আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি তোমাদেরই লোক



ফেইসবুক-এ দেখলাম আইসক্রিম হাতে দুইটা মেয়ের ছবিতে আমার নাম ট্যাগ করা। সেই ছবিতে আমি ছাড়াও আরও শ’খানেক পোলাপানকে ট্যাগ করা। এবং সেই ছবিতে প্রচুর লাইক। আমিও প্রথম যেই কাজটা করলাম তা হলো একটা লাইক মেরে দেয়া। আগে লাইক মারা, পরে দেখা যাবে ঘটনা আসলে কী ছিল।



পরে দেখা গেল আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ড। ঠিক ফ্রেন্ড বলা যায় না, বরং বলা ভাল ক্লাসমেট। ইথিকা তানজিম আর নাদিয়া সুলতানারা বন্ধু হবার মতো অতটা কাছাকাছি কখনও আসেনি। কিংবা এও বলা যায় যে আমি নিজেও ওদের অতটা কাছে যাবার খুব একটা সাহস করিনি। যেকোন মেধাবীকেই আমি এমনিতেই একটু এড়িয়ে চলি, পাছে আমার গুমর ফাস হয়ে যায়, তার উপর আবার যদি হয় মহিলা মেধাবী।

মেয়েরাও ক্লাসমেট কাম ফ্রেন্ড সিলেকশনে একটু চুজি, বিশেষত স্নাতক পর্যায়ে, যেখানে সম্পর্কটা অন্তত বছর চার-পাঁচেক চলবে, সেখানে একটা বে-গুণ মার্কা ছেলে থেকে ওরাও একটু নিরাপদ দুরত্বেই থাকতে চায়। অতএব আমরা উভয়পক্ষই দুরে দুরেই ছিলাম। এবং এতে উভয়পক্ষই উপকৃত হয়েছি।

যাই হোক, আমি যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ”লড়াকু ছাত্র”, ”দিন আনি দিন খাই” গোছের একটা রেজাল্ট করতেই নাভিশ্বাস উঠেছে, আমার এই দুই ’বান্ধবী’ এখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ডিপার্টমেন্টেরই টিচার! আমি গর্বিত হতে এক মুহুর্তও দেরী করলাম না। গর্বিত হবার সুযোগ হাতছাড়া করলাম না।



নারীবাদীদের হাতে নাজেহাল হবার ঝুকি মাথায় নিয়েই বলছি একজন মেয়েকে ইয়াহুর প্রধান হিসেবে দেখতে আমার আপত্তি নেই, রাশিয়া, ভারত, আর্জেন্টিনার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বা ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের প্রধান হিসেবেও আপত্তি নেই, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তো আপত্তি নেই-ই, কিন্তু ভার্সিটির টিচার হিসেবে নারী কেন যেন বাধো বাধো ঠেকে। হতে পারে এর কারণ ভার্সিটিতে আমি তেমন ভালো কোন মহিলা টিচার পাইনি, তবুও। তারপরেও কিন্তু, ছবিটা দেখা মাত্রই আমি বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে তৈরী হয়ে গেলাম। ওদেরকে বলার জন্য জন্য ছটফট করতে লাগলাম যে ”আমি তোমাদেরই লোক। ”

ভার্সিটির বন্ধুদের নিয়ে এই একটা সুখানুভূতি কাজ করে যে এরা কোথাও না কোথাও গিয়ে কূলে ভিড়বেই।

এর বেশীরভাগই কেবল কূলে নয় রীতিমতো মূল ভুখন্ডে গিয়েই ভিরছে। ভার্সিটির বন্ধুদের এমনও দেখেছি চল্লিশ হাজার টাকা বেতনের চাকরিতে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েও জয়েন না করার শখ এবং সাহস রাখতে। ব্যাপারটাকে আমার জাতীয় অপচয় মনে হয়, আবার বুকটা ইঞ্চিখানেক ফুলেও ওঠে। সব ব্যাংকার, ব্যাংকার এবং ব্যাংকারের ভিড়ে কয়েকটা কিন্তু এদিক সেদিক ঠিকই যায়গা করে নিচ্ছে, নিয়েছে। হিরক এএসপি, রিমু এ্যাডমিন, কায়েস ফরেন এ্যাফেয়ার্স, শাওন ট্যাক্স কিংবা বাকিরা যারা ইথিকাদের মতন ”৯৯%ই ওকে” বন্ধু মানুষ, আর্মি, নেভি, বাংলাদেশ ব্যাংক, সমবায়, তথ্য, শিক্ষা, বার্জার, জিপি, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কিংবা ইউএনডিপির ”বন্ধু”, আমি তাদের প্রতিও দাবি ছাড়ি না, বলতে চাই ”আমি তোমাদেরই লোক।



তবে এত সফলতার উল্টো দিকও আছে। যেমন টিটু। একটা পাবলিক ভার্সিটিতে হালের সবচেয়ে "বাজার-কাটতি"র একটা ফ্যাকাল্টিতে ভর্তি হয়ে যাবার পরও যে কেউ ঝরে পড়তে পাওে, সে তার উজ্জল দৃষ্টান্ত। বাবা-মা দু’জনই মারা গেলেন ও ভার্সিটিতে ভর্তির পরই। পারিবারিক অবস্থাও সচরাচর পাবলিক ভার্সিটির আর দশ জনের মতোই।

পড়ালেখা শেষ করতে পারলো না। এখন পথে পথে ঘুরে বেড়ায়।

কিংবা আমার স্কুলের বন্ধুরা। স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। শহর এবং গ্রাম মিলিয়ে গোটা পাঁচেক স্কুলে পড়েছি।

বলা বাহুল্য, অধিকাংশেরই পড়ালেখায় সেই ”দিন আনি দিন খাই অবস্থা। ” এবং এই দিন আনি দিন খাই করতে করতে অপুষ্টিতে অনেকে শেষ পর্যন্ত মারাই গেছে। বাকিরা কোনমতে টেনে গেছে শেষ পর্যন্ত। দেখা হলে আমার জুতা আর টাই এর দিকে তাকিয়ে একটা ঈর্ষা, হতাশা এবং কিছুটা সঙ্কোচ নিয়ে কথা বলে। ওরা জানে না, এই টাই এই স্যুট আমার ভেখ, নইলে তো আর ভিখ মিলবে না।

ওদের সঙ্কোচ দেখে আমি নিজেও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ি। আমিতো তেমন কেউ না, আমিতো ওদেরই লোক। ”আমি তোমাদেরই লোক” কথাটা খুব বলতে ইচ্ছে করে।

একটা অনলাইন নিউজ পোর্টালে আমার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়।

খেলাধূলা সংক্রান্ত। এতে আমি যারপরনাই রোমাঞ্চিত, আনন্দিত, আপ্লুত। আগে মনে হতো সাংবাদিকরা (এক্ষেত্রে হয়তো বলা যায় ফিচারিস্টরা) কত কিছু জানে! এত কিছু কিভাবে জানে? নিজে লিখতে গিয়ে জানলাম, আমার অত জানার প্রয়োজন নেই; আমি যতটুকুই জানি না কেন, আমার ”ইয়ে”তো সব জানে।

তখনই সন্দেহ ঢুকলো মনে, ওরাও কি তবে আমারই মতন? তবে কি আমিও ওদেরই লোক?

প্রথম লেখাটা যেদিন ওরা প্রকাশ করলো, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। অফিসে বসে খবরটা জেনেছিলাম।

ডানে-বামে, সামনে-পেছনে সবাইকেই খবরটা দিলাম। তাও আশ না মেটায় সাহস করে বসকেও বলে ফেললাম। এবার আশ পুরোপুরিই মিটলো। জিজ্ঞেস করলেন কবে থেকে লিখি। কিভাবে ওদের সাথে যোগাযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি।

এর পরই জানতে চাইলেন লেখার বিষয় কী? আজকের টপিক কী?

কোনমতে বললাম, গলফ।

বস যেন একটু নড়েচড়ে বসলেন। আপনি গলফ খেলেছেন জীবনে?

ভদ্রলোককে তো আর বলা যায় না--আমরা কয়জন আর রাজনীতি খেলেছি? অথচ আওয়ামী লীগ-বিএনপি, এরশাদ-রওশন, আমেরিকা-ভারত নিয়ে লিখতে দিলে পৃষ্ঠা সাপ্লাই দিয়ে কুলানো যাবে না। ভার্সিটিতে যেই শিক্ষক ব্যবসায় প্রশাসন পড়ান একজনও কি জীবনে কোন কর্পোরেট হাউজে চাকরি করেছেন? স্যারকে কিছুই বলা হলো না। কিংবা কে যেন একবার বলেছিলেন, কোন বিষয়ে জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো তা নিয়ে বই লেখা শুরু করা।

কে বলেছিলেন নামটা মনে না করতে পারায় সেটাও বলা গেল না।

আমি জীবনে গলফ খেলিনি শুনে বস বরং খুশিই হলেন। বিড়াল নাকি ইদুর ধরেই মেরে ফেলে না, মারার আগে একটু ”খেলা” করে। বসও আমাকে মেরে ফেললেন না, একটু খেলা করলেন--বাঙ্গালীর এই এক সমস্যা। কোন একটা বিষয়ে না জেনেই একটা কিছু বলে বসা, করে বসা।



”বাঙ্গালীর এই এক সমস্যা”--লাইনটা চেনা চেনা মনে হলো। চায়ের দোকানে, পাবলিক বাসে, অফিসে, টক শোতে, বাসায় সব যায়গায় এই কথাটা আমরা প্রায়শই শুনে থাকি। আমি নিজেও কম ব্যবহার করি না। বাঙ্গালির কেবল সমস্যা, সমস্যা আর সমস্যা। কোথাও আমাদের কোন সুবিধা নাই।

বাংলাদেশে বিনা খরচায় উচ্চ শিক্ষা পাওয়া যায়। হয়তো এটাও একটা সমস্যা। বাসা বাড়িতে সারাদিন নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাওয়া যায় নামমাত্র মুল্যে, হয়তো এটাও কোন না কোন সমস্যা। মান যাই হোক, নাম মাত্র মুল্যে পাওয়া যায় কিছু চিকিৎসাও। আর সমস্যাহীন দেশের উদাহরণ দিতে গেলে আমরা দাড় করাই সারা বিশ্বের সেই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ”সমস্যামুক্ত” দেশের উদাহরণ।

নিখরচায় উচ্চশিক্ষার উদাহরণ দিতে গেলে আমরা কখনোই দাড় করাই না আমেরিকাকে। খুজি অন্য কোন দেশ। নৈতিক অবক্ষয়ের কথা উঠলে ধর্ষণ-ভূমি ভারতের কথা আমাদের মাথায় আসে না, ট্রাফিক জ্যামের কথা উঠলেই আমরা এড়িয়ে যাই রিও ডি জেনিরো, নয়াদিল্লি, মস্কো বা ইস্তানবুলের কথা।

বসের কথা শুনে মনে হলে, তিনিও আমাদের মতই কথা বলেন, আমার কথাই বলেন। আমিও বসের দলের লোক।

নাকি বস আমার দলের? নাকি আমরা সবাই এক দলের?

এই একটা কথাই আরো একবার প্রমাণ করে দিলো, আমি তোমাদেরই লোক। আমার সাফল্যে, ব্যার্থতায়, আমার আনন্দে, পরিতাপে, প্রাপ্তিতে, হতাশায়, অর্জনে, বর্জনে আমি তোমাদেরই লোক। তোমাদেরও সাফল্যে, ব্যার্থতায়, তোমাদের আনন্দে, পরিতাপে, প্রাপ্তিতে, হতাশায়, অর্জনে, বর্জনেও আমি তোমাদেরই লোক।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।