আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উল্কি’র সমাহার

বেশ কয়েক বছর আগেও ভাবা হত, খ্রিস্টের জন্মের ২ হাজার বছর আগে উল্কির প্রচলন শুরু হয়। প্রাচীন মিশরীয় মহিলাদের শরীরেই পাওয়া গেছে উল্কির প্রমাণ। তবে ১৯৯১ সালে ইটালিয়ান-অস্ট্রিয়ান সীমান্তে ‘বরফমানব’ আবিষ্কৃত হওয়ার পর ট্যাটুর ইতিহাস গেছে পাল্টে। কারণ বরফমানবের শরীরেও পাওয়া গেছে স্থায়ী নকশা। আর এই বরফমানবের বয়স কার্বন-ডেইট অনুযায়ী প্রায় পাঁচ হাজার দুশ’ বছর।

ইতিহাসবিষয়ক ওয়েবসাইট স্মিথসোনিয়ানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্ক-এর পুরাতত্ত্ব বিভাগের কর্মরত গবেষণাকর্মী জোয়ান ফ্ল্যাচার বলেন, “আমার সহকর্মী অধ্যাপক ডন ব্রথওয়েল প্রাচীন দেহটি পরীক্ষা করেন। তিনি জানান এই বরফমানবের শরীরের উল্কি তাঁর পদমর্যাদা বহন করে। ”

ফ্ল্যাচার জানান, প্রাচীন মিশরীয় মানুষের শরীরে যেসব ট্যাটু আছে তার সবই মেয়েদের মমিতে পাওয়া গেছে। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় সাড়ে ৪ থেকে ৩ হাজার বছর আগে আঁকা এসব উল্কির একেক রকম মানে রয়েছে।

এর থেকে আন্দাজ করা হয় উল্কি, সে সময় একচেটিয়া মেয়েদের দখলেই ছিল।

আর বেশিরভাগই ছিল উচ্চবংশের প্রাচীন মিশরীয় নারী।

এছাড়া পতিতা বা যৌনরোগ থেকে বাঁচার চিহ্ন হিসেবেও কোনো কোনো নারীর শরীরে উল্কি করা হত।

ফ্ল্যাচার ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, প্রাচীন মিশরীয় নারীদের রক্ষাকবজ হিসেবে ব্যবহৃত হত উল্কি। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় ও সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় কোনো অশুভ শক্তি যেন তাদের ক্ষতি করতে না পারে।

তিনি বলেন, “তলপেট ও উরুর চারপাশের নকশার ধরন দেখে অন্তত তাই মনে হয়।

ইতিহাস এত প্রাচীন হলেও এখনও চলছে ট্যাটুর যাত্রা। যুগে যুগে মানুষের শরীরকে ক্যানভাস বানিয়ে আঁকা হচ্ছে নকশা।

এই দিক দিয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই আমাদের বাংলাদেশ। তবে এদেশে উল্কির ইতিহাস বেশিদিনেরও নয়। একসময় দেশের বাইরে গিয়ে উল্কি আঁকিয়ে আনলেও এখন রাজধানীতেই জমেছে ট্যাটু আঁকার ব্যবসা।

আর এই ধারা প্রথম যিনি চালু করেন তার নাম সাদমান তৌহিদ অলিন।

অলিনের দেশীয় ট্যাটু।

মডেল: সাকিব জামান। ছবি: ই স্টুডিও।

 

নিজেকে একজন ট্যাটু আর্টিস্ট হিসেবেই পরিচয় দিতে ভালোবাসেন অলিন।

বাবা-মা দুজনই চিত্রশিল্পী। সে কারণে ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকিতে পটু। বর্তমানে লেখাপড়া করছেন ইউনিভার্সিটি অফ ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের চারুকলা বিভাগে। পাশাপাশি ২০০৮ সাল থেকে পেশাদার উল্কি আঁকিয়ে হিসেবে কাজ করছেন।

নিজেকে ট্যাটু আর্টিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতে গিয়ে অলিন বলেন, “আমি কোনো নকশার অনুকরণে উল্কি আঁকি না।

যারাই আমার কাছে আসে, তাদের শরীরের গঠন, কাজের ধরন, তার চাওয়া বা পছন্দ-- এসব জেনে নিয়ে একটা নকশা তৈরি করি। তারপর সেই নকশার ছাপ দিয়ে উল্কি আঁকা হয় তার শরীরে। যেটা প্রকাশ করে তার ব্যক্তিত্ব। ”

“তাই যারা উল্কি নিয়ে থিম বেইজড কাজ করেন, পৃথিবীর সবখানেই তাদের ট্যাটু আর্টিস্ট বলা হয়। ” যোগ করলেন অলিন।

ছোটবেলা থেকে আঁকার কাজ ভালো করতেন বলে, জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পর তাই শিল্পীই হতে চাইলেন। সঙ্গে ছিল পরিবারের ইন্ধন। শুধু কাপড়ের ক্যানভাসের জায়গায় বেছে নিলেন মানুষের চামড়া।

তার কথায়, “ট্রাভলবিষয়ক টিভি চ্যানেলগুলোতে ট্যাটুর উপর অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে আগ্রহ জন্মাল। তারপর শুরু করলাম ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি।

অনলাইনে উল্কি আঁকা প্রশিক্ষণ দেয়, এরকম ওয়েবসাইট পেলাম। অনলাইনেই প্রশিক্ষণ চলল। কোর্স শেষ করলাম। ”

“হাতেকলমে কাজ করার জন্য আমি প্রথমে কৃত্রিম চামড়ায় প্র্যাকটিস শুরু করলাম। অনলাইনে যাদের কাছে কোর্স নিয়েছিলাম তারই আমাকে সিলিকনের তৈরি নকল চামড়া পাঠাল।

আমি উল্কি এঁকে তাদের দেখাতাম। এভাবেই চলতে থাকল। তবে মজার ব্যাপার হল, আমার এক সমবয়সী আত্মিয়ের জোরাজুরিতে তার শরীরে প্রথম উল্কি আঁকলাম। আর সেটা দেখেই আমাকে যারা প্রশিক্ষণ দিয়েছিল তারা জানাল আমি ইচ্ছা করলে এখন মানুষের শরীরে উল্কি আঁকা শুরু করতে পারি। ” বললেন অলিন।

এদেশে অনেক আগে থেকেই মেহেদি দিয়ে হাতে নকশা করা শুরু হয়। তাহলে তো এদেশেও ‘বডি আর্টে’র প্রচলন অনেক আগে থেকে। এই প্রসঙ্গে অলিন জানান, “আমি প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে যা শিখেছি তাহল উল্কি হচ্ছে চামড়ার ভেতরে আঁকা নকশা, যা স্থায়ী। তাই মেহেদি আর উল্কি এক জিনিস নয়। ”

আলপনা নকশায় উল্কি।

মডেল: সামিন ও সাকিব জামান। ছবি: ই স্টুডিও।

 

তিনি আরও বলেন, “মানুষের চামড়ার বেশ কয়েকটি স্তর আছে। আমরা উল্কি আঁকি ঠিক উপরের চামড়ার নিচের স্তরে। ঘষা লেগে চামড়া ছড়ে গিয়ে লালচে যে চামড়া বেরিয়ে আসে, সেখানেই আমাদের শিল্পের আঁচড় চলে।

“সেই নকশার উপর দিয়ে যখন নতুন চামড়া গজায় তখনই ট্যাটু স্থায়ী হয়ে যায়। আর সেই নকশা শরীরে নিয়ে যখন একটি মানুষ ঘুরে বেড়ায়, তখন সে হয়ে যায় জীবন্ত গ্যালারি। অন্যরা তার উল্কি দেখে জিজ্ঞেস করবে কোথা থেকে করেছ? তখন শিল্পীর নাম বলতেই হবে। এ কারণেই উল্কি আঁকিয়েদের বলা হয় ট্যাটু আর্টিস্ট। ” যুক্ত করলেন অলিন।

তিনি জানান, সাধারণত যে কোনো উল্কি করার পর পুরোপুরি শুকাতে এক সপ্তাহ লাগে। আর যে রং ব্যবহার করে উল্কি আঁকা হয় সেগুলো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি এবং অ্যালকোহল দেওয়া থাকে। তাই রংগুলো নষ্টও হয় না, শরীরেও কোনো ক্ষতি বা ঘা তৈরি করে না।

অলিন উল্কি আঁকার জন্য জাপান ও আমেরিকা থেকে রং আমদানি করেন। আর যে মেশিন দিয়ে আঁকেন তা আমেরিকা থেকে আনা।

হ্যান্ড মেইড ট্যাটু গান নামে পরিচিতি এই মেশিনের অপর নাম ‘রোটারি ট্যাটু মেশিন’।

তিনি জানান, এখন সস্তায় চায়না থেকে ট্যাটু মেশিন আনা যায়। তবে সেগুলো দিয়ে বেশিক্ষণ কাজ করা যায় না।

ট্যাটু আঁকার জন্য আলাদা কোনো দোকান করেননি অলিন। বাসার ড্রয়িংরুমটাই তার স্টুডিও।

অলিন বলেন, “একটা নির্দিষ্টি জায়গায় আউটলেট খুলে এই কাজ করার মতো পরিস্থিতি আমাদের দেশে এখনও তৈরি হয়নি। ”

মার্কিন আলোকচিত্রি ক্রিস রেইনার বহুদিন ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ট্যাটুর ছবি তুলছেন, গবেষণা করছেন।

তিনি দেখেছেন, নিউ গিনির মহিলার গালে আঁকা ঘূর্ণায়মাণ উল্কি তার বংশমর্যাদা বহন করে। কম্বোডিয়ার সন্ন্যাসীর বুকের উল্কি তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাক্ষর। লস অ্যাঞ্জেলেসের একজন গ্যাং মেম্বারের আঁকাবাঁকা উল্কি তার কাজের প্রকাশ, এমনকি মনে হতে পারে সে একজন খুনি।

আবার নিউ জিল্যান্ডের আদিবাসী মাওরিদের সর্দার বা জাপানের মাফিয়া লর্ডের উল্কি বহন করে তাদের অমোচনীয় পরিচয়।

স্মিথসোনিয়ানের একটি প্রতিবেদনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির এই চিত্রগ্রাহক জানান, তাদের মতে এর মানে হচ্ছে ‘আমি’। আর আমিও এই ধরনের কাজই করি।

আর আমাদের দেশের মানুষ কী ধরনের উল্কি আঁকছে? এই প্রশ্নের জবাবে অলিন বলেন, “ব্যক্তিগতভাবে আমি বেশকিছু কাজ করেছি। সেসব নকশায় আমাদের গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন মোটিফ ব্যবহার করেছি।

গ্রামের বিয়েতে যে রকম আলপনা করা হয়, সে রকম নকশায় ট্যাটু এঁকেছি। এর মাধ্যমে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। ”

অলিন জানান, এখনও ব্যাপকভাবে ট্যাটু আঁকার প্রচলন এদেশে শুরু হয়নি। আর যারা করান তাদের মধ্যে ছেলেদের সংখ্যাই বেশি।

নিজের পর্যবেক্ষণ থেকে জানান, এই সময়ের তরুণ মিউজিশিয়ানদের মধ্যেই গায়ে উল্কি আঁকার প্রবণতা বেশি।

তবে বেশ কিছু মজার তথ্যও দিলেন এই উল্কিশিল্পী।

অলিনের ভাষায়-- “আমি একজন জজের পিঠজুড়ে ট্যাটু এঁকেছি। এই নকশার একদিকে আছে শয়তানের পাখা, অন্যপাশে পরির পাখা। আর মাঝখানের দণ্ডটা হচ্ছে দাড়িপাল্লার, যার মাধ্যমে অপরাধ, শাস্তি আর সুবিচার ফুটে উঠছে। আবার এক মেরিনারের হাতে মাছের সিম্বল দিয়ে নকশা করেছি।

কারণ তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে সমুদ্রে। ”

মেরিনারের হাতে মাছের উল্কি।

 

“মজার বিষয় হচ্ছে একজন মৌলবিও আমার কাছ থেকে ট্যাটু করেছেন। তবে তিনি নকশা নয়, লিখিয়েছেন কিছু অক্ষর। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন করছেন এটা? এতে অসুবিধা হবে না আপনার।

তিনি সহজ ভাষায় বললেন, আমরা বিভিন্ন নকশার পাঞ্জাবি পরি, পাঞ্জাবিতে প্রতিষ্ঠানের লোগো দেওয়া ট্যাগ থাকে। সেগুলো গায়ে দিয়ে যদি ধর্মের কাজ করা যায়, তাহলে এতেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ”-- যুক্ত করলেন এই উল্কিশিল্পী।

তাই অলিন মনে করেন, “আমি বিশ্বাস করি, আর এক জেনারেশন পরেই ট্যাটুর প্রচলন এদেশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে। ”

অলিনের দেওয়া উল্কি নিয়ে কিছু তথ্য

* যেখান থেকেই উল্কি আঁকান না কেন, অবশ্যই কালি ও মেশিনের গুণগত মান ভালো মতো খোঁজ নিয়ে নেবেন।

* গায়ের চামড়ার ও শরীরের গঠনের উপর নির্ভর করে ট্যাটুর রং ও নকশা নির্বাচন করা উচিত।

* শুধুই স্টাইল করতে ফ্যাশন নয়, উল্কি মানুষের পরিচয় বহন করে। তাই যে রকম উল্কি আঁকান না কেন এর অর্থ বুঝে নিন।

* ফেইসবুক বা নেটে সার্চ করে এদেশে বেশ কয়েকটি ‘ট্যাটু শপ’-এর খোঁজ পাওয়া যাবে। তবে নিশ্চিত হয়ে নিন, তারা স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে, ভালো কালি ও মেশিন দিয়ে কাজ করছে কি না।

* নকশার ধরন, আকৃতি, নকল বা মৌলিক নকশা, দেহের কোথায় এবং কতটা জায়গাজুড়ে উল্কি করা হবে-- এর উপর নির্ভর করে ট্যাটুর দাম।

* যদি উঠানোর ইচ্ছে থাকে তাহলে ট্যাটু না করাই ভালো। কারণ সেটা খুবই পেইনফুল আর এক্সপেনসিভ।


সোর্স: http://bangla.bdnews24.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।