এক সমৃদ্ধিশালী ও গতিশীল নির্বাচনী গণতন্ত্রের জন্য ভারতের রয়েছে স্বতন্ত্র ও স্থায়ী পরিচিতি, দীর্ঘ সময় থেকে যারা নিজেদের দাবি করে আসছে অর্থনৈতিক, পারমাণবিক ও তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে অন্যতম বলে। প্রতিষ্ঠিত অসাধারণ এক সংবিধান, যা প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম এবং দেশটির সব নাগরিকের। এ ছাড়া এতে কিছুটা স্বতন্ত্র অবদান রয়েছে নির্বাচন কমিশনেরও।
আধুনিক ভারতের সর্বজনীন পাকাপোক্ত ভোটাধিকারের রূপকার আর বিশেষ সম্প্রদায়গুলোর সাধারণ ভারতীয় নাগরিকরা ভীতি ও সন্দেহ সত্ত্বেও নিজেদের বিশ্বাস অটুট রেখে বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রতিনিধি নির্বাচন করেছেন মসনদে অধিষ্ঠিত করতে। এই নির্বাচনী গণতন্ত্র নানারূপে আখ্যায়িত হয়ে এসেছে- বিরাট অগ্রগতি, একটি সাহসী উদ্যোগ, একটি অতুলনীয় দুঃসাহসিক কাজ।
ভোটের আকারে সাধারণ মানুষের হাতে সরাসরি স্বাধীনতা এলো। এটি ছিল সেই সময়ের কথা, যখন ৮৪% ভারতীয় ছিল অশিক্ষিত। সমসংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন ছিল একটি অসম সমাজের অধীন, যা ভেঙে পড়েছিল একটি বর্ণভিত্তিক পুরোহিততান্ত্রিক পদ্ধতির দ্বারা। এসব বিষয়ের প্রমাণ পাওয়া যায় নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের সুবিদিত উক্তির মাধ্যমে, যথার্থই তিনি বলেছেন, গণতন্ত্রের জন্য নয়, একটি দেশ উপযোগী হয়ে ওঠে গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্রকে সামনে এগিয়ে নিতে সংবিধান সৃষ্টি করেছে ভারতে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন।
৬৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে কমিশন সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছে লোকসভার (নিম্নকক্ষ) ১৫টি আর রাজ্য বিধানসভার ৩৫০টিরও বেশি নির্বাচন, যা ছিল শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর। ভারতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর নেতাদের উত্থানের পেছনে কাজ করে থাকে সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠী, কৃষকশ্রেণী, নারী, সংখ্যালঘুদের ভোট। নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ নির্ণয়েও বড় ভূমিকা রেখে থাকে এই নির্বাচনী গণতন্ত্রচর্চা। দলগুলোর বিষমজাতীয়তা বৃদ্ধি এবং কোয়ালিশনের মাধ্যমে সরকার গঠন প্রতিফলিত করে নানা আকাঙ্ক্ষা। হালের ভারতীয় নির্বাচনের পরিসংখ্যান চমকে ওঠার মতো মনে হতে পারে, এমনকি আপনি যদি এটিকে কেবল সংখ্যার বিচারে দেখেন।
নতুন বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভারতের ৭৮০ মিলিয়ন ভোটার, যা কিনা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা দুই মহাদেশের সম্মিলিত, কিংবা ইউরোপের সব দেশের, কিংবা আফ্রিকার সামষ্টিক জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। ২০০৯ সালের সর্বশেষ ভারতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সংজ্ঞায়িত করা যায় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মানব-পরিচালিত নির্বাচন হিসেবে। এতে অংশ নেয় ৭১৪ মিলিয়ন ভোটার, ১.১৮ মিলিয়ন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এবং ১১ মিলিয়ন নির্বাচনী কর্মী। এর মাধ্যমে শুধু ভৌগোলিক বা ভোটারদের সংখ্যাগত দিক দিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের বিশালত্ব বোঝায় না। যে নির্বাচন কমিশন প্রত্যেক নাগরিকের কাছাকাছি পেঁৗছতে পেরেছে, এটি তাও নির্দেশ করে।
আমাদের এমনকি নিঃসঙ্গ ভোটারের জন্য পশ্চিম ভারতের গারো ফরেস্টে পৃথক ভোটকেন্দ্র আছে।
ভারত সম্ভবত পৃথিবীর বুকে অন্যতম বিচিত্র এক দেশ ভৌগোলিক কারণে। এখানে রয়েছে মরুভূমি, পর্বতরাজি, সমভূমি, বনভূমি, উপকূলীয় এলাকা। কিংবা এখানে রয়েছে নানা ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিচিত্র সংস্কৃতি, ভাষাভাষী ও জাতির বসবাস। আর এত সব বৈচিত্র্যের মধ্যে তো একটা মিলন বেশ জরুরি।
একই সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, নিরাপত্তা হুমকি, বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মেলানো, মধ্যম সারির তথ্য সমৃদ্ধির ধাবমান প্রত্যাশার মতো বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই। নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা রয়েছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। কোনো রকম অতিরিক্ত ব্যয় ছাড়া এবং সব দলের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তামূলক।
ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা অনবরত চলমান। পৃথক ব্যালট বাঙ্ েপ্রত্যেক প্রার্থীর জন্য ব্যবহার করা হয় পৃথক চিহ্ন পদ্ধতি।
ব্যবহার করা হয় ইভিএম। আর এই ইভিএম ব্যবহার খুবই সহজ। এটি বন্ধুত্বপূর্ণ, সাশ্রয়ী, দ্রুততম সময়ে ফল নিরূপক এবং ঝামেলাবিহীন ভোট গ্রাহক ও গণক।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা আমাদের নির্বাচনের একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। ক্ষমতাসীন দলের হাতেই থাকে রাষ্ট্রের সব সম্পদ।
কিন্তু এর পরও থাকে একটি স্বচ্ছ আচরণবিধি, যা অবশ্যই সব অংশগ্রহণকারীকে মেনে চলতে হয়, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের। নির্বাচন কমিশনের এই মডেল কোড অব কন্ডাক্ট (এমসিসি) বা আচরণবিধি ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করে। নির্বাচন কমিশন এর ক্ষমতা প্রয়োগ শুরু করে যে কোনো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে। এমসিসির কোনো সংবিধিবদ্ধ ব্যাকিং নেই এবং এর অনেক বিধিই আইনসিদ্ধভাবে প্রয়োগযোগ্য নয়। তবু এর ক্ষমতা বিশাল।
কারণ জনমতই এর ক্ষমতা প্রয়োগের নৈতিক অনুমোদন প্রদান করে থাকে। নির্বাচন কমিশন বেশ কার্যকর ও নিরপেক্ষভাবে পেশিশক্তির চ্যালেঞ্জকে প্রতিহত করে। কারণ এটি স্বীকৃত যে, দুর্নীতি ও অর্থশক্তি নির্বাচনী প্রক্রিয়া কলুষিত করতে পারে এবং গোপনে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এর প্রকৃত সম্ভাব্যতা।
নির্বাচন যে শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু হয় তা-ই নয়, এটি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং যথেষ্ট অংশগ্রহণমূলক। আমাদের ৬০ বছরের গণতান্ত্রিক ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, সাধারণত ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে থাকে।
একই ধরনের সমাজ কাঠামোর দেশগুলোর তুলনায় এটি ভালো পরিসংখ্যান। কিন্তু এটি অনেক কম আমরা যে ধরনের ভোটার উপস্থিতি প্রত্যাশা করি। সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমাদের সিস্টেমেটিক ভোটারস এডুকেশন অ্যান্ড ইলেকটোরাল পারটিসিপেশন (এসভিইইপি) পদ্ধতির দিকে যেতে হবে। এতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক প্রচার এবং সব নাগরিককে মাল্টিমিডিয়া-প্রচারণার আওতায়, এমনকি যুবকশ্রেণীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিটি নির্বাচনেই ভোটার সচেতনতা প্রকল্পের আওতায় আমরা সিভিল সোসাইটি ও গণমাধ্যমের অংশীদারিত্বে ভোটারের মেধা, মনোভাব, আচরণ ও অনুশীলনের বিজ্ঞানসম্মত জরিপ চালিয়ে থাকি।
কিছু অঙ্গরাজ্যে এ পদক্ষেপের চিত্তাকর্ষক সুফলও পাওয়া গেছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নির্বাচন কমিশন ২০১১ সাল থেকে প্রতিবছর ২৫ জানুয়ারি ন্যাশনাল ভোটারস ডে (এসভিডি) পালন করে আসছে। এর মধ্য দিয়ে ভোটার-সংখ্যা বৃদ্ধি, বিশেষ করে নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হয়। প্রথম ন্যাশনাল ভোটারস ডে-তে তালিকায় ৫.২ মিলিয়নের বেশি তরুণশ্রেণীর ভোটার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন বয়সী আরও প্রায় ১৭ মিলিয়ন ভোটার।
পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় এটি এক দিনে তরুণশ্রেণীর ভোটার অন্তর্ভুক্তি সবচেয়ে বেশি। ভারতের এই মডেল এখন বহু দেশ গ্রহণে আগ্রহী।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে গণতান্ত্রিক বিশ্ব এখানকার মেধাবী, দক্ষ ও অভিজ্ঞ নির্বাচনী কর্মীদের অনুসরণ করতে চায়। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চাহিদা, বিশেষ করে আফ্রো-এশিয়ান জাতিগুলোর চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে এখানকার নির্বাচন কমিশন ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট (আইআইডিইএম) সেবা দেওয়া শুরু করেছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে। প্রতিষ্ঠানটি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে।
প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মধ্যে সেবাকেন্দ্রটি ৪০টিরও বেশি আফ্রো-এশিয়ান ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশকে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছে। একই সঙ্গে তৈরি করেছে হাজার অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষক। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী এখন গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের সহযোগী।
সাংবিধানিক মনোনয়নের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করে না। ঢেলে সাজানোর জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে রয়েছে একাধিক প্রস্তাব, যেন নির্বাচন পদ্ধতি আরও পরিষ্কার হয়।
এর মধ্য দিয়ে কমিশনে যেন নির্মিত হয় এমন ভিত্তি, যেখানে উত্তম পরিচালন প্রক্রিয়া ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব। এ ছাড়া রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, অর্থব্যবস্থায় সুষ্ঠু নীতিমালার প্রচারাভিযান, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের মতো আরও কিছু প্রস্তাব রয়েছে। আমাদের একই মঞ্চে আসতে হবে এ বিষয়ে যে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আর কোনো সংবাদ হবে না। আমাদের অর্থশক্তির বিরুদ্ধে আর যুদ্ধ করতে হবে না। আমাদের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে, প্রত্যেক যোগ্য ভারতীয় নির্বাচনী বিধির আওতায় আসবে এবং প্রত্যেক নাগরিক তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে।
কমিশনের দর্শন হচ্ছে-'নির্বাচন হবে পুরোপুরি অপরাধ ও অর্থের অপব্যবহার থেকে মুক্ত। এর ভিত্তি হবে সঠিক নির্বাচনী বিধি এবং সব ভোটারের অংশগ্রহণমূলক। ' নির্ধারিত পথে আমাদের উন্নতি নিশ্চিত এবং অবিচল।
লেখক : ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : মুজাহিদুল হক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।