সভাপতি- বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, সম্পাদক ঢেউ, সভাপতি- জাতীয় সাহিত্য পরিষদ মুন্সীগঞ্জ শাখা বিতার্কিকদের একটি শ্লোগান হল, ‘তর্কে দ্বন্দ্ব আর বিতর্কে বন্ধুত্ব’। আমাদের বহুসংখ্যক লেখকদের মধ্যে সরাসরি তর্ক না হলেও তারা মিডিয়ার মাধ্যমে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তেন মাঝেমধ্যে। এটা যে শুধু জাতীয় পর্যায়ে হচ্ছে তা নয় স্থানীয়ভাবেও হচ্ছে অহরহ। মুন্সীগঞ্জ শহরে বসবাসকারী ৫/৬জন কবি-সাহিত্যিক পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন মাঝেমধ্যেই। এতে কে কার কখন বন্ধু আর কখন শত্রু বুঝে উঠা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
একদিন কবি মাসুদ অর্ণব এক আড্ডায় বললেন, কবি যাকির সাইদ মুন্সীগঞ্জের শামসুর রাহমান। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে তিনি বললেন, তাকে এই উপাধী অন্য কেউ দিয়েছে। শামসুর রাহমান নিজেও যাকির সাইদের কবিতার প্রশংসা করেছেন। কদিন পরেই মাসুদ অর্ণব যাকির সাইদ সম্পর্কে বললেন, . . . কবি। হিন্দিতে চুলকে বলে এমন একটি শব্দ ব্যবহার করেছেন।
যাকির সাইদ নিজের সম্পর্কে লেখা একটি কবিতায় (প্রকাশিত) এ শব্দদয় ব্যবহারও করেছিলেন। মুন্সীগঞ্জ সংবাদেও দেখলাম এক কবি অন্য কবিদের তুলাধুনা করতে। তবে মুন্সীগঞ্জের লেখকদেও এই আলোচনা বুদ্ধিবৃত্তিক এবং উপভোগ্য। মাসুদ অর্ণব আমার একজন প্রিয় কবি। যেমন প্রিয় যাকির সাইদ, সুমন ইসলামসহ কয়েকজন।
গদ্য ভাল লাগে শহীদ ই হাসান তুহিনের। তবে এই দ্বন্দ্বের মধ্যেও তারা বন্ধুই। এখানে বিতর্কটা বন্ধুত্বকে নষ্ট করে না। মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের এক আড্ডায় এ্যাডভোকেট মনির জানতে চাইলেন, মুন্সীগঞ্জের লেখকদের এই দ্বন্দ্ব লেখার উপর প্রভাব বিস্তার করছে কিনা? ইতিবাচক হউক কিংবা নেতিবাচক, প্রভাবতো পড়বেই। আড্ডা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বাংলাদেশে শামসুর রাহমানরা বিউটি বোডিং এ যে আড্ডা দিতেন তার ফল হল, আড্ডাকারীদের সকলেই দেশের প্রধান প্রধান লেখকে পরিনত হয়েছেন। আড্ডায় পারস্পারিক মতবিনিময় পরস্পরকে সমৃদ্ধ করে। ফরাসী রেনেসার সময় শিল্পীরা আড্ডা দিতেন। মুন্সীগঞ্জের এই লেখকরাও আড্ডা দিয়েছেন। গভীর রাত পর্যন্ত এরকম আড্ডায় কয়েকবার আমিও ছিলাম।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা কয়েক লেখক বন্ধু ২৪ ঘণ্টার আড্ডার আয়োজন করি। এর ফলে গত কয়েক মাসে সবাই উজ্জিবীত হয়ে লেখালেখি বাড়িয়েছেন এবং আরো ভালো লেখা হয়েছে। কবি সান্দ্র মোহন্ত তো অনেকগুলো ভালো কবিতা লিখেছেন।
কালের পরিক্রমায় বিউটি বোর্ডিং এর লেখকরা বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। এদের মধ্যে নিজেরাও ভিন্নপথে চলে গেছেন।
শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ দুজনই একদা প্রগতিশীল ছিলেন। পরবর্তীতে আল মাহমুদ হয়েছেন মৌলবাদীদের কবি। আরেকটি আড্ডা হয়েছে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের বাড়িতে। এখানে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনরা আড্ডা দিতেন। এর মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ ও হুমায়ুন আজাদ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।
অবশ্য আক্রমনটা একপাক্ষিকই ছিল। হুমায়ূন আজাদ বাংলা ভাষায় নতুন একটি শব্দ প্রবেশ করান। সেটি হল ‘অপন্যাস’। তিনি হুমায়ূন আহমেদ এবং ইমদাদুল হকের উপন্যাসকে বলতেন, অপন্যাস। হুমায়ূন আহমেদ হুমায়ুন আজাদের মানসিক বিকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ‘পাকসার জমিন সাদবাদ’ উপন্যাসটির জন্য।
হুমায়ূন আজাদ অবশ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন, আহমদ ছফা, তছলিমা নাসরিনসহ অনেকের সাথেই। অনেক লেখককেই তিনি মূর্খ বলতেন। অনেক প্রখ্যাত পণ্ডিতের পাণ্ডিত্য নিয়েই প্রশ্ন তুলতেন। তাই অনেকেই ভয়ে থাকতেন, কার কখন লেখক ভাব খসে পড়ে। সৈয়দ শামসুল হকও হুমায়ূনের লেখার সাহিত্যমূল্য নিয়ে একদা প্রশ্ন তুলতেন।
সৈয়দ হকের সাথে একবার রাস্তায় দেখা হয় হুমায়ূন আহমেদকে বলেন, সাহিত্য টাহিত্য কিছু লিখছেন কিনা? হুমায়ূন বলেন, ‘এইসব দিনরাত্রী’ লিখছি। সৈয়দ হক একই প্রশ্ন আবারো করলে হুমায়ূন আহমেদ বুঝতে পারেন সৈয়দ হক টিভি সিরিয়াল ‘এইসব দিনরাত্রী’ সাহিত্য নয় বলেই বোঝাতে চাচ্ছেন। মাসিক বিচিত্রায় দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন। অবশ্য দুজনই দুজনার ছোটগল্পের প্রশংসা করেছেন বিভিন্ন সময়। মিডিয়ার মাধ্যমেই আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।
হুমায়ুন আজাদ আহমদ ছফাকে গুরুত্ব দিতেন না। পাগল ছাগল জ্ঞান করতেন। আহমদ ছফাও দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন। তিনি হুমায়ুন আজাদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘শুকরের নতুন দাঁত গজালে, বাপের পাছায় কামড় দিয়ে পরীক্ষা করে শক্ত হয়েছে কিনা। ’ হুমায়ুন আজাদ অনেককে আক্রমণ করে ক্ষতবিক্ষত করলেও কেউ এরকম জবাব দিতে পারেনি।
তিনি ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি খুবই খারাপ চাত্র ছিলেন, পরে যে-জ্ঞানচর্চা করেছেন, তা খুবই তুচ্ছ। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকও একই ধরনের। মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ব্যাকরণ বইট প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ভুল; এর ভাষা ও ব্যাকরণবোধই ভুল। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে বলেছেন, তিনি নিজে কোন গবেষণা করেননি, গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ করেননি। সবসময় তোষামোদ করে বেড়ান।
আজাদ নজরুলকেও আক্রমণ করে বলেছেন, তিনি প্রকৃত কবি নন, তিনি একজন বড়ো পদ্যকার, এবং তিনি প্রকৃতপক্ষে বিদ্রোহীও নন, তিনি ব্রিটিশবিরোধী; তাঁর পদ্যের বড়ো অংশ প্রতিক্রিয়াশীলতার জয়গানে মুখরিত। আরো অনেককে তিনি আক্রমন করেছেন। অনেক তথাকথিত জ্ঞানীকে মূর্খ হিসাবে প্রমাণ করেছেন। অবশ্য হুমায়ূন আজাদ নিজেকে সমাজের সাথে খাপ না খাওয়া মানুষই বলতেন। অর্থাৎ মিসফিট।
পশ্চিমবঙ্গেও লেখকদের মধ্যে এই সমস্যাটা প্রকট। সেটা বর্তমানকার লেখকদের মধ্যেও আবার প্রয়াত লেখকদের মধ্যেও। সুধীন্দ্র নাথ দত্ত জীবনানন্দ দাশকে কবি হিসাবেই মেনে নিতে চাননি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য আড্ডা নিয়ে, যৌন হয়রানীর অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। আগের লেখকদের মধ্যে বঙ্কিম বিদ্যাসাগরকে মূর্খ বলতে দ্বিধা করেননি।
বিদ্যাসাগরকে তেমন লেখক বলেও মানতে চাননি। বিদ্যাসাগর নাকি কোন মৌলিক রচনা লেখেননি। ‘সীতার বনবাস’ পড়ে তিনি বলেছিলেন, এতো কান্নার জোলাপ। তারাশাঙ্করের মতে, বিমল মিত্র মস্ত লেখক নন; ইতিহাসে হাতটা মন্দ না হলেও সমকালকে তেমন ম্যানেজ করতে পারেন না। বিমল মিত্রের রীতিমতো দুশ্চিন্তা তারাশঙ্করের গল্প ছাত্রপাঠ্য হয়েছে; বাঙালিদের একটা প্রজন্ম ভুল বাঙলা শিখবে।
লোকটা বাঙলা জানে না।
বিশ্ব সাহিত্যে এই পরশ্রীকাতরতা বা দ্বন্দ্বও অনেক। অ্যাডাম স্মিথ আধুনিক ইকনমিক্সের জন্মদাতা। বার বছরের সাধনায় এককানা জম্পেস বই লিখলেন ‘ওয়েলথ অফ নেশনস’ ইনি যখন পণ্ডিতদের আড্ডা চক্রের সভ্য হলেন তকন বসওয়েলের মনে কি দুঃখ, তিনি বললেন এই আড্ডা চক্রের আর ইজ্জত রইল না। যদু মধু সবাই একানকার সভ্য হতে চলেছে।
ইংরেজি কবি গিবনস সম্পর্কে কবি কোলরিজ বলেছেন, ওর ইংরেজি স্টাইল এতোম খারাপ যে কহতব্য নয়। হেমিংওয়ে সম্পর্কে একজন সমকালীন লেখক বলেছেন, ওর স্টাইল আবার স্টাইল নাকি! উনিতো বুকে পরচুলা পরে ঘুরেন। জেমস জয়েস সম্পর্কে ভার্জিনিয়া উলফ বলেছেন, অপরিপক্ক স্কুলের ছাত্রের লেখা, সারাক্ষণ যে, মুখের ব্রণ টিপসে। কবি কীটস সম্পর্কে লর্ড বায়রনের উক্তি- ‘লেকের ব্যাঙ’।
এই দ্বন্দ্ব বেঁচে থাকুক, এগিয়ে যাক সাহিত্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।