আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বইমেলা ১৯৭৭, স্মৃতিচারণ

ও পথ মাড়িও না যে পথ তুমি চেননাকো----


১৯৭৭ সালে ঢাকাতে প্রথম যাই বইমেলাতে। বাংলা একাডেমির পূর্ব দিকের গেট , ঐ একটাই গেট ছিল আর তা দিয়ে হাতে গোনা উৎস্যুক দর্শকের সমাগম হতো । মুক্তধারা, নওরোজ, ইউনিভারসিটি প্রেস আর কিছু লাইব্রেরী তাদের ও অন্যের প্রকাশ বা সংগ্রহ নিয়ে সাজগোজহীন নিরাভরণ বই মেলায় অংশ নিয়েছিল । আমার সিনিয়র রেজা ভাই আমায় নিয়ে যেতেন এসব আয়োজনে । তখন ঢাকা শহরের এদিকটায় বিনোদনের কিছুই ছিলনা ।


প্রায় জনমানবহীন রাস্তা আর একাডেমীর পিছনে বন জঙ্গল ও একটা দুটো বাড়ী ছিল কর্মচারিদের জন্য । তিনটি স্টল মোটামুটি বইতে পরিপূর্ণ আর বাকীরা ডেকোরেটরের টেবিলে সাদা চাদর বিছিয়ে বই রেখেছিলেন । মুক্তধারা তাদের দোকানের শোকেস নিয়ে এসেছিলেন বইমেলায় । রাতে বই গুছিয়ে রাখা হতো আর কর্মচারীদের কেঁউ একজন মশারি লাগিয়ে মাটিতে ঘুমাতেন । বড় সহযোগিতার ভাব ছিল বই বিক্রেতাদের মধ্যে ।



মাত্র সাতটি স্টল ছিল ১৯৭৭ সালে । মুক্তধারা পরিপূর্ণ , বাকিদুটো আংশিক আর অন্যরা কোনমতে যারা রাতে বই বেঁধে একটি স্টলে রাখতেন । ২১ ফেব্রুয়ারির আগের দিন আরও কয়টি বই বেচার প্রতিষ্ঠান হাজির হোল বই আর ম্যাগাজিন নিয়ে । শুরুই হয়েছিল ১৪ কি ১৫ তারিখে আর শেষ হয়েছিল ২১র সন্ধ্যা রাত্রে । ২১র দিনটায় সকালেই ভিড় করছিলো শহীদমিনারে আগত বাঙ্গালী সুজন যারা মালা দিয়ে স্মরণ করেছিল ভাষা শহীদদের ।

আমিও মিনারে ফুল দিয়ে সারা দিন বইমেলায় মানুষ গুনেছি ।
চারুকলা তখন আর্ট কলেজে আমরা স্বউদ্যোগী হয়ে প্রচার চালাতাম বা উদ্ভুদ্ধ করতাম মেলায় যেতে যাতে আমরা ফাঁকা জায়গায় ঘাসের উপর গোল হয়ে বসে বাদাম খেয়ে আড্ডা দিতে পারি । আমাদের অনুরোধ খুব কাজে দেয়নি কারন শাহনেওয়াজ হলের বাসিন্দারা খুব ক্ষুধার্ত থাকত আর ৬টা বাজতেই গরম খাবারে তারা মনোনিবেশ করত । আমার সহপাঠীদের নিয়মিত না পেলেও রেজা ভাই ও আরও কজন উপরের ক্লাসের ছাত্র অথবা পাশ করে যাওয়া আর্টিস্টরা থাকতেন ।
নতুন বই কনসেপ্ট টা তখন ছিলনা বা কেউ ২১কে সামনে রেখে কোন বই ছাপাননি ।

কিছু লেখক ও কবিকে দেখেছি তখন মেলাতে । প্রকাশকরা তাদের বছরওয়ারি প্রকাশনা নিয়ে এসেছিলেন । বাইরে একটি চটপটির দোকান সাহস করে দাড়িয়ে ছিল হ্যাজাক জালিয়ে । তখন অত পয়সা পকেটে থাকত না যে বই কিনব তবে রেজা ভাই তিনখানি বই কিনেছিলেন মেলা থেকে যা দেখতে হলের অনেক ছেলেই এসেছিল । রেজা ভাইয়ের সহপাঠীরা বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন কে কখন পড়বেন ।

এখন যেমন বই সংগ্রহের ভিড় তখন চিত্রটি ছিল হতাশার । সবগুলো স্টল মিলিয়ে কয়শ টাকা মাত্র বেচেছিলেন । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গিয়েছি মেলায় তাও দিনের বেলায় ভিড় এড়াতে ছেলে আর মেয়ের জন্য বই কিনতে । নিজেও কিনেছি প্রবন্ধ,ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ক বই। ২০০৮এর সন্ধ্যায় ধরা খেয়ে গেলাম প্রচণ্ড ভিড়ে ।

ভিড় যেদিক ঠেলে নিয়ে যায় সেদিকে যাই, অবস্থাটা বড় দুরুহ কিন্তু আনন্দদায়ক এজন্য যে মেলা অর্থাৎ বইমেলা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে । ৮২ থেকে একটা দীর্ঘ অনুপস্থিতি ছিল উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ গমন এবং শেষে চাকুরিতে কিছুকাল অবস্থান । বইমেলার এইযে সার্থকতা তার পেছনে এক বিশাল অবদান রয়েছে চিত্ত রঞ্জন বাবুর । বাংলাদেশে বই পড়া অভ্যাস তৈরির জন্য লেখক, প্রকাশক ও বইমেলার অবদান সবচে বেশী । এদের কাউকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই ।

বইমেলা প্রতিস্ঠিত হয়ে গেলে সরকার এগিয়ে এলেন । এর কৃতিত্ব কোনও সরকারের নেই । আছে প্রকাশক ও লেখকদের । এবার বইমেলা রেসকোর্স উদ্যানে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে । তাতে মনে হয় মাছের বাজারের ভাবটা দূর হবে যদিও যাইনি এখনো , যাবো ,নীলসাধুদের স্টলে আড্ডা দিতে হবেনা ? বাদামওতো খেতে হবে ।


একুশ,বইমেলা, বৈশাখ এখন বাঙ্গালী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে । যে বা যারা যেভাবেই চেষ্টা করুকনা কেন নাড়ীর ভিতরে বয়ে চলা ত্রয়ীর উচ্ছ্বাস আর অদম্যতাকে কখনো বন্ধ করা যাবেনা ।
শুভ বইমেলা !!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।