আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভূমি ক্রয়ে ক্রেতার করণীয়

আমি সত্যে অবিচল। জমি-জমার মূল্য বর্তমানে অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর সুত্রে আমাদের দেশে একই জমিকে সাত আটবার বিক্রি করার ঘটনা অহরহই ঘটছে। অর্থাৎ একই জমিকে ভিন্ন ভিন্ন দলিলে কয়েকবার বিক্রি করা হচ্ছে। কোন কোন সময় ভিন্ন লোককে বিক্রেতা সাজিয়ে ভূয়া দলিল রেজিষ্ট্রারী করছে।

সীমাহীন জালিয়াতির মাধ্যমে বিরামহীনভাবে চলছে দেশব্যাপী এমন জোচ্চুরী। দেশে যে রেজিষ্ট্রেশন ও ভূমি আইন প্রচলিত রয়েছে তার ফাঁক ফোকর গলেই এক শ্রেনীর ধূর্তরা এমন জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে। এমনকি মিথ্যা ও ভূয়া দলিলের মাধ্যমে সরকারের খাস জমিকেও তারা অবলীলায় বিক্রী করে চলেছে। প্রচলিত ব্যবস্থা এমনই যে কেউ যদি জাতীয় সংসদও বিক্রী করে দেয় সাব-রেজিষ্ট্রারের তা জানারও কোন উপায় নেই। আইনের ফাঁক ফোকর ও দুর্বলতার সুযোগে টাউট বাটপাররা একদিকে যেমন ভূমির ক্রেতাকে ঠকাচ্ছে, তেমনি বিক্রেতাকেও।

একদিকে জাল দলিল মারফত দায়বদ্ধ ও কন্টকাকীর্ণ জমিকে তারা নির্দায়ী ও নিষ্কন্টক বানিয়ে ফেলছে, তেমনি কতিপয় ক্ষেত্রে নির্দায়ী ও নিষ্কন্টক ভূমিকে তারা কন্টকাকীর্ণ করে তুলছে। তাই জমি কেনার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা খুবই জরুরী। ভেজাল জমি কিনে একদিকে যেমন সারা জীবনের সঞ্চয় হারাতে হয়, তেমনি পুত্র পৌত্রাদি ওয়ারিশানক্রমে সকলকে কোর্ট কাছারি,মামলা মোকদ্দমার সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দেয়া হয় । ১৯০৮ সালের যে আইনের ভিত্তিতে আমাদের দেশে এখনো জমি কেনাবেচা চলছে সে আইনের ফাঁক ফোকরে জালিয়াতির সংখ্যাও বাড়ছে সীমাহীন গতিতে। ভূমির মালিকানা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন ব্যাপার বটে।

অজ্ঞ লোকজন মুন্সি-মোহরী ও দালালের শরণাপন্ন কিংবা খপ্পরে পড়ে ভূমি ক্রয় করতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ করেছেন-এমন উদাহরণ ভুরিভুরি। পরিণামে তাদের আমছালা দুটোই গেছে। অনেক শিক্ষিত লোকজনকেও দেখা গেছে ভাল করে কাগজপত্র যাচাই বাছাই না করে জমি ক্রয় করে মহা বিপদে পড়েছেন। ক্রয়ের পর জমিতে বাড়ী করতে গিয়ে জানতে পারলেন ঐ জমি ব্যাংকের নিকট বন্ধকী অবস্থায় আছে। এছাড়া এমন ঘটনাও ঘটেছে, জমির কাগজপত্র সব ঠিক, মালিকানা স্বত্বও ঠিক, কিন্তু জমির পজেশন বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে অন্যটা।

অর্থাৎ অন্য দাগের জমিকে সেই দাগের জমি বলে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া আইনগত ফাঁক ফোকর তো আছেই। এজন্য জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতাকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপর জোর দিতে হবে। ১। যার কাছ থেকে জমি কিনবেন তার থেকে ঐ জমি সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্রের ফটোকপি চেয়ে নিন।

যেমন, সি.এস খতিয়ান, আর.এস খতিয়ান, এস.এ খতিয়ান, বি.এস খতিয়ানসহ আজ পর্যন্ত যত কেনাবেচা হয়েছে সেগুলোর বায়া দলিল, মিউটেশনকৃত খতিয়ান এবং হাল সালের খাজনার দাখিলাসহ সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্র। ২। এরপর উল্লেখিত কাগজপত্রগুলো একজন ভাল সিভিল ল’ইয়ার (আইনজীবি) কে দিয়ে জমিটির ‘টাইটেল’ ঞরঃষব ঃবংঃ করিয়ে নিন। বিজ্ঞ আইনজীবি যেভাবে টাইটেল টেষ্ট করবেন-তা হলো- তিনি সি.এস খতিয়ান ও এস.এ খতিয়ান পাশাপাশি মিলিয়ে দেখবেন জেলা, মৌজা, থানা দাগ নাম্বার ইত্যাদি মিলে কিনা। যদি না মেলে তাহলে জানতে হবে কেন মিললো না।

যেখানে সি.এস ভেঙ্গে এস.এ দাগ হয়েছে সেখানে না মিলবারই কথা । অতএব ঐ মৌজার সি.এস সীট এবং এস.এ সীট জোগাড় করে এরপর সি.এস সীটের উপর এস.এ সীট বসিয়ে দেখতে হবে সি.এস দাগ ভেঙ্গে কয়টি দাগ হয়েছে এবং সেগুলো কি কি। এরপর ভূমি রেকর্ডরুম থেকে ঐ খতিয়ান গুলোর সইমুহুরী নিয়ে মালিক বা রায়তের নাম কনফার্ম হতে হবে। যদি সি.এস খতিয়ানের দখলকারের নামের সহিত এস.এ খতিয়ানের রায়তের নাম না মিললে দেখতে হবে সি.এস এর মালিক জমিটি কি করলেন। তিনি যদি বিক্রী, দান, হেবা ,এওয়াজ বা কোনরুপ হস্তান্তর করে থাকেন, তাহলে সাব রেজিষ্ট্রারী অফিসে গিয়ে তল্লাশী দিতে হবে এবং হস্তান্তর দলিলের সইমুহুরী নকল বের করতে হবে।

আর যদি সি.এস খতিয়ানের মালিক জমিটি হস্তান্তর না করে থাকেন, তাহলে তার বংশ তালিকা নিয়ে ফরায়েজ অনুযায়ী দেখতে হবে বিক্রেতার অংশ/হিস্যা কতটুকু। তিনি ফরায়েজ অনুযায়ী যতটুকু জমির প্রাপক, ততটুকু কেনাই নিরাপদ হবে। ৩। বিক্রেতার জমিটি তার অন্যান্য শরীকদারের সঙ্গে অংশনামা হয়েছে কিনা তা দেখতে হবে। বিক্রেতা যদি বলেন যে, আপোষমুলে বন্টন হয়েছে, কিন্তু তা রেজিষ্ট্রী হয়নি।

তাহলে ফরায়েজ অনুযায়ী বিক্রেতা যেটুকু হিস্যার দাবীদার তার চাইতে একচুল বেশী কেনাও নিরাপদ হবে না। ৪। ফরায়েজ ও হিস্যা বন্টন খুব সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। ৫। নামজারী বা সর্বশেষ খতিয়ান পর্যালোচনা করতে হবে।

বিক্রেতার নামে সর্বশেষ খতিয়ান না থাকলে ঐ সম্পত্তি খরিদ করা যাবে না। উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে পূর্ববর্তীর নাম খতিয়ানে লিপি থাকলে সম্পত্তি খরিদ করা যায়। তবে এখানে ওয়ারিশ সম্পর্কে সবিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। ৬। দাতা যদি খরিদ সুত্রে মালিক হয়ে থাকেন, তাহলে বায়া দলিল সমুহ পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।

যতবার সম্পত্তিটি ক্রয় বিক্রয় হয়েছে, তার প্রতিটি দলিল নিরীক্ষা করতে হবে। ৭। বায়া দলিলের সাথে মৌজা, খতিয়ান, দাগ নাম্বার ও জমির পরিমাণ মিলিয়ে দেখতে হবে। বায়া দলিলের ধারাবাহিকতা ও খতিয়ানের ধারাবাহিকতা মিলিয়ে দেখতে হবে। ৮।

বিক্রেতার নিকট জমির দখলটি নিরংকুশ ভাবে আছে কিনা সেটা ভালভাবে যাচাই করে দেখতে হবে। ৯। জমি বিক্রেতার মালিকানা স্বত্ব তথা বিক্রয়ের বৈধ অধিকার আছে কিনা তা দেখতে হবে। অর্থাৎ জমির মালিক নাবালক কিংবা অপ্রকৃতস্থ কিনা লক্ষ্য রাখতে হবে। নাবালক হলে আদালতের মাধ্যমে গার্ডিয়ান নিযুক্ত করে বিক্রয়ের অনুমতি নিতে হবে।

১০। অংশীদার ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে জমি নিলে আইনের বিধান মতে সকল অংশীদারকে নোটিশ দিতে হবে। অন্যথায়, পরবর্তীতে প্রিয়েমশান বা অগ্রক্রয়ের মামলা হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। ১১। বিক্রেতা যদি তার ক্রয়কৃত জমি বিক্রি করতে চান, তাহলে রেকর্ডীয় মালিক থেকে পরবর্তীতে হস্তান্তরিত সকল বায়া দলিল সমুহে বর্ণিত স্বত্ব ঠিক ছিল কিনা তা দেখতে হবে।

ঐ দলিলে বর্ণিত খতিয়ান ও দাগ নাম্বার অনুযায়ী খতিয়ানাদি বের করে তা-ও বিশ্লেষন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট রেজিষ্ট্রারী অফিস ও ভূমি অফিস /খতিয়ান অফিস/ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসন (রাজস্ব) অফিস সইমুহরী নিয়ে তা যাচাই করতে হবে। ১২। আরও খতিয়ে দেখতে হবে জমিটি খাস, পরিত্যাক্ত কিম্বা শত্রু সম্পত্তি কিনা। অথবা সরকার কোন কারনে সম্পত্তিটি অধিগ্রহন করেছে কিনা।

১৩। ষ্টেট একুইজিশন এন্ড টেন্যান্সী এ্যাক্টের ৯৭ ধারা অনুযায়ী কোন আদিবাসীর ভূমি অনুরূপ আদিবাসী ব্যতিত অন্য কেহ ক্রয় করতে চাইলে বা অন্যের নিকট হস্তান্তর করতে চাইরে দলিল রেজিষ্ট্রী করার পূর্বে রেভিনিউ অফিসারের লিখিত সম্মতি নিতে হয় যাহা দলিলে উল্লেখ করতে হয়। এই বিধান লংঘন করলে ভূমি ক্রয় বা হস্তান্তর বাতিল হয়ে যায়। ১৪। প্রেসিডেন্ট আদেশ নং ৯৮/৭২ অনুযায়ী, ১৩-৪-৮৪ তারিখ পর্যন্ত কোন পরিবার ১০০ বিঘার অতিরিক্ত ভূমি এবং (অধ্যাদেশ ১০/৮৪) ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ৪ ধারা অনুযায়ী যে সকল মালিক বা পরিবারের ৬০ বিঘার নিম্নে অথবা ৬০ বিঘা পর্যন্ত ভূমি ছিল তারা উক্ত অধ্যাদেশ জারীর তারিখ হতে (অধ্যাদেশ ১০/৮৪) ক্রয় বা অন্যবিধ উপায়ে অর্জন করতে পারবেন না।

১৫। রেজিষ্টি অফিস থেকে Non-Encumbrance Certificate (N.E.C) নিতে হবে। এতে ঐ জমির সর্বশেষ মালিকের নাম থাকবে। বিক্রেতাই যদি ঐ মালিক হন, তাহলে ঠিক আছে। ১৬।

এরপর দেখতে হবে বিক্রেতা ঐ জমির ব্যাপারে কাউকে Power of attorney দিয়েছেন কিনা। এছাড়া ব্যাংক কিম্বা অন্য কোন প্রতিষ্টানে মর্টগেজ দিয়েছেন কিনা -এটাও রেজিষ্ট্রি অফিসে তল্লাশী দিয়ে জানতে হবে। ১৭। জমিটি টাইটেল টেষ্ট OK হওয়ার পরও কিন্তু কাজ থেকে যায়। এবার বি.এস সীট/ আর.এস সীট নিয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখতে হবে সীট অনুযায়ী ঐ জমিটিই সেই দাগের জমি কিনা।

নাকি দালালেরা অন্য দাগের জমি ক্রেতাকে দখল দিতে যাচ্ছেন। ১৮। বিক্রয়ের জন্য প্রস্তাবিত জমিটি বর্তমানে দখলে কে আছে, ক্রয় করলে কোন কারনে ভোগ দখলে বাধাগ্রস্থ হবে কিনা কিম্বা রাস্তা বা পথাধিকারে কোন বাধা নিষেধ আছে কিনা তা-ও সরেজমিনে যাচাই করে নিতে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক পাওয়ার পরও খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে ঐ জমি নিয়ে কোন মামলা মোকদ্দমা আছে কিনা। সম্ভব হলে পত্রিকায় লিগ্যাল নোটিশও দেয়া যেতে পারে।

লিগ্যাল নোটিশের কয়েকটি ফটোকপি ঐ এলাকার দর্শনীয় স্থানে টাঙ্গিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু এ কথা মনে রাখতে হবে যে, লিগ্যাল নোটিশের কোন লিগ্যাল ভেল্যু নেই। কেননা যে কেউ আদালতে এই যুক্তি দেখাতে পারে যে, সে ঐ পত্রিকা পড়ে না কিংবা পড়লেও ঐ দিনেরটা পড়েনি, কিংবা ঐ দিনেরটা পড়লেও লিগ্যাল নোটিশ পড়েনি। দলিল রেজিষ্ট্রি করার আগে সবকিছু ঠিকঠাক পাওয়া গেলে এরপর দলিল প্রস্তুত করতে হবে। দলিল লেখার ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করা একান্ত আবশ্যক।

মুন্সি মুহুরী দিয়ে দলিল না লিখিয়ে একজন ভাল ল’ইয়ার (আইনজীবী) এর শরনাপন্ন হওয়া উচিৎ। কেননা ভুমি সংক্রান্ত আইনগত দিকগুলো তিনিই ভাল বুঝবেন। ভূমি আইন, হেবা আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ও রেজিষ্ট্রেশন আইন সম্পর্কে অজ্ঞ কোন লোক দিয়ে দলিল লেখানো ঠিক নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কোন কোন আইনজীবীকেও দেখা যায়, তিনি তার নিয়োজিত মুন্সি বা জুনিয়র দিয়ে দলিল লিখিয়ে তা রেজিষ্ট্রী করতে পাঠান। মক্কেলের দলিলকে এত হালকাভাবে নেয়া আদৌ উচিত নয়।

দলিল লেখা ও রেজিষ্ট্রীর বিষয়কে কেবল মুন্সি মুহুরীর কাজ বিবেচনা করার কোন হেতু নেই। কেননা এতে মক্কেলের সারা জীবনের সঞ্চয় জড়িত। আর মক্কেলেরও উচিত বিষয়টির দিকে যথাযথ নজর দেয়া। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।