আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কন্যা, জায়া, জননী...

বুদ্ধিমত্তা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। আপনি তখনই বুদ্ধিমান যখন আপনার পাশের লোক বোকা !!



ব্যক্তিগত ভাবে নিজেকে আমি বেশ খানিকটা সহ্যশক্তি ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষই ভাবি। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে যখন অসুখ বিসুখে পড়ে যাই। বিশেষ করে জ্বর হলে রীতিমতো অসহায় বোধ করেই ক্ষান্ত হইনা মাকে নিজের কাছ থেকে এতটুকু সরতে দিতে চাইনা। এমনকি কিচেনে গেলেও ডাকাডাকি করি।

যতদিন শরীর খারাপ থাকে ততদিন মা আমার সাথেই থাকে আমার সাথেই ঘুমায়। কতটুকু ঘুমায় জানিনা তবে কিছুক্ষণ পরপর আমার গালে কপালে হাত রেখে উত্তাপ দেখা বা কপালে জলের পট্টি লাগিয়ে দেয়াটা প্রায়শই টের পাই। আরেকজন খুবই ছোট্ট মানুষ আছে শুধু শরীর খারাপ না আমার মন খারাপটাও কিভাবে যেনো টের পেয়ে যায়, আর শরীর মন যেটাই খারাপ থাকুক তার সারাক্ষণের কাজ হচ্ছে আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করা। কি লাগবে, চা খাবো কিনা, বেশী খারাপ লাগছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন। মনে পড়ে খুব ছোট আমি একদিন দেখি বাড়ীর সকলের পরিস্থিতি কিছুটা অন্যরকম।

কিছু একটা ঘটেছে বা ঘটবে এটা টের পাচ্ছিলাম কিন্তু কেন সবাই একটু ভিন্ন আচরণ করছে সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বিকেলের দিকে মা আমার মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিলো আর আমি দৌড়িয়ে খেলতে চলে গেলাম। সন্ধ্যায় এসে মাকে পাচ্ছিনা। মা কই গেলো এটা আমার দুঃশ্চিন্তা কিন্তু যাকে জিজ্ঞাসা করি সেই বলে আসবে। আমি রীতিমতো বিভ্রান্ত।

এভাবেই সেই রাতে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর কে জানি আমাকে বললো যে আম্মুর সাথে ছোট্ট এক বাবু এসেছে আমি যাতে দেখে আসি। কিছুটা অবাক আর বেশ খানিকটা কৌতুহলী হয়ে আমি গেলাম মা আর সেই নতুন বাবুকে দেখতে। গিয়ে দেখি মা পাশ ফিরে ঘুমুচ্ছে বা রেস্ট নিচ্ছে আর খুবই ছোট্ট এক পিচ্চি পাশে শুয়ে আছে আর আমি যাওয়া মাত্র আমাকে দেখে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। আমিও অদ্ভুত এক পিচ্চিকে দেখছি।

হঠাৎ মনে হলো পিচ্চিকে প্রথম দেখলাম কিছু তো দিতে হবে। পকেটে ছিলো ২টা ক্যান্ডি লজেন্স, কিন্তু এত ছোট ছোট হাত খাবে কি করে! বুদ্ধি করে ক্যান্ডিটা ওর ঠোঁটের কাছে ধরলাম, দেখলাম চুকচুক করে খাচ্ছে। হঠাৎ মা পাশ ফিরে দেখে আমি সেই পিচ্চি বাবুকে কি জানি খাওয়াচ্ছি। মা বলে উঠলো, এই করিস কি করিস কি। ওর মুখ থেকে এটা সরিয়ে ফেল।

ক্যান্ডিটা আমি সরিয়ে নিলাম। মা'কে জিজ্ঞাসা করলা বাবুটা কে, মা বললো, নিয়ে এসেছে ওকে আমাদের সাথে নাকি থাকবে। ব্যাপারটা আমি গুরুত্ব দিলামনা কারণ ছোটখাটো মিথ্যা মা আমাকে প্রায়ই বলে যেটা পরে আর হয়না এটা আমি জানি।

কি জানি কি ভেবে ২৫ বছর আগের স্মৃতিচারণ করলাম। সেই পিচ্চি আজ মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করে মানসিক সমস্যা বিশেষজ্ঞ হয়েছে।

এখন মন খারাপ থাকলে বা কোন কারণ বিষন্ন থাকলে সেখানে নানা ধরনের সিনড্রোম খোঁজার চেষ্টা করে, বলি তোমার সাইকোলজি পড়া তো খুবই ভুল হয়েছে, সিনড্রোমের বেড়াজালে আটকে গেছে সব। তবুও এখনও মন বা শরীর খারাপ থাকলে সেই ছোট্ট আপুটি এখনও সেই আগের মতোই আমার চারিপাশে ঘুরঘুর করে জিজ্ঞাসা করে বেড়ায় কি লাগবে। অনেক চা খাই কিন্তু সেরা স্বাদের পারফেক্ট চা আমার জন্য এখন পর্যন্ত একমাত্র আমার এই ছোট্ট আপুটিই বানাতে পারে। আমার গায়ের ফতুয়া এখন পর্যন্ত কোনটা আমি নিজে কিনিনি। কোনটা আমার লাগবে আর কোনটা আমার পছন্দ সেটা আপুই ভালো জানে।

আর একই সাথে অর্থনৈতিক দৈন্যতায় যখন ঘরের বাইরে বের হওয়া বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয় তখন বোন মানেই ভাইয়ের জন্য ঋণ পরিষোধের ঝামেলা মুক্ত রিজার্ভ ব্যাংক। আর ২৫ বছর পড়ে আমার মা'র মাথার চুলে পাক ধরেছে, গায়ের চামড়াও অনেকটা ঢিলে গেছে। হাই ব্লাড প্রেশারে আক্রান্ত মা এখনও সেই চুলো জ্বেলে ঘর পরিষ্কার করে আজো আমাদের পুষ্টি পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করে যাচ্ছে, অসুখ হলে এখনও নিজের অসুস্থ শরীর নিয়ে দিন রাত সারাক্ষণ কাছে থেকে যাচ্ছে সেবা পথ্য সব যাতে ঠিকমতো হয়।

নিজের ভাগ্যকে সবসময় ধন্যবাদ দেই এই অপরিসীম প্রাপ্তি থেকে আমাকে বঞ্চিত না করায়। যত অভিযোগ অত্যাচার সে তো মা'র উপরই।

যত ঝগড়া বা দুষ্টুটি সব তো বোনের সাথেই। পৃথিবীর সবাই ছেড়ে গেলেও আমার জীবনের এই দুই নারী কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাবেনা। স্রষ্টা আছে কি নেই জানিনা কিন্তু মা'র বাৎসল্য বা বোনের সখ্যতা এর জন্ম কোথায় বা কত বড় স্থান হলে এত বড় স্নেহ ভালোবাসার জন্ম হতে পারে সেটা ভেবে অনেক সময়ই হয়রান হই অযথা।

মনে পড়ে ক্যাম্পাসের সেই বান্ধবীদের কথা যাদের সাথে সাথে কিছুক্ষণ ঘুরে আগ বাড়িয়ে আইসক্রিম খাওয়াতে চাইলেই বুঝে যেতো আমার টাকা দরকার। বলে উঠতো আমার আগের পাওনা শোধ কর আগে তারপর আবার টাকা।

বলতাম, আগেরটা শোধ করার মতো টাকা থাকলে কি আবার টাকা চাই। রাগ দেখাতো হাউকাউ করতো আবার পড়ে খুঁজে পেতে ঠিকই দিয়ে যেতো। নারী সত্ত্বা বলে কথা! মনে পড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ের সেই তামিল বান্ধবীটির কথা। বিদেশের মাটিতে নিজে কখনও কলম কিনেছি মনে পড়েনা। অথবা সেই কোরিয়ান বান্ধবীটি যার হাতে এত এত বিভিন্ন নাম না জানা কোরিয়ান রান্না খেয়েছি যে এখনও বলি কোরিয়ান ফুড ভেরি গুড।

আর সেই সহজ সরল তুর্কি বান্ধবী যার বানানো কেকের প্রশংসা একবার করলে পরবর্তী তিন মাস ফ্রি ফ্রি কেকের সাপ্লাই নিশ্চিত। নারী মমতাময়ী!

মনে পড়ে সেই অপার্থিব সুন্দরের কথা। যে সুন্দরের সামনে দাঁড়ালে দুলে উঠতো পুরো পৃথিবী, মিলিয়ে যেতো পৃথিবীর আর সব রঙ। তীব্র কন্টকরাশি উপেক্ষা করে একদিন যার জন্য তুলে এনেছিলাম একটি বুনো ক্যাকটাস। যার জন্য অভিমানে কেঁদেছি হয়তো কাঁদিয়েছি কতবার।

এক পলক বেশী দেখার জন্য নানা অযুহাতে একদা যার জন্য মিথ্যে ছল করে তার চলার পথের পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছি। নারী, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষের সুন্দরতম অবয়ব।

জানি আমার মতো আর সকলের গল্পগুলোও একই। নারী কারো মমতাময়ী মা, কারো রাজকুমারী বেশে কন্যা, কারো বড় আদরের বোন, কারো প্রিয় সহপাঠিনী কিংবা কারো দেবীসম প্রিয়তমা। নারীতেই সমর্পন, নারীই পৃথিবীর প্রবেশদ্বার, নারীই বেঁচে থাকার প্রথম খাদ্য জোগানদাত্রী, নারীই অবলম্বন, জীবনের সব আয়োজন শেষে নারীতেই আত্নসমর্পন জীবনভর।



পৃথিবীর সকল নারীকে বিনম্র শ্রদ্ধা।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।