আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঠাকুর ঘরে কে রে_ আমি কলা খাই না

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন, 'রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বর্ধিত ফি বাতিল হওয়ায় ছাত্রলীগ মিছিল করছিল। সেখানে হামলা হয়েছে। ছাত্রলীগ প্রতিবাদ করেছে। ' তিনি আরও বলেছেন, 'যত জনের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে, তারা সবাই ছাত্রলীগের নয়। ' প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে_ 'ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাই না।

' আমরা এর আগেও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য শুনেছি। তিনি বিভিন্ন ঘটনায় ছাত্রলীগকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি বলেছিলেন, 'বিশ্বজিৎ হত্যার সঙ্গে জড়িতরা ছাত্রলীগের কেউ নয়। ' এ হত্যাকাণ্ডের রায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আটজনের ফাঁসি ও ১৩ জনের যাবজ্জীবনের আদেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে একের পর এক ছাড় পাওয়ার ফলে ছাত্রলীগ দিন দিন হয়ে উঠেছে এক অপ্রতিরোধ্য সন্ত্রাসী শক্তিতে।

যার খেসারত তাকে ২০০১ সালের নির্বাচনে দিতে হয়েছে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পেছনে ছাত্রলীগের দায় অনেক।

এর আগে ছাত্র সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসী কার্যকলাপের খেসারত দিতে হয়েছে দলগুলোকে। ছাত্ররাজনীতিকে ব্যবসা বানিয়ে দুর্নীতির শিরোমণি বনে যাওয়া ছাত্রদলের নেতাদের কল্যাণে বিএনপির পরিণতি আরও খারাপ। ছাত্র সংগঠনগুলোর লাগাম টেনে না ধরলে কী বিপর্যয় হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ তো এগুলোই।

গত শতাব্দীর '৯০-এর নির্বাচনের পর ঢাবির কিছু হল ছাত্রদল এবং কিছু হল ছাত্রলীগের দখলে ছিল। মেয়াদের শেষ দিকে এসে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল দখল করে নেয়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয়েই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। ২০০১ এর নির্বাচনের পরপরই ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে ছাত্রদল আবার হলগুলো পুনঃদখল করে নেয়। দুই পক্ষই তাদের সময়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।

বিএনপির শেষ মেয়াদে ছাত্রদলের সঙ্গে যোগ দেয় ছাত্রশিবির।

মনে আছে, ২০০১ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ ও জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের দখলমুক্ত করতে ছাত্রদলের ক্যাডাররা লাঠিসোঁটা দিয়ে ভাঙচুরের পাশাপাশি গোলাগুলি করেছিল। পিস্তল ও কাটা রাইফেল নিয়ে ছাত্রদলের ক্যাডারদের হল দখলের বেশ কিছু ছবি সে সময় ঢাকার বিভিন্ন দৈনিকে ছাপাও হয়েছিল। জগন্নাথ হল দখল শেষে তৎকালীন ছাত্রদলের সভাপতি নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টু সেখানে হাজির হয়েছিলেন। তিনি ছাত্রদলের ক্যাডারদের সাফল্যে তাদের ধন্যবাদ জানান, উৎসাহ জোগান।

তারপর তার ক্যাডার বাহিনী পিস্তল আর বন্দুক নিয়ে জহুরুল হক হলের দখল নেয়। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর ছাত্রদলের হল দখলের পরদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির তৃৃতীয় বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে কোনো ধরনের জবরদখলের জন্য দায়ী এবং অবৈধ অস্ত্রধারী যে-ই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। তারপর ১৭ নভেম্বর ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। আর নির্বাচনে বিজয়ের এক মাস ১০ দিন পর ছাত্রদলের সভাপতি নাসির উদ্দীন পিন্টুকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু নয় মাস পর ছাত্রদলকে আবার সক্রিয় করা হয় এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসী, অছাত্র ও ঠিকাদারসহ ছাত্রদলের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।

এর পর ছাত্রদলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কখনো বন্ধ হয়নি। বিএনপির নেতৃৃত্বাধীন জোট সরকারের পাঁচ বছর ধরেই তাদের অব্যাহত সন্ত্রাস, বন্দুকযুদ্ধ, অপহরণ, হত্যা, চাঁদাবাজি, জবরদখল চলে। এসব কিছুর পরিণতি কী হয়েছিল, তা আমরা জানি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট মাত্র ৩১টি আসন পেয়ে ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়েছে।

অনেক আগেই ছাত্রলীগ তার এসব দীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে।

জন্মবৃত্ত, ইতিহাস-ঐতিহ্য যখন বিলোপ সাধন করে, অস্বীকার করে, তখন বুঝে নিতে হবে, সে জারজ। বড় লজ্জার সঙ্গে, বড় নির্মম দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এরা 'নামে বঙ্গবন্ধু'র ফেনা তোলে, কামে কিচ্ছু না, বঙ্গবন্ধুরে বেচে। ' এই হচ্ছে ছাত্রলীগের এখনকার চরিত্র। বর্তমান সাধারণ ছাত্রলীগ কর্মীরা জানে না বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কী, জয় বাংলা কী, ধর্মনিরপেক্ষতা কী, বাষট্টির শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনে কী ছিল, ছেষট্টির ছয় দফার কিংবা ঊনসত্তরের ১১ দফার দফাগুলো কী কী ছিল, আগরতলা ষড়যন্ত্র কী, বাকশাল কী_ এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে অনেক ক্ষমতাবান ছাত্রলীগ কর্মীও নিশ্চুপ হয়ে থাকে!

সম্প্রতি ছাত্রলীগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনার জন্ম দিয়েছে, তাতে আমি অবাক হইনি। এর আগেও তারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এরকম মহড়া দিয়েছে।

দিন দিন তাদের মহড়া ভয়াবহ দানবীরূপে মঞ্চায়িত হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের চলনে-বলনে নৃশংসতার চরিত্র পরিষ্কার হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যখন এসব নিন্দনীয় কাজ করার পাসপোর্ট-ভিসা দেওয়া হয়, বৈধতা দেওয়া হয়, তখন 'অবাক', 'বিস্ময়' বলে যেসব আভিধানিক শব্দ আছে সেগুলো অচল হয়ে যায়।

অনেক আগ থেকেই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ধ্বংসাত্দক এবং আইনবিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধিপত্য বিস্তার, হল দখল, কক্ষ ভাঙচুর, তালা ঝুলিয়ে দেওয়া এবং লাঠি ও ইটপাটকেল ছুড়ে মারামারির ঘটনা ঘটেছে।

এসব ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অন্য মন্ত্রীরা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধের চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। স্বয়ং শেখ হাসিনার নির্দেশের পরও তারা থামেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক পদ ছেড়ে দেন। কিন্তু এসবে কোনো ফল হয়নি। বিভিন্ন শাখার ছাত্রলীগের কমিটির বিপরীতে একাধিক পাল্টা কমিটি রয়েছে।

তাদের মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা, দলীয় আদর্শ, চেইন অব কমান্ড বলে কিছু নেই।

মাঝে-মধ্যে ছাত্রলীগের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। আর কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। সাময়িকভাবে কার্যক্রম স্থগিত করা বা সতর্ক করার ফলে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ছাত্রলীগের এসব ঘটনায় প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছে? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় এটি স্পষ্ট হয়েছে, ছাত্রলীগের অন্যায়-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে তারা সহযোগিতা করছে।

পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে চড়াও হওয়ার বহু ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে। এমনকি অন্তত কয়েকবার সংবাদপত্রে ছবি ছাপা হয়েছে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব বা অন্য দলের উপরে চড়াও হওয়ার সময়ে ছাত্রলীগের সুনির্দিষ্ট নেতা-কর্মীর হাতে অস্ত্রের ছবি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার সময় যে ছয়জনকে অস্ত্র হাতে দেখা গেছে, তাদের পাঁচজনই ছাত্রলীগের নেতা। রাবির ছাত্রলীগ নেতা ইমন যে পিস্তল দিয়ে গুলি করছিলেন, তার ব্র্যান্ডের নাম বেরেটা টমক্যাট। দাম তিন লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা।

প্রশ্ন হলো, ইমন এ বন্দুকের এত টাকা পেলেন কোথায়? কে বা কাদের এতে সম্পৃক্ততা রয়েছে? দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনার ষড়যন্ত্রের তদন্ত হওয়ার যেমন যৌক্তিকতা রয়েছে, তেমনি ছাত্রলীগ নেতাদের এসব অস্ত্র কেনার অর্থের উৎস ও প্রাপ্তি কীভাবে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, 'এর আগে বিশ্বজিতের ঘটনায় আমাদের মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল, এখন এ ঘটনায় আমাদের নাক-কান কাটা গেল। ' তার এই বোধোদয়ের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সফলতা রয়েছে। এক ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেই তাদের সেই সাফল্যে কালির অাঁচড় পড়তে শুরু করেছে।

সন্ত্রাস বন্ধে সরকারের সদিচ্ছাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এখনই ছাত্রলীগের লাগাম টেনে না ধরা হলে ভবিষ্যতে সরকারকে আরও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এখানে শিথিলতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন।

তার এ নির্দেশের ভেতর সাধারণ মানুষ কোনো শর্ষে ভূত দেখতে চায় না।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি, রাজনৈতিক কর্মী।

বসড়হহ.যধনরন@মসধরষ.পড়স

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।