুজ মরুদ্যানে শীতল হাওয়ার ছায়া আর টলটলে জলের হ্রদ খুঁজে পেল! ও ফিসফিস করে বলল, 'তুমি বোধ হয় ঠিক ই বলেছ!'
আমার হঠাৎ শীর্ষেন্দুর সেই কথা মনে হোল, ' 'যৌবনের ধর্ম নাস্তিক্য, আর বার্ধক্যের ধর্ম আস্তিক্য'।
আসলেইতো, ভুরিভুরি মানুষের উদহারন আমি জানি, দেখেছিও অনেককে, যারা যৌবনের কট্টর অবিশ্বাস ভেঙ্গে একটু বয়স হতেই, কিংবা বার্ধক্যে এসেই পাততাড়ি গুটিয়ে এসে সামিল হয়েছেন বিশ্বাসীদের কাতারে। তাহলে কি শীরসেন্দু ভুল বলেন নি?
আচ্ছা, সোহান কি তাহলে বৃদ্ধ হয়ে গেল? গেলে ক্ষতি কি? বার্ধক্য মানুষের সারাজীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি। হয়তো সেই অভিজ্ঞতাই তাকে এক মহাশক্তির কাছে সমর্পিত করে! উপলদ্ধি দেয়। সেই উপলদ্ধি তাকে বিশ্বাসি করে, স্থীর করে।
সমর্পিত করে। এই সমর্পণই হয়তো তাকে অনুভূতি দেয় শান্তির। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের মতন, ঝিরঝিরি বাতাসের মতন। , বৃষ্টির শব্দের মতন।
আমার তখন আবার মনে হয়, তাহলে আর বার্ধক্যের অপেক্ষা কেন? সেই মহাশক্তির কাছে সমর্পণ কেন এখুনি নয়? এক্ষুনি...
১০.০১.২০১৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।