রাঘববোয়ালরা সরাসরি জড়িত থাকায় বন্ধ হয়নি অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) ব্যবসা। বরং নতুন করে অবৈধ এ ব্যবসাটি চাঙ্গা হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে, অবৈধ এ ব্যবসার প্রসারে সরকারের উচ্চপর্যায় রীতিমতো উদ্বিগ্ন। অর্থনৈতিকভাবে দেশকে পঙ্গু করা ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধে হার্ডলাইনে যাচ্ছে সরকার। সারা দেশে এ অবৈধ ব্যবসায় জড়িতদের গ্রেফতারে শীঘ্রই সাঁড়াশি অভিযান শুরু করবে র্যাব।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, অবৈধ ভিওআইপির ব্যবসায়ীরা টপ টেররের চেয়েও ভয়ঙ্কর। বিদেশে টাকা পাচার করে দেশটাকেই তারা পঙ্গু করে দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, দেশে এবং বিদেশে অবস্থানকারী প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, টেলিকম মন্ত্রণালয়, রেগুলেটরি সংস্থা বিটিআরসির কতিপয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট অবৈধ এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতি মাসে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে ভাগবাটোয়ারা করে লুটে নিচ্ছেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। প্রভাবশালীরা এতটাই শক্তিশালী যে তাদের কারণে কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না এ অবৈধ বাণিজ্য।
সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সরঞ্জামসহ লোকজনকে গ্রেফতার করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন মূল হোতারা।
গত মেয়াদে ক্ষমতাসীন সরকার এ খাত থেকে মহালুটপাট বন্ধ করতে পারেনি। বরং অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রভাবের ছত্রছায়ায় থেকে দেশি-বিদেশি অবৈধ ভিওআইপিকারবারিদের সিন্ডিকেটের ব্যাপকতা আরও বেড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা একের পর এক ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ের (আইজিডবি্লউ) লাইসেন্স নিয়ে জড়িয়েছেন ভিওআইপির মাধ্যমে অবৈধ কল টার্মিনেশনে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রাপ্ত তথ্য এবং টেলিকম বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অবৈধ আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনে গত পাঁচ বছরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।
আর কল চুরি থেকে পাঁচ বছরে অবৈধ আন্তর্জাতিক কল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের আয় হয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে সরকারকে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। সরকার যে কোনো মূল্যেই এ ব্যবসা বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। রাঘববোয়ালদের হাত যত লম্বাই হোক আইনের আওতায় তাদের নেওয়া হবেই।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, র্যাব সব সময় অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধে কাজ করছে। যেখান থেকেই তথ্য আসছে, সেখানেই র্যাব অভিযান চালাচ্ছে। আগামীতে আরও শক্তিশালী অভিযান পরিচালনা করা হবে। কর্নেল জিয়া বলেন, অবৈধ এ ব্যবসার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। দেশ পঙ্গু করা এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভিওআইপি ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না।
প্রভাবশালীরা এতটাই শক্তিশালী যে তাদের আটক করলেও ধরে রাখা কষ্টকর। কর্নেল জিয়া বলেন, সরঞ্জাম উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়। কর্মচারীরাও হন গ্রেফতার। এসব মামলায় কোনো আসামির সাজা হয়েছে, এমন কথা কখনো শোনেননি বলে জানান র্যাবের এই পদস্থ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বিদেশে টাকা পাচার করলেও ব্যবসায়ীরা কখনো কখনো সে টাকা ফিরিয়েও আনতে পারেন না।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়ার পরিচালক উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান জানান, গত পাঁচ বছরে র্যাব দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৭৭টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে ২৩৭ জনকে র্যাব গ্রেফতার করে। এ ছাড়া উদ্ধার করেছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সরঞ্জাম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশাসনের জ্ঞাতসারেই অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা থেকে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে প্রভাবশালী চক্রটি। একসময় এ হাইটেক ব্যবসা গোপনে চললেও এখন তা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট।
মাঝেমধ্যে বিটিআরসি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো অভিযান চালালেও তাতে কোনো ফল হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, খোদ বেড়াই সাবড়ে নিচ্ছে খেতের ফসল। সংস্থাটির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার মদদে রাঘববোয়ালরা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে এ অবৈধ বাণিজ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, র্যাব হানা দিয়েও দমন করতে পারছে না এ শক্তিশালী চক্রকে। এদিকে দিনের পর দিন অবৈধ ভিওআইপিকারবারিদের কার্যক্রম বৃদ্ধি পেলেও এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসংবলিত যন্ত্রপাতি, প্রতিরোধ টিম, র্যাবের মাধ্যমে সরঞ্জামাদি উদ্ধার- এটুকুর মধ্যে সীমিত ছিল ভিওআইপিবিরোধী অভিযান। অথচ অবৈধ কল টার্মিনেশনে জড়িত রাঘববোয়ালরা বরাবরই থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকায় এসব রাঘববোয়ালের যোগসাজশে বিদেশিরাও এ দেশে অবৈধভাবে বসবাস করে বাধাহীনভাবে চালিয়ে গেছে অবৈধ কল টার্মিনেশন। একই সঙ্গে ব্যবসার সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক চক্রও গড়ে উঠেছে। ২২ ডিসেম্বর রাতে র্যাব রাজধানীর উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরে ৪১ ধরনের ভিওআইপি সরঞ্জামসহ অবৈধ অপারেটরদের গ্রেফতার করে।
এদের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিকদের পাশাপাশি ৩৭ জন বিদেশি নাগরিকও ছিল। এভাবে কিছু দিন পর পর অবৈধ ভিওআইপিকারবারিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা হলেও কার্যকর কিছুই হয় না; কেবল ঘটা করে গ্রেফতার এবং ফলাও প্রচারেই সার। ফলে অবৈধ ভিওআইপি অপারেটরদের কোনোরকম শাস্তির আওতায় আনা যায়নি। এমনকি বিদ্যমান আইনে দুর্বলতার কারণে অভিযুক্তরা সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়।
মামলা বা জব্দের কোনো ফল নেই : বিটিআরসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মিলে বিভিন্ন সময় ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামের নানা স্থানে অবৈধ ভিওআইপির মালামাল আটক এবং এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে।
প্রতিটি ঘটনায় একটি করে মামলাও হয়। কিন্তু সেসব মামলার কোনোটি আদালতে গেছে বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেয়েছে, এমন ঘটনা নেই। বরং জব্দ করা মালামাল বা যন্ত্রপাতিগুলো কোথায় যাচ্ছে, সে হিসাব বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিতে পারেনি। সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট আইনে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় বেরিয়ে এসে আবারও নিয়োজিত হয় অবৈধ ব্যবসায়। টেলিকমিউনিকেশন্স-সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের অভিমত, ২০০১ সাল এবং পরবর্তীকালে দুবার সংশোধিত টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনটিই কার্যত স্বার্থ রক্ষা করছে অবৈধ ভিওআইপি অপারেটরদের।
উত্তরা অভিযানে আটকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১ (সংশোধিত ২০০৬)-এর ৩৫(২) ধারায় মামলা করা হয়েছে বলেও জানা যায়। তাদের আশঙ্কা, সংশ্লিষ্ট আইনটি কার্যত অবৈধ ভিওআইপি অপারেটরদের স্বার্থ রক্ষা করে বিধায় এ আইনে মামলা হলে কিছু দিনের মধ্যে সহজেই বেরিয়ে আসবে অপরাধীরা। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন আদালতে ৭ হাজারের মতো অবৈধ ভিওআইপির মামলা রয়েছে। যদিও সরাসরি অবৈধ ভিওআইপি কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি নয় বলে জানা যায়। ২০০১ সালে বাংলাদেশ (টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণীত হওয়ার পর এসব মামলা রুজু করা হয়।
আইন প্রণয়নের পর এক যুগ অতিক্রান্ত হলেও একটি মামলায়ও আজ পর্যন্ত কারও শাস্তি হয়নি। বরং আইনগত দুর্বলতা ও অসঙ্গতির কারণে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে থেমে আছে এসব মামলার কার্যক্রম। ফলে অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষতি হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা উদ্ধারের বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশের টেলিকম বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অবৈধ ভিওআইপি রোধ করতে না পারার আরেকটি কারণ হলো এ খাতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া। আর বেশির ভাগ লাইসেন্স হাতিয়ে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বজনরা।
আগে দেশে আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদান করত মাত্র চারটি আইজিডবি্লউ প্রতিষ্ঠান। বর্তমান সরকার এ খাতে ব্যবসার জন্য আরও ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়। এতে ব্যবসায়িকভাবে প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে ২৯টি প্রতিষ্ঠান। সূত্রমতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে প্রতিযোগিতা এমন পর্যায়ে পেঁৗছায় যে কোনো কোনো আইজিডবি্লউ প্রতিষ্ঠান ৩ দশমিক ৪৫ সেন্টের পরিবর্তে দেড় থেকে দুই সেন্ট করে অবৈধ পথে কল টার্মিনেশন করা শুরু করে। রাজনৈতিক বিবেচনায় এ খাতে বেশিসংখ্যক লাইসেন্স দেওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।