আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উপহার নয়, নগদ ক্যাশ দিন

অনেক দিন পর ২০ জানুয়ারি সখিপুর উপজেলা মাঠে শওকত মোমেন শাজাহানের জানাজায় বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা। আমার কথা জানি না কিন্তু তার শরীরটা খারাপ লেগেছিল। কয়েক দিন পর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোন করতেই শুনলাম, তার নাকি শরীরটা খারাপ। সব সময় যেমন বলেন তেমনই বলেছিলেন, না তেমন কিছু না। তার দুই দিন পর বানী খালা কাঁদতে কাঁদতে এসে বললেন, 'বজ্র, বড় বাবার কী হয়েছে?' পরিবারের মুরবি্ব হিসেবে এক খালা আর এক চাচা বেঁচে আছেন।

আর সবাই চলে গেছেন পরপারে। খালাকে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। অনেকবার ফোন করেছিলাম বড় ভাইকে। কিন্তু ধরতে পারিনি। এখন মন্ত্রীদের বাড়িতে তেমন কোনো শৃঙ্খলা নেই।

কেউ কোনো কিছু কর্তব্য মনে করে না। বড়-ছোটর কোনো বাছবিচার নেই। মাননীয় মন্ত্রীর পিএ-পিএসদের অনেকবার ফোন করেও সাড়া পাইনি। সবাই রাজা রাজার রাজত্বে_ কেউ ফোন ধরে না। খালার কান্নায় অচল থাকতে পারিনি।

ফোন করেছিলাম ভিসি প্রাণ গোপাল দত্ত, ডা. শরীফুল, অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল্লাহকে। কারও কথাই পরিষ্কার ছিল না। ডা. শরীফ বলছিল, বিলোরবিন বেড়েছে। অ আর ঊ পরীক্ষা হয়েছে। রেজাল্ট নেগেটিভ।

জিজ্ঞাসা করলাম, অ আর ঊ করা হলো ই, ঈ, উ কেন হলো না? সন্তোষজনক জবাব পাইনি। ততক্ষণে ছড়িয়ে গেছে হেপাটাইটিস বি। জন্ডিসে হেপাটাইটিস বি'র কয়েক বছর আগেও কোনো চিকিৎসা ছিল না। এখন অনেকটা ফলপ্রসূ চিকিৎসা আছে। ঈ, উ'র চিকিৎসা আরও কঠিন।

মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে খালা এসেছিলেন। বাইরে কান্না না এলেও ভেতরে রাখতে পারছিলাম না_ 'যে-কান্না এলো না চোখে, মর্মে হ'ল লীন,/বক্ষে তাহা নিল বাসা, হ'ল রক্তে রাঙা/আশাহীন ভালবাসা, ভাষা অশ্রু-ভাঙা!' আমরা এখনো ৭ ভাই, ৩ বোন, যে যেভাবেই থাকি, যেভাবেই চলি, তবু আল্লাহর দয়ায় এখনো বেঁচে আছি। বাবা গেছেন ১৪ বছর, মা নেই সাড়ে ৭ বছর। পৃথিবীজুড়ে এখনো আমরা হারাধনের ১০ সন্তান বেঁচে আছি।

বড় ভাইয়ের ছোট আমার বড় দুই ভাই-বোন ছিল। বিনা চিকিৎসায় হঠাৎ তারা মারা যায়। যে কষ্টে বাবা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিলেন। শহরে আসায় মৃত্যু আমাদের বাড়ি ছেড়েছে। এখনো আল্লাহতায়ালা আজরাইল ফেরেশতাকে আমাদের বাড়ি পাঠাননি।

বড় ভাই একটু চিরচিরে। তিনি দলের বাইরে কিছু চিন্তা করেন না। তবু কেন যেন সব সময় মনে হয়, তিনি চলে গেলে আমিও বেশি দিন থাকব না। ২০০৪ সালে মা চলে যাওয়ার পর বুকটা খালি হয়ে গিয়েছিল। সব সময় খালি খালি মনে হতো।

দিন-দুনিয়ার কোনো কিছু ভালো লাগত না। কুশিমনি আসায় আমার সে শূন্যতা অনেকটাই পূর্ণ হয়েছে। ওর জন্য বাড়ির সবাই আমরা ব্যস্ত থাকি। ওকে সময় দিতে, ওকে নিয়ে থাকতে কেন যেন সবার ভালো লাগে। সেদিন তার ভাবীর কাছে শেখ রেহানা বলেছিল, পানি কাটলে কি কোনো দিন ভাগ হয় বা ভাগ করা যায়? কথাটা মোটেই মিথ্যা নয়।

কেন যেন বারবার মনে হয় যত বিক্ষুব্ধ হোন না কেন, আমার আগে যেন তিনি না যান। তাই গতকাল দীপ, কুঁড়ি, কুশিসহ আমরা স্বামী-স্ত্রী তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। বড় ভাইয়ের পরিবেশ আর আমার পরিবেশ এক নয়। নিচে অফিস রুমে বসেছিলেন তিনি। আমরা যেতেই সবাই চলে যায়।

কোথা থেকে আমার ভাতিজা বাপ্পী এসে হাজির। কাউকে কোনো রাখঢাক করে না, অবলীলায় কথা বলে চলে। তবে ভালো কথাই বলে বেশি। যদিও ছোট কথাও সেখানে থাকে। কিন্তু সে যে কোনো আসর মাতিয়ে রাখতে বাবার মতোই উস্তাদ।

গতকালের আসরও অনিক সিদ্দিকী বাপ্পী মাতিয়ে রেখেছিল। রাত সাড়ে ৮টায় যাওয়ার কথা ছিল, সেভাবেই গিয়েছিলাম। না খেয়ে আসতে দেবেন না_ এটা বুঝতে পারিনি। তাই লেখা ও অন্য যেসব কাজ ছিল তা সারা হয়নি। খাবার খেয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিলাম।

যাওয়ার পথে ভেবেছিলাম ক'দিন আগে ঠাকুরগাঁওয়ে গড়েয়ার গোপালপুরে সম্প্রতি দাঙ্গায় নিহত হানিফের স্ত্রী-পুত্রকে সাহায্য করতে তার সহায়তা চাইব। দাঙ্গাপীড়িত এলাকা পরিদর্শনের সময় বলেছিলাম, আমরা হানিফের স্ত্রী-সন্তানকে এক লাখ টাকা সহায়তা করব। ঢাকায় ফিরে বিত্তবানদের কাছে হাত পেতেছিলাম। বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখেছিলাম, তাতেই সমস্যার উদ্ভব। টাকা দিতে চেয়েছিলাম এক লাখ।

সংগ্রহ হয়ে গেছে দুই লাখের বেশি। সেদিন আবার এক বছর কয়েক মাস পর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নুর আলীর সঙ্গে দেখা। ধনী মানুষ বহু দেখি, তাদের রংও দেখি, দেমাকও দেখি। কিন্তু নুর আলীকে কেন যেন সব সময় অন্যরকম মনে হয়। যতবার দেখা হয়েছে সব সময় ভীষণ ভদ্র আচরণ করেছেন।

'আমাদের সময়' নিয়ে যখন জনাব নাঈমুল ইসলামের সঙ্গে বিরোধ তখনও কয়েকবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। পত্রিকাটি নিয়ে ভালোভাবে বসার পর হঠাৎ একদিন তার অফিসে গিয়েছিলাম। কথার একফাঁকে সম্পাদককে ফোন করলেন। জনাব আবু হাসান শাহরিয়ার কবি মানুষ, খুব ভালো লোক। নির্বাসনে থাকতে কলকাতায় তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

পত্রিকা নিয়ে নানা ধরনের কথা বললেন। সম্পাদকের সঙ্গে নুর আলীর সেদিনের কথাবার্তা আমাকে উৎসাহিত করেছিল। ব্যবসায়ী মানুষ পত্রিকা নিয়ে অত ভাবনা আমায় মুগ্ধ করেছিল। সেদিনও বেশ ভালো লেগেছে। কথাবার্তার এক ফাঁকে জনাব এ. এম. শারাফত আলীর অনুবাদ 'শের শায়েরী' বইখানা তার টেবিলে দেখে হাতে নিয়ে কয়েক পাতা উল্টাতেই দারুণ আকৃষ্ট হই।

দিলি্লতে কত শায়েরের শের শুনেছি কিন্তু এমন সংকলিত ছোট ছোট শের খুব একটা দেখিনি। হঠাৎ করে হাতের কাছে বইটি পেয়ে প্রিয় সহকর্মী ফরিদ আহমেদকে ডেকেছিলাম বইটি কোথাও থেকে কিনে আনতে। দেখলাম এখানে নয়, বইটি ছেপেছে মলি্লক ব্রাদার্স, ৫৫ কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা। নুর আলী সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বইটি আমাকে একজন দিয়েছে। এটি আপনার দরকার? তাহলে নিন।

বলেই এগিয়ে দিলেন। বললাম, তাহলে লিখে দিন। তিনি লিখে দিলেন কিন্তু স্বাক্ষর করতে ভুলে গিয়েছিলেন। আবার স্বাক্ষর করে দিলেন। নুর আলীর বইটি দেওয়া কোটি টাকার অর্থ অনুদানের চেয়েও অনেক বেশি হয়েছে।

কথার ফাঁকে হঠাৎ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আলাউদ্দিন নাসিম এসে হাজির। শুরুর দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করেছে। ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে ওদের যেমন দক্ষতা ছিল, যোগ্যতা ছিল, তেমনি মানুষ হিসেবেও ভালো ছিল। মনে হয় এখন ব্যবসা করে। কি করে কথাটা উঠেছিল খেয়াল নেই।

তবে ঠাকুরগাঁওয়ের দাঙ্গা-হাঙ্গামায় নিহত হানিফের বিধবা স্ত্রী এবং বছরখানিক বয়সের ছেলেকে লাখ টাকা সাহায্যের কথা উঠতেই সে মানিব্যাগ খুলে সব টাকা দিয়ে দেয়। ৫০০ টাকার নোট গুনে দেখা যায় ১৯ হাজার। আলাউদ্দিন নাসিম জানে কিনা আমার দাদার নাম আলাউদ্দিন সিদ্দিকী। নিজে অথবা কোনো প্রতিনিধি পাঠিয়ে হানিফের বিধবা স্ত্রী ও সন্তানকে অনুদানের টাকা পাঠাব। টাকাটা লাখের বেশি হওয়ায় আরও দুই-এক লাখ যোগ করা যায় কিনা সেই চিন্তায়ই বড় ভাইকে বলতে চেয়েছিলাম।

বয়সে বড়, তাই হিসাব-কিতাব করে কথা বলতে হয়। বলা হয়নি। হয়তো ফোনে কখনো বলব। এই হানিফের ইতিহাসটাও বড় করুণ। শুনে এসেছি, হানিফের জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার মা মারা গিয়েছিল, বাবাও বেঁচেছিল কয়েক দিন।

সে নিজেও তার সন্তান ছোট রেখে মারা গেল। তাই মনে হয়েছে তার জন্য কিছু একটা করা দরকার। ভালো কিছু করতে পারলে নিজের কাছেই ভালো লাগবে।

হঠাৎই কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের মৃত্যু সংবাদে অাঁতকে উঠেছিলাম। নামকরা কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকদের সমসাময়িক।

নির্বাসনে থাকতে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে কবিতা লিখে দিতেন বলে শুনতাম। প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ওপর প্রভাব ছিল বলে সে সময় অনেক নিন্দিতও হয়েছেন। '৯০-এ দেশে ফেরার পর তার সঙ্গে যখন যেখানে দেখা হয়েছে ভীষণ গুরুত্ব দিতেন, সম্মান করতেন। কবি কবির মতোই হয়। কবির তো আমাদের মতো হওয়ার কথা নয়।

আমার বন্ধু কবি সায্যাদ কাদির একসময় বিচিত্রায় কাজ করত। আর সেই বিচিত্রা চালাতেন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। আবার সেই নুর আলীর গুলশান-২ এ ওয়েস্টিন হোটেলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শুভ জন্মদিন। ২০১২ সালের জন্মদিনে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর প্রিয় কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের পাশে বসেছিলাম, 'আমার কবিতা ফজল শাহাবুদ্দীন' চমৎকার কবিতা সংকলনটি তার হাতে ছিল। মনে হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন।

আমি বইটি নিয়ে যখন নাড়াচাড়া করছিলাম, তখন চট করেই বলে বসলেন, এটা আপনাকে দেওয়াই ভালো হবে। খচখচ করে লিখে দিলেন, 'প্রিয় কাদের সিদ্দিকী সমীপে সামান্য উপহার শ্রদ্ধাসহ_ ফজল শাহাবুদ্দীন'। আজ বইটি হাতে নিয়ে তার কথা বড় বেশি করে মনে পড়ছে, 'রহিয়া রহিয়া/কত কথা মনে পড়ে! আজ তুমি নাই,/মোরা তব পায়ে-চলা পথে শুধু তাই/এসেছি খুঁজিতে সেই তপ্ত পদ-রেখা,/এইখানে আছে তব ইতিহাস লেখা। /জানি না ক' আজ তুমি কোন্ লোকে রহি'/শুনিছ আমার কথা হে কবি বিরহী!' কেউ থাকে না। সবাই চলে যায়।

আল্লাহ তার সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে তাকে বেহেশতবাসী করুন।

কেন যেন আমরা ধীরে ধীরে কেমন হয়ে যাচ্ছি। সুকমল সব বৃত্তিগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পর্দায় যা শোভন তাকে বেপর্দা করে অঘটন ঘটানোর কোনো কিছুই বাদ রাখছি না। এই সেদিন জনাব আ. স. ম. ফিরোজ চিফ হুইপ হিসেবে উপহার সামগ্রী নেওয়ার সময় বলেছেন, এসব উপহার না দিয়ে নগদে ক্যাশ টাকা দিন।

রাজনীতির মানমর্যাদা আর রইল কোথায়? পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে ঘটনাটি প্রকাশ হওয়ায় তিনি প্রচার মাধ্যমকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, মশকারি করে তিনি কথাটি বলেছিলেন। তার তামাশার কথা ওভাবে ছেপে পত্রিকা অন্যায় করেছে। চিফ হুইপের পদে বসে তামাশা করতে অন্যায় হয় না, তার তামাশার কথা খবরের কাগজে ছাপলে অন্যায় হয়_ কি মারাত্দক ব্যাপার! স্বাধীনতার পর প্রথম চিফ হুইপ ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। আর সর্বশেষ চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ।

মাঝে বিএনপির চিফ হুইপ ছিলেন খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। এরা কেউ অত নিচে নামেননি। দেশে ন্যায়-সত্যের কোনো বালাই নেই। তাই এসব বাজে কথার প্রতিকার হয় না। তা না হলে আ. স. ম. ফিরোজের মুখ থেকে নিম্নমানের ওই কথা যখন বেরিয়েছে তখনই তার পদ খোয়ানোর কথা।

মনে হয় তিনি তা খোয়াবেন না। 'উপহার নয়, নগদ ক্যাশ টাকা দিন' চিফ হুইপের এ ধরনের চাহিদা গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছে। এটাকে সাধারণভাবে নিলে নিঃসন্দেহে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হবে। দেখা যাক, তিনি কি করেন। কিছুটা অপেক্ষায় অসুবিধা কি?

লেখক : রাজনীতিক।

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.