এক আকাশের নিচেই আমাদের বসবাস।
লাইফ উইদাউট লাভ - ৫
রান্নাঘর থেকে ফুফু ডাক দিলেন। আমি বারান্দায় বসে হায়ারম্যাথ করার চেষ্টা করছিলাম। সবে ক্লাস নাইনে উঠেছি এবার্। ক্লাসে এবার ফার্স্ট হতে পারলেও স্কুল ফার্স্ট হতে পারিনি।
তাই চেষ্টা করছি সামনের বার স্কুল ফার্স্ট হতে। এবার স্কুল ফার্স্ট হয়েছে অঞ্জন পাল। পাল বাড়ির ছেলেদের মাথা বরাবরই ভালো। স্কুলের হুজুর স্যার আব্দুল কুদ্দুস মাঝে মাঝে মজা করে ইসলাম শিক্ষা ক্লাসে বলেন, " হিন্দুদেরমাথা এত ভালো কেন বলতে পারিস ?" স্যারের চোখে মুখে কৌতুকের হাসির ছায়া । আমরাও মজা পাই।
স্যার নিজেই বলেন, " হিন্দুরা কাঁকড়ার ঘিলু খায় বলেই তাদের এত মাথা । তাই বলে তোরা সব কাঁকড়ার ঘিলু খাবি নাকি সব ? "
আমাদের কেউ কেউ মাথা দুলিয়ে না জানায়। স্যার আবার বলেন, " ইসলামে কাঁকড়া খাওয়া মাকরুহ। মাকরুহ দুই প্রকার্। মাকরুহ তাহরিমি এবং মাকরুহ তানঝিহি।
কাঁকড়া খাওয়া মাকরুহ তানঝিহি। "
গ্রামের মানুষ মাকরুহ শব্দটা শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। তারা বলে মোকরুব। আমি এটাও জানি চিংড়ি মাছ, কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়াও মোকরুব। কিন্তু এগুলো আমাদের বাড়িতে খুব খাওয়া হয়।
কিন্তু কাঁকড়ার নাম শোনা যায় না। আমার ক্লাসমেট অনুপ সাহা একদিন বলে ওর ফেভারিট খাবার হচ্ছে কাঁকড়া ভর্তা। এগুলো শুনলে আমার গা গুলিয়ে ওঠে। মুলত আমাকে ক্ষেপানোর জন্যই অনুপ এই কথা গুলো বেশী বেশী বলে। ওর কথা শুনে মনে হলো আমি নিজেই খাচ্ছি কাঁচা কাঁকড়া চিবিয়ে।
দুই দাঁতের মাঝে কচকচ করে শব্দ হচ্ছে। আমার গা কেমন করে উঠলো। আমি দৌঁড়ে কলপাড়ে চলে গেলাম। পাকস্থলীর খাবার সব গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো। পৃথিবীর সব থেকে কঠিন কাজের একটি হলো বমি করা।
হড়হড় করে বেশ খানিকটা বমি হয়ে যাওয়ার পর হালকা বোধ করলাম।
কলপাড়ে অনুপ এসে দাঁড়িয়েছে। " তুই মেয়েদের মত এত দুর্বল হার্টের মানুষ আগে জানতাম না। "
অনুপ কল চেপে দিলো। আমি হাত মুখ ধুয়ে নিলাম।
স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। আমার বাড়ি থেকে স্কুল আড়াই মাইল দুরে। প্রতিদিন হেঁটেই যাই আসি। কিছু মনে হয় না। আজ খুব কাহিল লাগছে।
এই পৃথিবীতে এসেছি খুব বেশিদিন না । তখন আমার বয়স তেরো। আমি অনেক কিছু পারি। আবার অনেক কিছুই পারি না। এই না পারা কাজের একটি সাইকেল চালানো।
আমি সাইকেল চালাতে পারি না। কিছু দুর যাওয়ার পর ধাম করে পড়ে যাই। সাইকেল বেল বাজানোর শব্দে সাইডে সরে গেলাম। জোরে ছুটে আসা সাইকেল আমার পাশে। এসে কড়া ব্রেক কষে থামলো।
অনুপের মুখে ফিচকা হাসি। উঠে পড় তোরে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসি।
লাইফ উইদাউট লাভ - ৬
আমি রান্নাঘরে মুখ বাড়ালাম। ফুফু এবং মা রান্নায় ব্যস্ত। কাজেরমেয়েটা পাটায় মসলা পিষে চলেছে একমনে।
মা চুলার উপর কড়াই থেকে চামচে একটু ঝোল নিয়ে ফুঁ দিয়ে চেখে দেখতে দেখতে ফুফু কে বলছেন , বু তুমি এই দুপুর বেলা পায়েস রানতে বইছো। ওরা পায়েস খাবে কখন আর ভাত ই বা খাবে কখন ! বেলা তো গড়িয়ে গেছে।
- ভাত খাবার পরে খাবে। বড় খোকা খাজুরের রসের খির খাতি কত পছন্দ করে। ঢাহার শহরে কি আর খাঁজুরের টাটকা রস পাওয়া যায়।
ব্যান বেলা আমি পায়েস রাইন্দে রাখতি চাইলাম। তা গফুর গাছি আইজকে রস পাড়তি আসতি দেরিং করবে তা কিডা জানতো।
আমার দিকে তাকায়া বললো , দুপুর বেলা এত পড়াশোনা কের জন্যি। অত পড়লি মাথা খারাপ হুয়ে যাবেনে। যায়ে দেখদিন টিকটিকিটার ঘুম ভাঙ্গিছে নেই।
আর কত ঘুমুবে। সারা রাইত তো লঞ্চে ঘুমুতে ঘুমুতে আইছে। সাথে কুটুম নিয়ে আইছে। পইর ঘাটে নিয়ে গিয়ে ঘা ধুয়ায়ে আন।
আম্মা বললেন, আমার ঘরে টেবিলের উপর নতুন সাবান আর গামছা আছে।
নিয়ে যা।
আমি ভাইয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছি এই সময় ফুফু ডেকে বসিয়ে এক প্লেট রসের পায়েস খেতে দিলেন। আমাদের ফুফু, আব্বার থেকে কয়েক বছরের ছোট। অধিকাংশ সময় গম্ভীর হয়ে থাকেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকেন দিনের পর দিন।
কারো সাথে কথা বলেন না। খাওয়া দাওয়া করেন না। এগুলো এখন আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। গ্রামের লোক বলে ফুফুরমাথায় ছিট আছে। আবার একেক দিন ফুফুর মন খুব ভালো থাকে।
আমাদের সাথে দুনিয়ার গল্প জুড়ে বসেন। ফুফুর দুনিয়া অবশ্য অনেক ছোট। পশ্চিমে বাইনবাড়ির মাঠ.উত্তরে হিন্দু পাড়া , দক্ষিনে বড় গাঙের পাড় দিয়ে এঁকে বেঁকে চলা ওয়াপদা রোড আর পূর্বে শালিক খালির খাল। শালিক খালি এখন শীর্ণকায় এক খাল। দাদীজানের কাছে শুনেছি এই খাল এক সময় নদী ছিলো।
মূল গাঙের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলো। একেক সময় খালে কুমির কামট চলে আসত। শালিক খালীর পাড়ে ঘাস খেতে যাওয়া গরু বাছুর টেনে নিয়ে যেত। একবার দাদীর রাঙা গাইয়ের বাছুরটা কুমিরে টেনে নিয়ে যায়।
ফুফুর বিয়ে হয়েছিলো আমার জন্মেরও আগে।
ফুফু তখন এক দুরন্ত কিশোরী। দস্যি মেয়ে বলে সারা গ্রামে অখ্যাতি ছিলো। তরতর করে গাছে উঠে সে ছেলেদেরকে হার মানিয়ে দিত। এই নিয়ে দাদি তাকে সারাক্ষণ বকাঝকা করতেন। এমন কোন সন্ধ্যা পার হত না যেদিন সে দাদির হাতে চুলটানা কি লাঠির বাড়ি খেত না।
রাতে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ফেলতেন। আবার সকালে উঠে সব ভুলে যেতেন।
ফুফুর বিয়ে হয় তিনগ্রাম দুরে মাওলানা বাড়ি। ফুফাও মাওলানা ছিলেন। কিন্তু কোন কারণে তাদের দুজনার মধ্যে বনিবনা হত না।
ফুফু কিছুতেই শ্বশুর বাড়ি যেতে চাইতো না। অনেক জোরাজুরি করে মারধর করেও পাঠানো যেত না। তাবিজ কবজ পানিপড়া কিছুই বাদ গেলো না। কাজের কাজ কিছু হলো না। শ্বশুর বাড়িতে তাকে অনাদর করা হত বলে শুনিনি।
একবার জোর করে তাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠানো হলো। সেই রাতেই ফুফু ফসলে দেয়ার " এন্ডিন " খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। খবর পেয়ে আব্বারা কয় ভাই ছুটে যায় ফুফুর বাড়ি। হাসপাতাল আছে সেই থানা সদরে। নৌকায় করে নিতে হবে।
নৌকা এক খান নিয়ে সবাই মিলে অমানুষিক ভাবে বৈঠা বাইতে শুরু করলো। হাতের তালুতে পানি ঠোলা উঠে গেলো। নৌকার গলুইতে বসে ফুফা চোখের পানি ফেলতে লাগলেন নিরবে। তিনিও জানেন না বউ ঘর করতে চায় না কেন।
এদিকে বাড়িতে দাদিজানকে ধরে রাখা যায় না।
এক মাত্র মেয়ে। তিনি উঠানে ডাঙ্গায় তোলা মাছের মত তড়পাতে লাগলেন। কেউ তাকে শান্ত করতে পারছে না। ফুফুকে দিন তিনেক বাদে ফিরিয়ে আনা হলো বাড়িতে। এবার কিন্তু কেউ তার চুল ধরে টানলো না।
লাঠির বাড়িতে দাগ বসালো না পিঠের চামড়ায়। দাদি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকতেন সারাদিন। ফুফুও শিশুর মত মাকে আঁকড়ে ধরে বসে রইলো। ফুফুর মুখে চঞ্চল হাসি মুছে গেলো। আষাড়ের মেঘলা দিনের মত গম্ভীর হয়ে গেলেন।
একটু একটু করে তার মাথায় সমস্যা দেখা দিতে লাগলো। অনেক কষ্টে তাকে ঘর থেকে বাইরে আনা গেলেও বাড়ির সীমানার বাইরে নেয়া যেত না। ফুফুর এক সখি ছিলো। তার নাম সুখি বিবি। সুখি এসে ফুফুকে খবর দিত কোন বনে বইচি পেঁকেছে, কাদের জাম্বুরা গাছ থেকে জাম্বুরা চুরি করা যায় এইসব।
দাদিই এসব সুখিকে দিয়ে বলাতো। ফুফু শুনে উদাস চোখ মেলে তাকাতো বাড়ির উঠানে।
লাইফ উইদাউট লাভ - ৭
ভাইয়ার ঘরে উকি দিলাম। ভাইয়া পড়াশুনা করতে বাইরে যাওয়ার পর থেকে রুমটা তালাবদ্ধ থাকে। মেহমান এলে তাদেরকে এই রুমে থাকতে দেয়া হয়।
গত কাল মা মর্জিনাকে সাথে নিয়ে ঘর খানাকে সাফ সুতরো করে রেখেছে। ফুফু তখন গম্ভীর হয়েই ছিলো। রাতে অবশ্য মা কে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, কে আসবে বড় ভাবী? ভাইয়া আসার খবর শুনে তার মন ভালো হলো। সেই থেকে খেঁজুরের রসের পায়েস রাঁধার প্লান করছে। পারলে তো তখনি পায়েস রাঁধতে পারে।
মিয়া ভাইকে ফুফু অনেক ভালোবাসে। নি:সন্তান এই রমনী তার অপত্য স্নেহের ক্ষুধা মেটায় মিয়া ভাইয়ের উপর । আর কেউ খেলো না খেলো সেদিকে সে। ভ্রুক্ষেপও করে না। কিন্তুমিয়া ভাইয়ের দিকে সর্বক্ষণ নজর থাকে।
সকালে ভাইয়াকে আনার সময় তার বন্ধুটি বেশী কথা বলে নাই। গলায় ঠান্ডা বসে গেছে। ঘড়ঘড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলো কেমন আছো। আমার হাত ধরে হ্যান্ডশেক করলো। গ্রামদেশে খুব একটা হ্যান্ডশেক করা হয় না।
আমার একটু সংকোচ লাগছিলো। সারাপথ ধরে মিয়া ভাই কথা গেলো। পুরো গ্রামের খবর তার জানা চাই। ভাইয়ার বন্ধুটি মাঝে মাঝে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলো। মাফলার দিয়ে পুরো মুখ এমনভাবে বেঁধে রেখেছে যে শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে।
আচ্ছা তার চোখ কি কাজল টানা দেখতে নাকি শহরের আল্ট্রা মডার্ন ছেলেরা জেনানাদের মত চোখে কাজল মাখে !
বাসায় এসে ভাইয়া গরম পানি করে দিতে বললেন। রহিম গরম পানি নিয়ে গেলে, ভাইয়া তার বন্ধুটিকে বললো , " নে দীপ্ত , গরম পানি দিয়ে গার্গল করে ফেল। আরাম লাগবে। " ভাইয়ার বন্ধুটির নাম তাহলে দীপ্ত । হিন্দু নাকি ! দ্বীপ নাম তো হিন্দুদের হয়।
আমার এক ক্লাস আগে পড়ে দ্বীপ শংকর মুখোপাদ্ধ্যায় । আমার মাথায় তখন ঘুরছে নতুন একটা শব্দ শেখার আনন্দ। গার্গল মানে যে গড়গড় করে কুলি করা এটা জানতাম না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।