মানুষ
অনিল বায়। ।
মনে হাঁসি না আসলে মুখে তার প্রকাশ করা কঠিন। আমার নানা ভাই আক্ষরিকার্থেই মনের মানুষ একজন । আক্ষরিক অর্থ ছাড়া বললে ছিলেন মাটির মানুষ ।
শুভ্র পিঠের ডানপাশটায় রাবারের মত একটা ‘বোটা’ ছিল। হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করে বুঝেছিলাম এটা শরীরেরই একটা অংশ। মনে হয়েছে পৃথিবীর সব নানাদের দাদা থেকে আলাদা করার জন্য এটা খোদাপ্রদত্ত সাংকেতিক চিহ্ণ। ছোটবেলায় এই নড়বড়ে বোটা নিয়ে অনেক খেলো করেছিলাম।
কাজ আদায় করার জন্য নানার ভালো ভালো স্ট্রাটেজি জানা ছিল ।
সাধে কি আর নাম ইবরাহীম বেপারী? কায়দা করে নাতিপুতিদের থেকে কীভাবে কাজ আদায় করতে হয় তা ভালোই রপ্ত ছিল মিতব্যায়ী লোকটির। তাল মারার মত কথা বলে কখনো ইট ভাঙানো, কখনো মাটি উত্তোলন এক কথায় খানদানি যুগালি যাকে বলে। তবে যুগালি থেকে অবসর নিতে আমার সময় লাগে নি। বড় হয়েছি মনে হোক বা না হোক ; চলে আসতে হল বড় নামের শহর ঢাকায়। মুগ্ধতা, মগ্নতা আর কিশোর রাজনীতির ব্যস্ততায় আমি তখন চিনতে শুরু করেছি আমার অচিনপূরিকে।
ইন্টার ২য় বর্ষে পড়ছি। পরিক্ষায় কীভাবে ১ম স্থান দখল করা যায় তার চিন্তা দখল করে আছে মাথার ষোল আনা। মায়ের ফোনও তখন তড়াৎ কথায় ‘রাখি ’ বলেছি। নানার সাথে বাড়ী গেলেই দেখা হত । ঢাকায় বসবাসের ২ বছর যখন ফ’র্তির সাথে পূর্তি করতে যাব তখনই এক বিকেলে দেখি আমার নোকেয়া ফোনে ‘আম্মা কলিং’ ভাসছে।
ভাইব্রেশনের জন্য মুঠো ফোনটিও কাঁপছে। সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে আম্মা এই প্রথম নানার ব্যাপারে কাঁপা গলায় বললেন ‘আগুনে পা পুড়ে গেছে তোর নানা ভাইর। ‘আমি আর তোর ছোটমামা আছি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে- দেখতে আয়। ’ আম্মার গলার স্বরে আমি ভিতিকর কিছু পেলাম না। তবে ফোন ধরার আগে ভাইব্রেরশনের নিষ্ঠুর রসায়ণের জন্য মনে অজানা আতঙ্ক জেগেছিল- মিথ্যা বলব না।
যাই হোক পর দিন ভোরেই বাস-রিক্সা করে চলে যাই পোড়াদের উপশমালয় ঢামেকের বার্ন ইউনিটে। হাটি হাটি পা-পা করে আগুচ্ছি আর আমার শ্বাস প্রশ্বাস ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে। যে কামড়াটায় নানাভাই সেটা দোতলায়। তবে কামড়ায় ঢোকার করিডোরের অবস্থা চোখের অনুপযোগি। এবলো থেবলো করে জীবন্ত পোড়া দেহগুলোকে বিছানার অভাবে করিডোরে জায়গা দেয়া হয়েছে।
মনে হচ্ছিল জিবন্ত জাহান্নামের মাঝখান দিয়ে হেটে যাচ্ছি। কচাৎ কোন পাশে চোখ গেলে আমিও পুলসিরাত থেকে মর্তের দূরত্বে পড়ে যাব। পোড়া দেহের আর্তচিৎকার শুনা ভাগ্যেরও ব্যাপার বটে।
গেলাম খোলামেলা ওয়ার্ডের ১ম কেবিনে। আম্মা নিরাবেগ দৃষ্টিতে আমাকে দেখলেন।
পাশে আজন্মা অবলা, নিজ পরিবারে নিষ্কর্মা , তবে আমার ছোট মামা। মুখখানি হাফ ইঞ্চি খোলা রেখে বাপের দিক করে বসা। নানার শরীরের কতটুকু পুড়েছে আমি জানি না-তারপরও অযথাই নিজেকে অপরাধীর চেহারা বানিয়ে আম্মার কাছে গিয়ে দাঁড়লুম। আম¥ার জনমভরের সেই প্রশ্ন ‘কিরে, আইচত?’ এবার একটানা গত কয়েকদিনের জমিয়ে রাখা কথাগুলো ছোট ছোট ব্রেক দিয়ে বলতে লাগলেন । ‘ বাাবারে- তোর নানাভাইরে দেক , শরিটটা পুইড়া গেছে।
এই গ্যাাসের আগুন। গেছিলো আগুন পোহাইত... পিছন দিয়া আগুন ধইরা গেছে কইত পাত্তনা। ” ...‘ আগুনের যন্ত্রনায় দৌড়াইছে আর চিল্লাইছে। বাসার সবাই আগুন নিভানেল্লেই আইছে, কাঁচা ডিম ভাইঙা গায়ে মাখছে। ’’ আমি বল্লাম,‘তই, সাথে সাথে হাসপতাল নিলে কি হইত?’ ‘তোর নানু তো কইছে কলা পাতাত শুয়াইয়া রাখব , তারপরও ডাক্তারের ধারে নিত না।
আমি তো জোড় কইরা লইয়্যা আইলাম। ’ -আম্মার আতœপক্ষ সমর্থণ। খানিক্ষণ সেখানে থাকতেই আমি বিষিয়ে উঠলাম। চারপাশে কেবলই পোড়া রোগী। পরদিন আবার আসলাম।
ঢামেকের সামনে সালাদিয়া দোকানগুলোর সুস্বাদু মাংসেল মাছ আনা হল দুপুরে খাওয়ার জন্য। রোগীর পাশে বসেই খাাওয়া দাওয়া সারতে হবে। আমি দেখলাম আমার সহাত্মরা দেদারছে মেরে দিচ্ছে দুপুরের লাঞ্চ, আর আমার গলায় মাছের মাংসও কাটার মত বিঁধছে। পৃথিবীতে সুস্বাদু খাবারের পূর্বশর্ত যে নিশ্চিন্তা সেদিনই প্রথম বুঝলাম। তবে চারপাশের সহাক্ষদের অবস্থা দেখে আমি আক্কেল গুরুম! পাশে আধামরা রোগী রেখে যে কায়দায় একের পর এক পরোটা মুখে পুড়ছে তাতে মনে হচ্ছে পরোটাকে একলা পেয়ে ঝাল মিটাচ্ছে।
মন বলে যে তাদের কিছু আছে অন্তত সে সময়কার জন্য আমার মনে হয় নি।
নানা ইস্যূতে নানাকে দেখতে আসতে হত মাঝে মাঝেই। কখনো ও + রক্তের সংগ্রহ করে সহপাঠিদের নিয়ে রাজকীয় ভঙিমায় ঢামেকে অবতরণ আবার নানার রক্তাল্প শুটকি দেহের রক্তের সেম্পল টিভি দেখতে গিয়ে হাত থেকে ফেলে দেয়া- মিশ্র এই সব স্মৃতির মধ্য দিয়ে আমার স্মৃতির ডায়েরী ভারি করা । চিরুনী অভিযানের শিকার হয়েও হাসপাতালে পুলিশের তল্লাশির খবর ধৈর্য ধরে শুনেছি, আবার কখনো ভবি ভার্সিটি ভর্তির প্রসÍুতির কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স সাথে থাকায় ‘শিবিরের চটি বই নাতো?’- জাতীয় প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়েছি। মাস খানেক এভাবেই কেটে গেল।
এর মাঝেই এক সন্ধ্যেয় ফারুক সড়কের কাছে সোনালী হোটেলে বসে চনা বুটের অর্ডার করলাম। ৬ টাকার বেশী না এটা জানি। ওয়েটার বয়স্ক। ঠিকঠাক সার্ভ করলেন। খাওয়ার মাঝখানে আম্মার ফোন ।
আমি নির্বিগ্ন। দিনকয়েক আগে নানাভাইকে দেখে এসেছি সুস্থের পথে; অতএব রক্ত টক্তের প্রয়োজনে বোধ হয়। আম্মা যেভাবে বললেন সেটা নানার মৃত্যুসংবাদ থেকেও ভয়ংকর। এমন সাদামাটা ভাষায় নিজের বাবার মৃত্যুর খবর দিলেন আমি হকচকিৎ হয়ে গেলাম। গলা শুকিয়ে আসছিল।
বিশ্বাস হচ্ছিল না। রক্ত চলাচল ঠিক টের পাচ্ছি। কল্পনায় আঁকার চেষ্টা করছি আমার নানার মৃতমুখখানি। নাহ! কেমন যানি অসম্ভব আর অবাস্তব মনে হচ্ছিল সব। চনা বুটকে গনেশ উল্টিয়ে আমি পা বাড়ালাম বাসার দিকে ।
ছাত্রাবাসের ৪১৫ নম্বর রুম। ঝটপট রেডি,গেঞ্জি খুলে গাঁয়ে জানাযা উপযোগী পাঞ্জাবী। বাসে আসার সময় ভাবছিলাম পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিব। আসার সময় অবশ্য সহপাঠি যোগ সহাক্ষরা শক্ত থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। জ্যামের মধ্যে সান্তনা দেয়ার বাক্য রচনারও খানিকটা স্পর্ধা দেখিয়েছি।
ঢামেকের গেটে এসে পা আর এগুচ্ছে না। গরমের মধ্যেও যেন আচমকা একটা গোরস্তানীয় বাতাস বয়ে গেল সারা শরীরে । গেথে বসা ভয় কাটাতে আম্মাকে ফোন দিয়ে বল্লাম ‘আমি আইচি’। আমাকে কয়েকগুন অবাক করে আম্মা শান্ত গলায় বল্লেন ‘আয়’। সরাসরি কেবিনে না গিয়ে দূর থেকে ওয়ার্ডের দরজায় দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি আন্দাাজ করার চেষ্টা করলাম।
মহিলাদের বিলাপ কান্না মৃত্যুুর চাইতেও বেশী মনকে এফোরওফোর করে দেয়।
এ্যাকি! আমি কি দেখছি! মেঝো মামা আমার নড়চড়হীন নানার মুখে কলা পুড়ছেন! আম্মা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আমার বুঝতে বাঁকি নেই-মেরা বাপ হারিয়ে , মেরা তার ছিঁড়িয়ে। অধিক শোকে পাথর হয় মানুষ -পাগল হয় জানতাম না।
মেঝো মামার এ আচরণের লিখিত রুপ যেন-‘মরলি ক্যান বাপ এত আগে? নে খা... কলাটা খা...।
’ মনে হচ্ছিল পাশের সব সহাক্ষরা আজ দর্শক বনে গেছে। পিনপতন নিরবতায় আমি গিয়ে কাছে দাঁড়ালাম।
খানিকটা সময় এভাবে কেটে যায়। এর মাঝে আম্মা বসতে বললেন। তবে বিস্ময়ের তখনও বাঁকি ছিল।
আমার চোখ চড়ক গাছ হল তখন যখন হাল্কা আওয়াজে নানা বললেন ‘রুজি পানি খাব’ । হিতাহিত জ্ঞান তখন শূন্যের কোটায়। মানে কি? এতক্ষণ তবে কি হল। ১০ মিনিট ধরে মৃত্যু প্রসঙ্গ তুললামই না। এবার আম্মাই বললেন সদর ঘাটে ৯ টার পর লঞ্চ আছে কিনা? আমার প্রশ্ন কি জন্য।
‘বাড়ী যাইতে হইব না? তোরে তো এই জন্যই আনলাম। ’ বাড়ীত কী হইছে আমার প্রশ্ন। ‘ফোনে না বল্লাম তোর দাদায় মারা গেছে!!!...!!!...!!! আমি এবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। সাথে সাথে আগেই জানতাম ভাব দেখালাম। আসলে আম্মা নানাভাইর কাছে থাকায় আমার ছোট বোনের মত আমার কানেও ‘দাদা’ শব্দটি ‘নানা’ ঠেকেছিল।
নানাভাই বেঁচে আছেন তখন থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। দাদার কথা মাথায়ই আসে নি । দাদার জন্য এবার আম্মাকে হাল্কা বিলাপ করতে দেখলাম। তখন দাদার কথা খুব মনে পড়ছিল। আহা! শহুরে জীবন আমাদের এতটা দানব করে তুলেছে যে দাদা নামের সম্বোদনটিও সেকেলে মনে হচ্ছে।
বুকের ব্যাথা বুকে বয়ে দাদার লাশ কাঁধে তুললাম আমরা নাতিরা। শেষ বিদায়ের পালা। দাদাকে শেষবার ডাকতেও পারলাম না। সেদিন রাতে আসার সময় নানা বলেছিলেন ‘স্বপ্নে দেখেছি খাদের কিনারে সাদা পোশাকে আমরা দু’ জনা। তোর দাদা আগে পড়ে যায়,তার কিছুক্ষণ পর আমি পড়ে যাই।
’ স্বপ্নকে সত্যি করে পনর দিনের মাথায় আমার সব বিস্ময়কে সাধারণ ঘটনা বানিয়ে নানা ভাই পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। সাদা পোশাকে। মাটির মানুষ মাটির ঘরে। আমার শৈশব, কৈশরের স্মৃতিকে বিরহের মূর্ছনা দিয়ে। বাঁশবাগানের ঐ পাশটায়।
আমি আসছি নানাভাই তোমায় দেখতে। তোমার দ্বিতীয় মৃত্যুর পরে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।