আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেদনার শহরে সাইকেলের ডানা

বেদনার শহরে থাকি বলে ঘুম ভেঙ্গে গেলে বেদনার উপর বেদনার নতুন একটা প্রলেপ পড়ে- আরেকটি দীর্ঘদিন কাটাতে হবে ভেবে। বেদনার শহর- কথাটি যখন বলে ফেলি তখন নিশ্চিতভাবেই এমন একটা ধারণার জন্ম হয় যে- তাহলে কোথাও বুঝি আনন্দের শহর বলে কোনো জায়গা লুকিয়ে আছে।
চট্রগ্রাম থেকে এসেছি একটানা ছয় বছর- মনে হতো কবে ফিরব বাড়ি একেবারেই? ছুটি শেষ হয়ে আসার মুহূর্তগুলো চলে এলে রীতিমতো কান্না পেত, আবার গিয়ে সেই মা-বাবা-পরিবারবিহীন জীবনে যাচ্ছি ভাবলেই ইচ্ছে করত সব ছেড়ে দিয়ে বাসায় বসে থাকি। অথচ ওখানে আমি খারাপ ছিলাম না।
হোস্টেল লাইফ- যে সে হোস্টেল নয়, একেবারে পাহাড় ঘেরা হোস্টেলে অসাধারণ কিছু বন্ধু-বান্ধদের সঙ্গে রাজার হালে কাটিয়ে আসা নিঃসন্দেহে আমার জীবনের সবচেয়ে অমূল্য স্মৃতির ভেতরেই থাকবে।

তারপরেও আমার মাঝে মাঝে কিছুই ভালো লাগত না- হয়ত ২৪ ঘন্টার ভেতরে ৮ ঘন্টা কাটাতাম এই ভেবে- এত কিছু করে কী হবে? কোনো লাভ নেই, ঐ বেদনা-বিষণ্ণতাতেই ডুবে থাকতাম, এখনো হয়ত থাকি। এর আগে কোথায় থাকতাম?- সাইকেল চালানো বয়সে? নীল রঙ এর সাইকেল- নাম ভুলে গেছি। আদৌ কোনো নাম ছিল কি’না তাই মনে নেই। নামে কি’বা আসে যায়? ঘুরে বেড়াতাম শহরময়। জিলা স্কুল, সার্কিট হাউজ, চরপাড়া, পার্ক-নদী, সিকে ঘোষ রোড- আমার শৈশব-কৈশোরের শহর, ময়মনসিংহ।

ছেড়ে এসেছি এসএসসি পরীক্ষার পরপর, রেজাল্ট দেয়ার আগেই। সকালের বাতাস, দুপুরের বাতাস, শীতের বাতাস, গরমের বাতাস, বসন্তের বাতাস, বর্ষা-বৃষ্টি—সবকিছু আলাদা আলাদা করে কেবল গন্ধ দিয়ে চিনতে পারতাম। অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াতাম ঐ নীল রঙ এর সাইকেল নিয়ে। বাসার সামনে ছিল বিশাল একটা পুকুর। মানুষ তাকে বলত, আকুয়া হাজিবাড়ি পুকুর পাড়।


পুকুর পাড়ের সঙ্গেই আমার নানুর বাসা। তিনতলা বিল্ডিং এর দোতলায়। আমি এলাকার ভাগ্নে ছিলাম। আমার মামা-মামার বন্ধু, সেই সূত্রে আমিও সবাইকে মামা বলে ডাকতাম। বয়সে সাত বছর বড় কিংবা এক বছর- সবাই আমার মামা।

আমার সমবয়সী মামাদের সঙ্গে খেলেই আমার শুরু হয় খেলাধূলার প্রথম পাঠ। নানু বাসা থেকে বের হয়ে অল্পকিছু দূর হেঁটে গেলে বিশাল খেলার মাঠ- ভুঁইয়া বাড়ি। মাঠ ঘেষে নাসিরাবাদ কলেজ। সেই কলেজের মাঠেও মাঝে মাঝে খেলতে যেতাম। পাড়ায় পাড়ায় বাজিতে খেলা হতো- দশ টাকা বাজি।

সেই খেলা কী সে উত্তেজনা!- আমার ছোটভাই স্বচ্ছ সেদিন শুনে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, সে স্কুলের মাঠে মাঝে মাঝে খেলে- এলাকা কিংবা পাড়া বলে যে আরেকটা ব্যাপার আছে এবং এই ধরনের খেলাও হতে পারে টাকা দিয়ে সে ব্যাপারে তার জানা নেই। এমনকি আমাদের ঠিক পাশের ফ্ল্যাটে কারা থাকে এ কথা যদি সে বলতে পারে, আমি ভীষণ অবাক হবো।
বাবা-মা, সরকারি চাকরির সুবাদে আমি বড় হয়েছি নানুর কাছেই। বাবা এক জায়গায়, মা এক জায়গায়- আমি ক’বার স্কুল বদলাবো? সেই চিন্তা থেকেই ক্লাস ফাইভ থেকে নানুর কাছে ছিলাম। এরপর জিলা স্কুলে এসএসসি পর্যন্ত।


ঢাকায় চলে যাওয়ার সময় অনেক বন্ধুরা দেখা করতে এসেছে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। তেমন কোনো কথা বলছি না। যদিও ঐ সময়ে নিজেকে অনেক বড় ভাবতাম, আদতে তা ছিলাম না। বিদায় কিভাবে নিতে হয়, কেমন করে বলতে হয়- দেখা হবে, ভালো থাকিস; এইসব আচার-ব্যবহার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় আমি চুপ করে ছিলাম।

একটা শূন্যতা গ্রাস করে নিচ্ছিল- এত পরিচিত সবকিছু ছেড়ে চলে যাচ্ছি- আম্মু বলে দিয়েছে ঢাকার রাস্তায় সাইকেল চালানো যাবে না, ক্রিকেট খেলতে পারব না- বিশ্বাস হচ্ছিল না ঠিক। আম্মুর উপর অভিমান করে বোধহয় সাইকেল আমার একজন বন্ধুকে দিয়ে এলাম।
এরপর থেকে ইট-পাথরের ধানমন্ডি, তাও পাশে একটা লেক আছে বলে রক্ষা- একটু নিঃশ্বাস নেয়া যায়। এমন নয় যে এই নিঃশ্বাস নিতে না পারলে আমি মারা যাব তবু খোলামেলা কোনোকিছুর সামনে আমি নিজের বেঁচে থাকাটাকে একটু ভালো করে অনুভব করতে পারি।
তারপরেও আমি বেঁচে থাকা, নিয়ম করে ঘুম থেকে ওঠা, কাজে যাওয়া, পড়াশোনা করা, আড্ডা- সবকিছুতেই বেদনা ছুঁয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকি।

নিঃসঙ্গ থাকতে আমার ভালো লাগে। নিঃসঙ্গ মানে আক্ষরিক অর্থে নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়া নয়, বরং অনেক মানুষের ভিড়ে হঠাৎ করে শূন্যবোধ করা, জীবনের মানে খুঁজে না পাওয়ার ভেতরেই বোধহয় বেঁচে থাকার নির্যাস খুঁজে পাই।
ফেব্রুয়ারি শুরু হবে হবে করছে। বইমেলা- নিজের বই আসছে, গত দুইবার মেলায় আসতে পারি নি- এবার প্রতিদিন থাকব, প্রতি বিকেলে অথবা সন্ধ্যায় ধুলোসমেত হেঁটে বেড়াব, মাঝে মাঝে বই উল্টে দেখব, প্রতিদিন দু’টো করে বই কিনব; এগুলো ভেবে রেখেছিলাম। অথছ মেলা এগিয়ে আসতে না আসতেই দেখি আমার উৎসাহে ভাটা পড়েছে।

আজ ১৪ তারিখ। আমি মেলায় গিয়েছি এখন পর্যন্ত ৩ দিন। কোনোদিন এক ঘন্টার বেশি থাকি নি। এমন একটা সময়ে ৩ তারিখ রাতে বন্ধু ফোন করে বলল, সে আনন্দীপুর যাবে।
আমি প্রথমে ধরতে পারি নি।

ভেবেছিলাম বন্ধুরা মিলে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা বলছে, অনেক মজা হবে, ভালো সময় কাটবে- এজন্য সে আনন্দীপুর যাবার কথা বলছে, কিন্তু সত্যি সত্যি যে আনন্দীপুর নামে জায়গা আছে আমি বুঝতে পারি নি।
আনন্দীপুর- ময়মনসিংহ নদীর ঐ পাড়ে একটা গ্রামের নাম। ঘুরতে যাওয়া নয়, বন্ধুর ইচ্ছে সেখানকার মানুষদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পৌছে দেয়া, বিনামূল্যে হেলথক্যাম্প। আমি সানন্দে রাজি হয়ে যাই।
মন আবার ভালো হয়ে যায়।

দীর্ঘদিন পর ময়মনসিংহ যাব। মাঝে গিয়েছিলাম আমার নানু মারা যাবার পর। এতটাই বিহবল হয়েছিলাম তখন পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে দেখার অবসর কিংবা ইচ্ছে কোনোটিই হয় নি।
পাঁচ তারিখ ভোর ছয়টায় এনা বাসে উঠে প্রথমেই মনে হলো- আমার নীল সাইকেলটি কোথায়? এখন আবার সাইকেল কিনেছি-ট্যালাস ২। এখন আর মা মানা করেন না।

ঢাকার রাস্তায় দিব্যি চালিয়ে বেড়াই। আচমকাই আমার নীল সাইকেলের কথা ভেবেই বিষণ্ণ হয়ে গেলাম।
আনন্দীপুর নামে সত্যি একটি জায়গা আছে তবে- আমরা সেখানে যাচ্ছি। বন্ধুর বাসায় উঠব। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই বাসা।

আরেক বন্ধুর বিয়ের দাওয়াত খেয়ে তার পরদিন যাচ্ছি আমরা ছয় থেকে সাতজন ডাক্তার সঙ্গে কিছু ইঞ্জিনিয়ার ফ্রেন্ড, লোকাল ফ্রেন্ড মিলিয়ে ১১ জনের একটি দল। বাইরোড যাওয়া যায় বলে শুনেছি। আমরা নদীপথ বেছে নেই। নদীপথ মানে অনেক দূরের কোনো পথ পাড়ি দেওয়া নয়, শুধুমাত্র এই পাড় থেকে ঐ পাড় যাওয়া। এরপর ওখান থেকে বাইক দিয়ে মাত্র বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটের পথ।

পৌঁছে যাই খুব তাড়াতাড়ি।
বাংলাদেশের গ্রামের চেহারা যেমন হয় ঠিক তেমন- বিচিত্র কিছু না, নতুন কিছু না। আমাদের জন্য যেখানে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেখানে অনেক ভিড়। নাস্তা খেয়ে রোগী দেখতে বসে গেলাম। সিরিয়াস তেমন কেউ নেই।

যে দু একজন পাচ্ছি তাদেরকে আমরা ময়মনসিংহ মেডিকেলে রেফার করে দিচ্ছি- এই হচ্ছে ভালো চিত্রগুলো।
পেছনের গল্পটা অন্যরকম।
কেবল নদের এই পাড় আর ঐ পাড় এ জীবনযাত্রার মানে এত তফাৎ থাকবে কে বুঝতে পেরেছিল? চিকিৎসা সুবিধা অনেক পরের ব্যাপার- এখানকার মানুষদের নূন্যতম খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকাটাই অনেক আশ্চর্যের ব্যাপার বলে মনে হলো। অনেকে আছে জীবনে এই প্রথম কোনো চিকিৎসক দেখল। স্টেথোস্কপ দেখে ভাবল, এইটা আবার কী ধরনের জিনিষ? আমরা তাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা মেডিসিন যথাসম্ভব দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

সন্দিহান হয়ে যাই তখনি- আদৌ এরা ঠিকমতো খাবে কি’না অথবা খেতে পারবে কি’না, যাদেরকে হাসপাতালে যেতে বলছি তারা আদৌ যাবে কি’না।
ফেরার পথে বুঝে যাই- আনন্দীপুরেও আনন্দ নেই, এটা আসলে বেদনার গ্রাম।
নানুর কবর দেখতে যাই ওখান থেকে ফিরে। নানু-নানাভাই পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছেন নিশ্চিন্ত-নির্ভরতায়। চমকে উঠি আকুয়া হাজি বাড়িতে এসে।

যেখানে আগে বিশাল একটা পুকুর ছিল, সেখানে এখন বিশাল বিশাল বিল্ডিং। আর ভুঁইয়া বাড়ির খেলার মাঠ দেখতে যেতে সাহস পাই না।
রাতের ভেতরেই ঢাকায় ফিরে আসি। দু’দিন বলতে গেলে না ঘুমিয়ে ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি।

ভোরের দিকে ঘুম ভেঙ্গে যায় স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে দেখি- আমার নীল সাইকেলের গায়ে বিশাল বড় একটি ডানা, সে আকাশে উড়ছে। হঠাৎ কী হলো, বুঝতে পারলাম না। তার আগেই দেখি সাইকেল ডুবে যাচ্ছে হাজীবাড়ি পুকুর পাড়ে! অথচ, এমন হবার কোনো কথাই ছিল না!

সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।