(১)
যারা নিজেদের জীবনে ভা্লোবাসা বয়ে নিয়ে চলেন, ভালোবাসার শক্তিতে পথ চলেন, তারা সবাইই একজন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন । কিন্তু, যে সমাজজীবনে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনরা বেশিরভাগ সময়ই নিগৃহীত বা পরাজিত হন, সেই সমাজে ভালোবাসা দিবসের জন্য একটি লেখা লিখতে গেলে কেন যেন জীবনানন্দ দাসের সেই বিখ্যাত কবিতাটাই মনে পড়ে যায়ঃ
“ অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুনার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়। “
এই কবিতার পংতিগুলো আজ অত্যন্ত রূড় বাস্তব। যাদের হৃদয়ে প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুনা নেই, মোটকথা ভালোবাসা নেই, তারাই যেন আজ সমাজ ও রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
তাদের হাতেই যেন দিনের আলো, রাতের তারা – সবই যেন তাদের জন্য। পক্ষান্তরে, যাদের ভা্লোবাসা আছে মানুষের প্রতি, ভালবাসার শক্তিতে যারা বিশ্বাস করেন, তাদের জীবনে যেন ভর করছে দিনের ক্লান্তি আর রাতের আঁধার ।
(২)
প্রেমিক-প্রেমিকাদের পদভারে ভালবাসা দিবসে প্রকম্পিত হয়ে উঠে পার্ক, রেস্টুরেন্ট আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো। কিন্তু ভালোবাসা আজ যেন অত্যন্ত ছোট্ট একটি শব্দে পরিণত হয়েছে, হারিয়েছে এর বিশালত্ব। ভালবাসা যেন আজ তাই মানুষকে আরও ছোট করে দেয়, তাদের মনকে বানিয়ে দেয় সঙ্কীর্ণ ।
যার কারণে কোন রিলেশনে জড়ানোর আগে প্রেমিক পুরুষ দিন-দুনিয়া নিয়ে ভাবলেও, অ্যাফেয়ারে জড়ানোর পর তার মানসপটে থাকে শুধু রিলেশন নিয়ে চিন্তা বা দুশচিন্তা। হয়ে পরে তারা আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর । ভা্লোবাসাকে তাই আজকাল সচরাচর দুইজনের মধেই যেন সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়।
মানুষ যেন আজ ভূলতে বসেছে যে, যে দেশ ও সমাজে তারা বেড়ে উঠেছে, সেই দেশ, সমাজ ও দেশের মানুষও তাদের কাছ থেকে ভালোবাসা প্রত্যাশা করে। যে দেশ, সমাজ আর দেশের মানুষের কাছে তারা ঋণী, সেই সমষ্টিকে ভা্লোবেসে তার জন্য কাজ করার মনোভাব লাভার বয় আর লাভার গার্লদের মধ্য হতে যেন তিরোহিত হতে চলেছে।
নাজিম হিকমেতের মত ভালোবাসার শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে তারা কখনই ‘রোমান্টিক রেভুলুশনিস্ট’ হতে পারে না। এটাই যেন চরম বাস্তব আর ভবিতব্য।
বিংশ শতাব্দীতে যে কয়জন খ্যাতিমান মানুষ ভালোবাসার মহান শক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, তাদের মধ্যে তুর্কী কবি নাজিম হিকমেত অন্যতম। তার জেলখানার চিঠি’ কবিতার নিচের ছত্রগুলো পরলেই বোঝা যায় ভালোবাসার মহান শক্তি তাকে কিভাবে অনুপ্রাণিত করতঃ
আমি আছি মানুষের মাঝখানে,ভালবাসি আমি মানুষকে
ভালবাসি আন্দোলন,
ভালবাসি চিন্তা করতে,
আমার সংগ্রামকে আমি ভালবাসি
আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে মানুষের আসনে তুমি আসীন
প্রিয়তমা আমার আমি তোমাকে ভালবাসি। ।
অনেকেই আছেন যারা এই কবির ‘জেলখানার চিঠি’ পরে কবির প্রশংসায় মেতে উঠেন। কিন্তু, সেইসব তরুণদের মধ্যেও কবির শ্রম ও বিপ্লবের যুগপৎ আদর্শ বেশিরভাগ সময়ই যেন অনুপস্থিত থাকে। কবির চেতনা, কবিতার মধ্যেই তাই সীমাবদ্ধ থাকে; প্রেমিক পুরুষরা যেন ভা্লোবাসার চেয়ে ঘৃণাকেই বেছে নিতে বেশি আগ্রহি হয়ে পড়ে।
পক্ষান্তরে, যাদের হৃদয়ে সত্তিকারের ভালোবাসার আবেগ রয়েছে, যারা ভালবাসার শক্তিতে বিশ্বাস করেন, যারা অটুট আদর্শ নিয়ে পথ চলেন, তারা যেন অনেকটাই সংখ্যালঘু। তারা জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাদের স্বপ্নগুলো পুরণ করতে পারছেন না।
তাদের ‘ফুসফুস যেন আজ পোকার দখলে...’
(৩)
ব্যক্তিগত পরিধি থেকে জাতীয় পটভূমিতেও ভা্লোবাসা পরাজিত; জয়ী ঘৃণা। বাংলাদেশ যেন এক কুরুক্ষেত্র, যেখানে কেউ যেন কাউকে সহ্য করতে পারছে না। রাজনীতির মঞ্চ হয়ে উঠেছে ‘পলিটিক্স অব টারমিনেশন’ এর উৎকৃষ্ট জায়গা, দেশ হয়ে উঠেছে বধ্যভূমি। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি যেন ধরেই নিয়েছে ক্ষমতায় না থাকতে পারলে বা ক্ষমতা হারালে তাদের অস্তিত্ব থাকবেনা। ২১শে আগস্টের বোমা হামলা ও তদপরবরতি ঘটনাবলী হয়তো আওয়ামী লীগকে এই উগ্র মতাদর্শের দিকে ধাবিত করেছে যে, যেভাবেই হোক ক্ষমতায় থাকতে হবে।
ক্ষমতা ছাড়লে বিএনপি আর জামাতের হাতে তাদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই ভয়ে তারা জনমতকে পায়ে দলে হাস্যকর ও একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার বন্দবস্ত করে নিলো।
আওয়ামী লীগের এই আশংকাকে উরিয়ে দেয়া যায়না। তার মূল কারণ যুদ্ধপরাধীদের বিচারের মত একটা ভালো কাজ করছে, যা অধিকাংশ অভিযুক্তই জামাতের। এই কারণে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় গেলে চরম প্রতিশোধের আশংকা উরিয়ে দেয়া যায় না।
তাদের নেতাদের যে ৭১-এ ভূমিকার জন্য শাস্তি প্রাপ্য সেটা কে জামাতকে বোঝাবে? এদিকে কিন্তু, আওয়ামী লীগও ভুলে গেছে ‘একটি খারাপ কাজ করে আরেকটি খারাপ কাজ বন্ধ করা যায় না’। তাই, তারাও চরম দমন-নিপিড়নের পথ বেছে নিয়েছে।
দেশ আর দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা নেই বলেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আজ এসব অবাঞ্চিত পথ বেছে নিয়েছে।
এই দমন নিপীড়নের আর ঘৃণার রাজনিতি থেকে দেশবাসীর কি আদৌ মুক্তি মিলবে?
(৪)
শিল্প, সাহিত্য, লেখালেখি মানুষকে উদার হতে শেখায় বলেই সবাই মনে করে। কিন্তু, সৃস্টিশীলতাই মানুষকে যে মানুষ হতে অনুপ্রাণিত করেনা, তা বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, নাটক, সংগীত নিয়ে যারা আছেন, তাদের জীবন দেখলেই তা অনেকটা বঝা যায়।
শিল্প, সাহিত্য, নাটক আর সংগীতের মূল উপাদান আর অনুপান হল মানুষ। কাজেই ধারনা করা যায় যে, যারা এই সকল কাজের সাথে জড়িত, তারা অনেক বন্ধুসুলভ আর মানবিক। কিন্তু, বাস্তবতা হল, এই মানুষেরা হন সাধারণত আত্মকেন্দ্রিক, কিছুটা অসামাজিক আর মানুষকে মুল্যায়ন করার দিক দিয়ে এরা থাকেন সবসময়ই পিছিয়ে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি, যারা কিনা কালচারাল কাজকর্ম নিয়ে থাকেন, তারা মানুষের সাথে মানুষের সুসম্পর্ক ও আন্তরিকতাকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দেন। একজন এমবিএ পাস করা কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ রাস্তায় তার পুরনো সহকর্মী বা সহপাঠিকে দেখলে যে সৌজন্যতা দেখান, একজন থিয়েটার কর্মী তার পুরনো সহকর্মীকে দেখলে তা দেখান কিনা সন্দেহ।
এখানেও সেই ভা্লোবাসার অনুপস্থিতি, যার কারণে একজন নাট্যকর্মী অত্যন্ত আবেগ নিয়ে একটা মানবীয় সংলাপ উচ্চারণ হয়তো করেন, কিন্তু তার বাস্তব জীবনে সেই মানবতার আহবান আর ভালোবাসার অনুপ্রেরনা কাজে লাগানোর প্রয়জনীয়তা বা অনিবার্যতা তিনি হয়তো কখনই উপলব্ধি করেন না।
এই প্রবণতাই কিন্তু ‘আর্ট ফর আর্টসেক’ নামে পরিচিত। কিছু একটা করার জন্যই হয়তো করা – সংগীত, নাটক, কবিতা আবৃত্তি, শিল্প বা সাহিত্য—এসবকিছুই। নবারুণ ভট্টাচারযের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ কবিতাটি অনেকেই ভালোবাসেন এবং আবৃত্তি করেন আত্যন্ত দরদ ভরে। কিন্তু, সেই কবিতাটির ছত্র ‘মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু নয়’-তে যে ভা্লোবাসার আহবান, তা তাদের জীবনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা ছড়িয়ে দিতে পারে না।
ভালবেসে এই পৃথিবী, এই পৃথিবীর মানুষ, এসবকে কাছে টানার আগ্রহ তাদের মধ্যে দেখা যায় না, বললেই চলে।
যারা তাদের গল্প, কবিতা, উপন্যাসে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার কথা বলেন, তারাও ভালোবাসার শক্তিকে যে একটা জীবনাদর্শ হিসেবে নেয়া যায়, সেই কথা পরবর্তী প্রজন্মকে মনে হয়না ঠিকমত বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন। এদেশের শিক্ষিত কিশোর-তরুণদের অনেকেই মুহাম্মাদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন কাহিনীর ভক্ত। তিনি তার সায়েন্স ফিকশনগুলো এমনভাবে লেখেন, যেখানে মানবিকতা আর মানুষের প্রতি মানুষের ভা্লোবাসার ছোঁয়া যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। ‘নায়িরা’, ‘রুহান রুহান’, ‘যারা বায়োবট’ ইত্যাদি সায়েন্স ফিকশন গ্রন্থে মুহাম্মাদ জাফর ইকবাল দেখিয়েছিলেন ভালোবাসার শক্তি।
তিনি দেখিয়েছিলেন মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার মাধ্যমে এই পৃথিবীটাকে আরও সুন্দর করে তোলা সম্ভব। ‘ভা্লোবাসা’ আর ‘ক্ষমার মহত্ত্ব’ এই বইগুলোতে অসাধারণভাবে ফুতে উঠেছিল। কিন্তু, বাস্তব জীবনে তিনি খুব বেশি জায়গায় এই দুটো মহৎ গুনাবলির শক্তির ব্যাপারে তেমন একটা কথাও বলেন নাই। এর কারণে তার বইয়ের পাঠকরাও লেখক কি বলতে চেয়েছে, সেই বিষয়টা খুব গুরুত্ব সহকারে উপলব্ধি করার চেস্টা করেনি।
এটাও কি অনেকটা ‘আর্ট ফর আর্ট সেক-এর ভিতর পড়ে? শিল্প- সাহিত্যের সাথে কি জীবনের কোন সংযোগ নেই?
(৫)
বিরোধী মতকে আমরা যেন দলন করতেই বেশি পারদর্শী হয়ে পরেছি।
দ্বিমত পোষণকারী যেন আমাদের শত্রু। তাকে চূড়ান্ত অপমান আর গালিগালাজ করাতাই এখন যেন অনেক বড় একটা ক্রেডিট।
সরকারের বিরুদ্ধে অনেক সমালচনায় সরকার যেমন ভিত হয়ে নতুনভাবে ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইন, বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন সময় সংশোধন আর পরিবর্তন করছে, তেমনি ব্যক্তিগত পর্যায়েও সমালোচনা তথা দ্বিমতের ভয়ে ভিত হয়ে অনেক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উগ্র প্রতিক্রিয়াশীলতার আশ্রয় নিচ্ছে।
উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, বিভিন্ন বাংলা ব্লগে কিছু মানুষ আছেন, যারা কিনা তাদের মতামত আর চিন্তাধারণার বিরুধ্যে কেউ যদি দ্বিমত পোষণ করে, তবে তার প্রতি আশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ থেকে শুরু করে তার লেখাটিকেই বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিয়ে থাকে। অথচ, এরাই কিনা মুক্ত চিন্তার কথা বলে, এরাই কিনা ‘ব্লগিং আমাদের অধিকার’ বলে সোচ্চার হয়।
আসলে ভিন্নমতের মানুষের প্রতি এদের কোন শ্রদ্ধা নেই। যেখানে শ্রদ্ধা নেই, সেখানে ভালবাসাও থাকতে পারেনা। এই কারণেই তাদের এই ভণ্ডামি। আর সবকিছুর মূলে রয়েছে মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসাহীনতার সংস্কৃতি।
যার কারণে তারা বিরুদ্ধ মত বা দ্বিমতকে বাজে পরিচিতি বা কলঙ্ক দিয়ে নির্মূলের চেস্টায় সিদ্ধহস্ত।
(৬)
আমরা এমন একটি প্রজন্ম সৃষ্টি করেছি, যারা নানান ভাগে বিভক্ত; এখানে আস্তিক আছে, নাস্তিক আছে, জামাত-শিবির-হেফাজাত আছে, গনজাগরণ মঞ্চের তরুণরা আছে। আছে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনের তরুনেরা। সবাই যেন নিজেদের জগত নিয়ে ব্যস্ত। নিজেদের চিন্তা-ধারণা নিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে, এটা ভাল কথা। অন্যরা হয়তো তাদের মতাদরশী হবেনা, এটাই স্বাভাবিক।
এখন কেউ যদি মনে করে তাদের চিন্তা-চেতনা আর ধ্যান-ধারণা অন্যের চেয়ে শ্রেয়তর, তাহলে তারা চেস্টা করতে পারে যুক্তি আর আমন্ত্রনের মাধ্যমে বিরুদ্ধ মতের মানুষকে তাদের দলে আনার চেস্টা করতে। কিন্তু, তার বদলে দেখা যায় ‘কেউ যেন কাউকে সহ্য করতে পারেনা’ ধরনের পরিস্থিতি। আস্তিকদের মধ্যে কোন চেষ্টা দেখা যায় না দাওয়াত আর ভ্রাতৃত্বের আহবানের মধ্য দিয়ে উগ্র নাস্তিকদের তাদের রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনার; অপরদিকে নাস্তিকদের বা যুক্তিবাদী তরুনদেরকেও দেখা যায় না উগ্র মৌলবাদীদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনার কোন চেস্টা করতে। তাইতো, ব্লগার রাজিব অকালেই প্রান হারান; অপরপক্ষে, ধরমনিরপেক্ষ ও নাস্তিক তরুণরা ফেসবুক আর ব্লগে সমানে অশ্লিল গালিগালাজ চালিয়ে যায় আস্তিক, সংস্কারাচ্ছন্ন আর মৌলবাদী তরুন সম্প্রদায়কে।
যেন ঘৃণার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।
ঘৃণাই যেন মোক্ষ ।
ভালোবাসার চরম অনুপস্থিতিই এই উগ্রতা আর তীব্র প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রধান কারন।
আর এই ঘৃণা আর প্রতিক্রিয়াশীলতার কারণে যারা মধ্যপন্থী বা উদার মানসিকতার, যারা কিনা এই উগ্র দু পক্ষের ভিতর পড়েন না, তারা পড়ে যান সমস্যায়। তাদেরকে হয় ‘নাস্তিক’, না হয় ‘ছাগু’ উপাধি পেতে হচ্ছে এসব উগ্রবাদির কাছ থেকে। পরাজয় হচ্ছে ‘শুভ মনমানসিকতার’।
(৭)
কোন আদর্শ বা উদ্দেশ্য যদি সফল করতে হয়, সেজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি বিপ্লব। শুধু পাগলের মত বিপক্ষ দল বা মতকে গালিগালাজ করে, তাদের ছায়া না মাড়িয়ে, পারলে তাদের নিষিদ্ধ, অবরুদ্ধ আর নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে কখনই কোন আদর্শ বা মহৎ উদ্দেশ্য সফল করা যায় না। কিন্তু, সরব অথবা নীরব- যাই হোক, একটি বিপ্লব কিভাবে সম্ভব?
এক্ষেত্রে চে গুয়েভারার সেই অমর উক্তি প্রণিধাণযোগ্য – “ Let me say, by the risk of seeming ridiculous that a true revolutionary is guided by a great feeling of love” অর্থাৎ “একজন সত্যিকারের বিপ্লবী ভালোবাসার মহান অনুভূতির শক্তিতে পথ চলেন”।
আর ঠিক এই বিষয়টিরই যেন অভাব রয়েছে আমাদের এই দেশে। এখানে, যততুকু মনে হয়, একজন বিপ্লবের প্রত্যাশী মানুষ বা জনগোষ্ঠী পথ চলেন ঘৃণা আর আবেগ দিয়ে, ক্রোধ আর উন্মত্ততা দিয়ে।
এসবই যেন তাদের মধ্যে বিপ্লবের মুলমন্ত্র বা জেহাদি জোশ এনে দেয়। এসব না থাকলে তারা লড়াই করার প্রেরনা পান না। বিপক্ষ বা বিরুদ্ধ মতের মানুষদের তারা যেন ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে চান। আর না হলেও নিদেনপক্ষে তাদের এমন মনোভাব রাখা চাই, যাতে সবাই বুঝতে পারে তারা একে অন্যকে মোটেই সহ্য করতে পারতেছেনা।
এই ধরণের মনোভাব সমাজের বেশিরভাগ গোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষদের মধ্যেই যেন বিদ্যমান।
কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী, কি উগ্র মউলবাদী, কি আধুনিক, কি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ, কি গ্রামের অশিক্ষিত মানুষ, কি সমাজতান্ত্রিক, কি সাম্রাজ্যবাদি, সবাই-ই যেন ধরে নিয়েছে, বিপক্ষ মত বা চিন্তা দলন করে তাদের নিশ্চিহ্নকরণই যেন নিজেদের মতবাদ বা চিন্তাকে তিকিয়ে রাখার একমাত্র উপায়।
এসব দেখে মনে হয় চে গুয়েভারা যদিও কিউবাতে বিপব এনেছিলেন, আর্জেন্টিনাতে এনেছিলেন, কিন্তু, আমাদের বাংলাদেশের মানুষ হলে তিনি হয়তো এই দেশে বিপ্লব আনতে পারতেন কি না, তা সন্দেহ আছে!
বাংলাদেশে বড় আকারের সামাজিক বা রাজনৈতিক কোন বিপ্লব আনতে গেলে সবার আগেই দরকার বিশাল একটা ইউনিটি বা ঐক্য। আর একে অপরকে (বিপক্ষ দল বা দিমত-পোষণকারী) নিশ্চিহ্ন করণের প্রচেস্টায় লিপ্ত থাকলে, সেটা কি আদৌ সম্ভব?
খুব বেশি নেতিবাচক মনভাবের অধিকারি হলে অথবা একচোখা হলে তা আদৌ সম্ভব হওয়ার কথাও নয়। যারা ব্যক্তি মোহাম্মদের দোষ-ত্রুটি নিয়ে ব্লগ ভরিয়ে ফেলেন, তারা এই কথা কমই বুঝতে চান যে তিনি যে শূন্য থেকে পুরো আরবের অধীশ্বর হয়েছিলেন একসময়, সেটা সম্ভব হয়েছিল তার ভালবাসা আর ক্ষমার মহান আদর্শের কারণেই। তায়েফ বাসীদের দারা নিগৃহীত হবার পর তিনি স্রষ্টার উদ্দেশে প্রার্থনার সময় অভিসম্পাত করার বদলে বলেছিলেন, “হে প্রভু, তুমি এদের জ্ঞান দাও; এদের ক্ষমা কর”।
এইজন্য ধর্মীয় বিষয় নিয়ে পরাযালচনার সময় নেতিবাচকতার চেয়ে ইতিবাচকতাই মনে হয় বেশি জরুরী।
তেমনি, যারা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে, তাদের চোখে একজন ফরহাদ মযহার ও একজন মুন্তাসীর মামুন বা আবদুল মান্নান, সবাই-ই দলকানা এবং আদর্শহীন। একটি বিরাট ঐক্য গড়তে হলে সেটার জন্য প্রয়োজন মিথ্যা আর দালালীকে বর্জন করে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলা। কাজটি যথেষ্ট কঠিন; কিন্তু সত্য ও ন্যায়ের প্রতি কারও ভালোবাসা, আর মিথ্যার প্রতি ঘৃণা থাকলে সেটা অসম্ভব নয় – ঘৃণা থাকলে অন্যায়, অসত্য আর নতজানু মানসিকতার প্রতিই থাকা উচিত।
(৮)
আধুনিককালে মাদার তেরেসা, মহাত্মা গান্ধী, মারটিন লুথার কিং, চে গুয়েভারা, জন লেনন, পিট সিগার সহ বিশ্বের আধুনিককালের যে সকল মানুষ নমচিত্তে সবার কাছে স্বরিত হোন, তাদের সবাই-ই মানুষের প্রতি মানুষের ভা্লোবাসার উপর জোর দিয়েছেন।
ভালোবাসার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান খুজেছেন। তাই তারা ছিলেন অহিংস আর অ-প্রতিক্রিয়াশীল। ঘৃণা আর উগ্রতার বদলে ভা্লোবাসা, হৃদ্যতা আর সম্প্রীতির ভিতর দিয়ে তারা একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে এসেছেন সবসময় এবং সেই অনুযায়ী কাজ করেছেন।
পাপকে আমরা ঘৃণা করব, পাপীকে নয়। ভালোবাসার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজ, দেশ ও জাতির মঙ্গল করার জন্য সেটাই হতে পারে আমাদের পাথেয়।
একটি বিরাট জাতীয় বা সামাজিক ঐক্য করতে পারে অসম্ভবকে সম্ভব। একতা এমন এক বিরাট শক্তি, যেটিকে ভাঙতে গেলে ‘বার্লিন ওয়াল’ই ভেঙ্গে পরে, একতা আরো শক্তিশালী হয়। ‘ভালবাসার মহান শক্তি’ই পারে একটি বিরাট ঐক্য গড়ে তুলতে। শান্তি আর মানবতার অর্কেস্ট্রাতে সুর তুলতে হলে ‘ভালবাসার অনুপ্রেরণা আর শক্তি’ই রাখতে পারে ‘কন্ডাক্টরের ভূমিকা’।
মহান মানুষ মাদার তেরেসার একটি বাণী এক্ষেত্রে স্বরণ করা যেতে পারে, “Works of Love are Works of Peace,” অর্থাৎ ভা্লোবাসার কাজই শান্তির জন্য কাজ।
আমাদের এই দেশেও তাই শান্তি আর মানবতা প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তাই ভালোবাসার মহান শক্তিকেই কাজে লাগানোর জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।