" তোমার আর আমার মধ্যে বেশকম কি জানো?" । আমি তার শার্টের পকেটের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললাম " জানি না, স্যার" । আমার গা ছাড়া উত্তরে আক্কাস সাহেব রেগে মেগে গেছেন । রেগে গেলে আক্কাস সাহেব চুপ করে বসে থাকেন। চেয়ার এদিকে ওদিকে দোলান।
আর বেশী রেগে গেলে তাকে বলে, " রেগে-মেগে " । রেগে-মেগে গেলে আক্কাস সাহেব পানির গ্লাস হাতে নিয়ে কাঁপতে থাকেন। পানির গ্লাস কাঁপতে থাকে। কাঁপতে কাঁপতে কিছু পানি তার পেন্টে গড়িয়ে পড়লে তার রেগে মেগে থাকা চলে যায়। পেন্টের দিকে মনযোগ দেন।
তবে আজ তার রাগ কমার কোন লক্ষন নেই। গ্লাসে পানি নেই । বোতলে বিদেশি মদ নেই। বাড়িতে সুন্দরী ছয় নাম্বার বউটা নেই। বড় শালিটা ও গেছে আরেকজনের সাথে।
সুন্দরী কাজের লোকটাও ছুটি নিয়েছে। বড় বউ গুলোও তার কাছে দিন দিন অসুন্দর হচ্ছে। মানে আজকে দিনটা তার জন্য খুব খারাপ।
মদের বোতলটা হাতে নিয়ে আক্কাস সাহেব বিড়বিড় করে গালি দিচ্ছেন। কাকে দিচ্ছেন তিনি হয়তো নিজেও জানেন না ।
সাথে সাথে বলছেন, " ধুর বাল! বালের বাল " । " ধুর বাল, বালের বাল" হচ্ছে একটা বিরক্ত প্রকাশ মূলক বাক্য। মানে আক্কাস সাহেব রেগে মেগে এখন বিরক্তে আছেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে খালি গ্লাসটা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, " চমক তোমারে জিজ্ঞাস করলাম না তোমার আর আমার মধ্যে বেশকম কি?" । আমি বললাম, " কোন বেশকম নাই।
শুধু আপনার ভুড়ি আছে আমার নাই " । তিনি হয়তো আমার কথা পছন্দ করেননি। কপালে ভাজ টেনে বললেন," এই পার্থক্যে চলবে না! আর শোন তুমি আমার সাথে মিক্স ভাষায় কথা কইবা না! বুঝছো কি বলসি? বইয়ের মতো শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলবা। তোমারে এমনে এমনে টাকা দেই না। আমার কথা মনযোগ দিয়া শুনবা আর উত্তর দিবা।
উত্তর ঠিকমতো না দেয়া হইতাসে বেয়াদপি। তুমি একটা আস্ত বেয়াদপ। " । আমি মুচকি হেসে বললাম, " যি আচ্ছা! " । এবারো হয়তো আমার উত্তর তার মন মতো হয়নি।
আমিও ঠিক তাকে রাগানোর জন্যই উত্তর গুলো দিচ্ছি। মানুষকে রাগানোর সুবিধা আছে। এখন যে রেগে রেগে কথা বলছে, রাগ কমলে সে ঠিক ঠিক নরম সুরে কথা বলবে। নিজের ভিন্ন চরিত্র একজনের সামনে প্রকাশ পেলে মানুষ লজ্জা পায়। লজ্জাতে কাতুকুতু খায়।
আক্কাস সাহেব ও ঠিক তেমনি বলবেন।
আক্কাস সাহেব তার প্রশ্নটা আবার করলেন, " তোমার আর আমার মধ্যে বেশকম কি? বইলা ফেলাও "। আমি তার শার্টের পকেটের দিকে তাকিয়ে বললাম," উত্তর বেশ সোজা। আপনি বিয়ে করেছেন আর আমি করিনি। শীতের দিনে আপনার বেশী কষ্ট করতে হয় আর আমার কম কষ্ট করতে হয় " ।
এবার আক্কাস সাহেবের রাগ মুখ থেকে গায়েব হয়েছে। আমার দিকে অবাক ভাবে মুখটা কিছুটা সামনে এনে বললেন," কিভাবে? "
" দেখেন সবাই ভাবে বিয়ে করলে শীতের দিনে বেশী ভালো থাকা যায়। অনেক সুখ। কথাটা ভুল। শীতের দিনে একা থাকাটা সুখ।
বউ সহ থাকলে তার সাথে এক কম্বলের নিচে শুইতে হবে। আর জানেন তো। মেয়ে মানুষের শরীর হয় সাপের মতো ঠান্ডা। এই হাড্ডি ফাটা শীতের রাতে বউয়ের শরীরে স্পর্শ লাগলে তো ঘুমের বারোটা বাইজা যাবে । একা ঘুমাইলে সবচেয়ে শান্তি।
মাঝরাতে উইঠা এক গ্লাস লাল পানি মেরে দেবেন সাথে একটা বেনসন সিগারেট। কুয়াশার মধ্যে খালি গায়ে দাড়ায় থাকবেন। হা করে কুয়াশা খাবেন। বিছানায় শোয়ার আগে একটা সিগারেট খাবেন। এরপর যে শান্তির ঘুম দিবেন তা ইহ জগৎ এ একশত সাদি করলেও পাবেন না।
আর সকালে উঠে কেউ আপনার কানের কাছে এসে কেচ কেচ করবে না কেনো জেগে ছিলেন। "
আক্কাস সাহেব ভাবছেন। তার ভাবতে বেশী ভালো লাগে। ভাবতে ভাবতেই তিনি ন'টা বিয়ে করেছেন। এছাড়া সম্পর্ক আছে চেনা জানা সবার সাথেই।
তার ধন - সম্পদের অভাব নেই। তিনটা ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে বাস আছে। ট্রাক আছে আটটা। কিন্তু কথা বলা মানুষের বেশ অভাব। তাই তিনি আমাকে টাকা দেন তার কথা শোনার জন্য আর তাকে কথা শোনানোর জন্য।
আক্কাস সাহেব ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন," চমক আমার জন্য এক কাপ লবন দিয়া চা বানাইয়া আনো। বেশী কইরা লবন দিবা। চা যেনো মোটেও মিষ্টি না হয়। লবন চা খাইলে মাথা ঠান্ডা হবে। ঠান্ডা হইলে বউ ছাইড়া দেয়ার চিন্তা করবো ।
আর শোন সুফিয়ারে আমার সাথে দেখা করতে বলবা। যদি দেখা করতে না চায় বলবা, সে আমার সাথে দেখা না করলে তার সব মায়ের খাওয়া বন্ধ থাকবে। তাও যদি দেখা করতে না চায় তাইলে কইসা একটা থাপ্পর দিবা। মাইয়া মানুষ বেয়াদপি করলে থাপ্পরের উপরে রাখতে হয়। যাও যাও জলদি যাও।
খাড়ায়া খাড়ায়া আমার খোমা দেখবা না। "
সুফিয়া আক্কাস সাহেবের বড় মেয়ে। এই বাড়িতে আসলে সুফিয়ার সাথে গল্প করেই আমার সময় কাটে। মানে সব কথা সুফিয়াই বলে। আমি বসে বসে শুনি।
সুফিয়া খুব ভাড়ি গলার মেয়ে। ওর গলার শব্দের সাথে দু পাঁচটা ঢোল বাজার শব্দ হয়। তবে মেয়েটার কথায় একটা মিহি টান আছে। ছেলেরা এসব মেয়েদের বলে, " লাফ লেডিস " । হাফ লেডিস মানে অর্ধ মহিলা ।
কিন্তু সুফিয়ার গলা ভাড় হলেও তাকে হাফ লেডিস বলা যায় না। মেয়েটা খুব সুন্দর ভঙ্গীতে কথা বলে। গুছিয়ে বলে।
আমি সুফিয়ার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তিনবার টক টক টক করে টোকা দিতেই সুফিয়া ভেতর থেকে বলে, " আমি মন্ত্রী মিনিস্টার না।
ভেতরে আসতে অনুমতি লাগে না। এরপর ও যদি অনুমতির অপেক্ষা করেন তবে অনুমতি পাবেন না। এবার আপনি ভেতরে আসবেন নাকি আসবেন না সেটা আপনার ব্যাপার " । আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকি। সুফিয়ার রুমটা খুব অন্ধকার।
মনে হবে এই মাত্র দিন থেকে রাত ঢুকলাম। পুরো দুনিয়ার মধ্যে এটা রাত বাক্স। সুফিয়াকে অন্ধকারের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সুফিয়া নিজেই বললো," অন্ধের মতো এদিকে ওদিকে ঘুরে লাভ নাই। আমি এখানে।
" । সুফিয়া ঘরের লাইটটা জ্বালালো।
সুফিয়ার রুমে তিনটা কাপড়ের পুতুল। প্রত্যেক পুতুলের মাঝখানে একটা করে ছুড়ি বসানো। যে কেউ দেখলে আঁতকে উঠবে।
আমি সুফিয়ার দিকে তাকালাম। মেয়েটার চোখের নিচে কালি জমে আছে। খুব কেঁদেছে হয়তো। সুফিয়া অত্যন্ত ধবধবে ফর্সা। আরেকটু ফর্সা হলেই ওকে বিদেশি বলা যাবে।
ছোট বেলায় ফর্সা মানুষ দেখলেই বলতাম, " আর ইউ বেদেশি?" । মানুষগুলো আমার কথায় হাসতো আর কিছু বলতো না। বুঝতাম বিদেশিরা আমাদের সব কথায় হাসে।
সুফিয়া একটা ঢিলা ঢোলা টি শার্ট পড়ে আছে। উপর থেকে তার চারটে বোতাম খোলা।
চুল গুলো খুব উস্কো খুস্কো। " কি বলতে আসছেন?"
" আসলে কিছু না। আক্কাস সাহেব আপনাকে ডেকেছে। "
" কেনো ডেকেছে? "
" তা বলতে পারবো না "
" আপনি ওই অমানুষের সাথে আছেন কেনো?"
" টাকার জন্য "
" মানে? "
" টাকার জন্য আছি "
" আপনার টাকার এতো প্রয়োজন যে অমানুষের সাথে থাকতে হবে? "
" আমার প্রয়োজন না। প্রয়োজন রুবেলের "
" রুবেল কে? "
" আজিমপুর থাকে।
একটা পা নেই "
" ওর জন্য কেনো টাকা লাগবে? "
" ও একটা দোকান দিবে। "
" কিসের দোকান? "
" ফার্মেসি "
" রুবেল আগে কি করতো? "
" মেডিকেলে পড়তো "
" পাশ করেছে? "
" না দুবছর আগেই পা খুইয়েছে "
" ওর বাবা মা কই? "
" গ্রামে। "
" আপনি ওকে সাহায্য করছেন কেনো? "
" সাহায্য করছি না"
" তাহলে? "
" ওকে বাঁচিয়ে রাখছি "
" বাঁচিয়ে রাখছেন মানে? আপনি কি বিধাতা নাকি? "
" নাহ! তবে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার মাঝে আনন্দ আছে। সে হয়তো প্রত্যেকটা সুখের সময় আপনাকে মনে করবে। "
" সুখের সময় মনে করলে আপনার লাভ? "
" মানুষ কাওকে নিজের সুখের সময় মনে করে না।
অতি সুখে মানুষ সবাইকে ভুলে গিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবে। কিন্তু আপনি যাকে বাঁচিয়ে রাখছেন সে আপনাকে সুখের সময় ভুলে যেতে পারবে না। আর আপনার মনে হবে সুখ হয়তো আকাশে বাতাসে ওড়ে। "
" উফফফ! "
" রেগে যাচ্ছেন? "
" রাগছি না। আপনার বানানো গল্পে বিরক্ত লাগছে "
" বিরক্ত লাগলে চোখ বন্ধ করে রাখবেন।
বিরক্ত পালাবে না দৌড়াবে। "
" আপনি চুপ করুন "
" আচ্ছা ওই পুতুল গুলো কার জন্য বানিয়েছেন? "
" বাবার জন্য "
" বাবার পেটে এভাবে ছুড়ি ঢোকাবেন? "
" হুম ঢোকাবো। কারন বাবা আমার মনে ছুরি ঢুকিয়েছে "
" কি করেছে? "
" আসাদকে খুন করেছে "
" পুলিশকে জানাননি? "
" লাভ নেই! আসাদের বোনকে এনে ধর্ষন করবে বাবা "
" আপনার বাবা এতো খারাপ মানুষ তবে বাবার সাথে আছেন কেনো? "
" উপায় নেই "
" কেনো? "
" তাহলে বড় মা'কে বাড়ি থেকে বের করে দেবে "
" আপনাকে নিচে ডাকছে। "
" পারবো না বলে দিন "
" আপনি না গেলে আপনার মায়েদের খাওয়া বন্ধ থাকবে। এর পর ও না গেলে আপনাকে থাপ্পর দেয়ার হুকুম আছে "
" আপনি আমাকে থাপ্পর দেবেন? "
" না দেবো না "
" কেনো দেবেন না? "
" থাপ্পরের জন্য আপনার বাবা আমাকে টাকা দেয় না "
" আপনি টাকার জন্য সব করেন? "
" যি না করিনা "
সুফিয়া তখন আমার দিকে মুখ খুকে তাকিয়ে আছে।
অবাক হয়নি ও। সুফিয়া অবাক হতে জানেনা। আমি রান্না ঘরে আক্কাস সাহেবের জন্য লবন দিয়ে চা বানিয়েছি । একটু চুমুক দিয়ে দেখলাম। হুম চা'টা ভালো।
নোনতা চা মন মিষ্টি করে দেয়।
আক্কাস সাহেবের রুমে ঢুকতেই দেখলাম সুফিয়া দাড়িয়ে আছে। ওর হাতে একটা রক্তাক্ত ছুড়ি। আক্কাস সাহেবের মদের গ্লাসটা এদিকে ওদিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আক্কাস সাহেবের বুকের ঠিক ডান পাশে আস্তে আস্তে রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে।
সুফিয়া আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেয়। আক্কাস সাহেবের পকেট থেকে চেকটা বের করে আমার হাতে তুলে দেয়। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, " দুক্ষে থাকলে মনে করো। জানো মানুষ দুক্ষে থাকলে শুধু নিজের সুখের জন্য ভাবে "
এরপর সুফিয়া নিজের বুকের মাঝে ছুরি চালিয়ে দেয়। হুট করে ফর্সা দেহি সুফিয়ার দেহ কেমন জানি লালচে হয়ে যায়।
মুখে তখনো মলিন না হওয়া হাসি।
রুবেল আজিমপুরে নতুন একটা ফার্মেসী দিয়েছে । প্রথম প্রথম সে একাই চালায়। দিনে দুবার ডাক্তার বসে। সবাই তার সহপাঠী ছিলো।
রুবেল নতুন দোকান দেয়ার সময় দোকানের নাম চেয়েছিলো। ভাবতে ভাবতে বলেছি, " সুফিয়া " । রুবেল তাই দিয়েছে। " সুফিয়া ফার্মেসি " । এই নামটা সম্পর্কে হয়তো কেউ জানবে না।
কেউ জানতেও চাইবে না। তবু নাম রহস্যে সুফিয়া হাসবে। সে হাসি দুঃখে থাকলে শুনবো, শোনাবো ....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।