আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'চর্যাপদ থেকে অনুবাদ' - সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ (আর্টস.বিডিনিউজ থেকে)

অর্থ নয়, কীর্তি নয়...আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে হঠাৎ করেই মাথায় একটা ভূত চাপল। শওকত আলী’র ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ পড়েছিলাম অনেক আগে। আমি তখন নাইনটেনএ পড়ি। দিন কতক আগে চর্যাগীতিকা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করছিলাম। আচমকাই মনে হল ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ এর প্রেক্ষাপট আর চর্যা’র সময়কাল প্রায় একই।

তাই চর্যাগীতিগুলোর আধুনিক বাংলা তর্জমাসহ ভালভাবে পড়ে সমান্তরালে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ আবার পড়তে ইচ্ছা করল। নেটে খুঁজতে খুঁজতে এটা পেলাম। শেয়ার না করে থাকতে পারলাম না। চর্যাপদ থেকে অনুবাদ সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ (আর্টস.বিডিনিউজ থেকে) চর্যা-১ লুই শরীরের গাছে পাঁচখানি ডাল– চঞ্চল মনে ঢুকে পড়ে কাল। দৃঢ় ক’রে মন মহাসুখ পাও, কী-উপায়ে পাবে গুরুকে শুধাও।

যে সবসময় তপস্যা করে দুঃখে ও সুখে সেও তো মরে। ফেলে দাও পারিপাট্যের ভার, পাখা ভর করো শূন্যতার– লুই বলে, ক’রে অনেক ধ্যান দেখেছি, লভেছি দিব্যজ্ঞান। চর্যা-২ কুক্কুরী কাছিম দুইয়ে উপচে পড়ে ভাঁড়, গাছের তেঁতুল কুমিরের খাবার, ভেদ নাই আর ঘরে-আঙিনাতে, কানেট চোরে নিল অর্ধরাতে– শ্বশুর ঘুমে, বধূ একা জাগে, কানের কানেট কার কাছে সে মাগে? দিনে বধূ কাকের ডরে কাঁপে, রাতদুপুরে সে-ই ছোটে কামরূপে! কুক্কুরীপার চর্যা এমনই যে কোটির মাঝে একজন তা বোঝে। চর্যা-৩ বিরূপা এক সে শুঁড়িনি, ঢোকে দুইখানি ঘরে, চিকন বাকলে মদ্য ধারণ করে। সহজে এ-মদ চোলাই করো রে, তবে অজর অমর দৃঢ়স্কন্ধ হবে।

দশমীর দ্বারে ছদ্ম আমন্ত্রণ দেখে, খদ্দের সেদিকে ধাবিত হ’ন– পসরা সাজানো চৌষট্টি ঘড়ার, খদ্দের ঢুকে বা’র হয় না রে আর। একটাই ঘড়া, অতি-সরু মুখ তায়– বিরু বলে, ঢালো ধীরে ধীরে ঘড়াটায়। চর্যা-৪ গুণ্ডরী জঘনের চাপে, যোগিনী, আলিঙ্গন দে! দিন কেটে যাক পদ্ম-বজ্র-বন্ধে। মুখ-ভরা তোর কমলের রস, চুমুর চুমুকে খাব। একমুহূর্ত না যদি থাকিস তাহলেই ম’রে যাব।

খেপে গেছি আমি, যোগিনী আমার, মেয়ে, ঊর্ধ্বলোকেই করেছি যাত্রা মণিমূল বেয়ে বেয়ে– শাশুড়ির ঘরে তালাচাবি হ’ল আঁটা চাঁদ-সূর্যের দু’পাখা পড়ল কাটা। গুণ্ডরী বলে, আমি সুরতের হেতু নর-নারী-মাঝে ওড়ালাম কামকেতু। চর্যা-৫ চাটিল ভবনদী বয় বেগে গহিন গভীর, মাঝগাঙে ঠাঁই নাই, পঙ্কিল দু’তীর– চাটিল ধর্মের জন্য সাঁকো গড়ে তায়, পারগামী লোক তাতে পার হ’য়ে যায়। অদ্বয়-কুঠারে চিরে মোহতরু, তার তক্তা জুড়ে নির্বাণের সাঁকো হ’ল দাঁড়। চেয়ো না ডাইনে বাঁয়ে এ-সাঁকোয় চ’ড়ে, দূরে নয়, বোধি আছে নিকটেই ওরে।

কীভাবে ওপারে যাবে, যারা যেতে চাও, অনুত্তর স্বামী গুরু চাটিলে শুধাও। চর্যা-৬ ভুসুকু কারে করি গ্রহণ আমি, কারেই ছেড়ে দেই? হাঁক পড়েছে আমায় ঘিরে আমার চৌদিকেই। হরিণ নিজের শত্রু হ’ল মাংস-হেতু তারই, ক্ষণকালের জন্য তারে ছাড়ে না শিকারী। দুঃখী হরিণ খায় না সে ঘাস, পান করে না পানি, জানে না যে কোথায় আছে তার হরিণী রানি। হরিণী কয়, হরিণ, আমার একটা কথা মান্ তো, চিরদিনের জন্য এ-বন ছেড়ে যা তুই, ভ্রান্ত! ছুটন্ত সেই হরিণের আর যায় না দেখা খুর– ভুসুকুর এই তত্ত্ব মূঢ়ের বুঝতে অনেক দূর।

চর্যা-৭ কানু আলিতে কালিতে পথ আটকায়, তাই দেখে কানু বিমনাঃ, হায়! কানু বলে, কই করব রে বাস? যারা মন জানে তারা উদাস। তিন জন তারা, তারা যে ভিন্ন, কানু বলে, তারা ভবচ্ছিন্ন। এই আসে তারা, এই হয় হাওয়া বিমনাঃ কানু এ’ আসা ও যাওয়ায়। নিকটেই জিনপুর: কীভাবে মোহান্ধ কানু সেখানে পালাবে? চর্যা-৮ কম্বলাম্বর করুণা-নৌকা পূর্ণ সোনায়, রুপা রাখবার জায়গা কোথায়? যাও রে, কামলি, আকাশের দেশে– জন্ম গেলে কি আর ফিরবে সে? খুঁটি উপড়িয়ে, কাছি খুলে শেষে, বাও রে, কামলি, গুরু-উপদেশে। গলুইতে চ’ড়ে চৌদিকে চাও, হাল তো নাই, কে বাইবে এ-নাও? বাঁয়ে আর ডানে চেপে চেপে গেলে ঠিক পথ পেয়ে মহাসুখ মেলে।

চর্যা-৯ কানু উপ্‌ড়ে কালের শক্ত খুঁটি বিবিধ ব্যাপক বাঁধন টুটে সহজ-নলিনীকুঞ্জে ঢুকে মাতাল কানাই তৃপ্ত, সুখে। হাতির যে-প্রেম হাতিনির তরে তথতা সে-মদ বর্ষণ করে, ষড়্গতি স্বস্বভাবে শুদ্ধ, ভাবাভাবে কিছু নয় বিরুদ্ধ– দশ দিকে রেখে দশ রতন বিদ্যা-করীকে করি দমন। চর্যা-১০ কানু লো ডোমনি, তোর নগর-বাইরে ঘর, নেড়া বামুন আমায় স্পর্শ কর্‌! আ লো ডোমনি, তোরে আমি সাঙ্গা করব ঠিক, জাত বাছে না কানু, সে যে নগ্ন কাপালিক। একখানি সে পদ্ম, তাতে চৌষট্টিটা পাপড়ি, তার উপরে ডোমনি নাচে, কী নৃত্য তার, বাপ রে! ডোমনি, তোরে প্রশ্ন করি, সত্যি ক’রে বল্, কার নায়ে তুই এপার-ওপার করিস চলাচল? আমার কাছে বিক্রি করিস চাঙাড়ি আর তাঁত, নটের পেটরা, তোর জন্যেই, দিই না তাতে হাত। তোর জন্যেই, হ্যাঁ লো ডোমনি, তোর জন্যেই যে এই কাপালিক হাড়ের মালা গলায় পরেছে।

পুকুর খুঁড়ে মৃণাল-সুধা করিস ডোমনি পান– ডোমনি, তোরে মারব আমি, নেব রে তোর প্রাণ! চর্যা-১১ কানু দৃঢ়করে ধরা নাড়ির তরু বাজে অনাহত বীর-ডমরু কানু যোগাচার সাধন করে, একাকার ঘোরে দেহ-নগরে। আলি-কালি পায়ে নূপুর ক’রে সূর্য-চাঁদের মাকড়ি প’রে ষড়্‌রিপু ক’রে ভস্মসার পরে সে মোক্ষমুক্তাহার। মেরে সে শাশুড়ি ননদ শালি এবং মায়াকে, কানু কাপালিক। চর্যা-১২ কানু খেলতে ব’সে দাবা করুণা-পিঁড়ায় জিতেছি ভববল গুরুর কৃপায়: রাজাকে আটকাই দুইমুখা চালে, সামনে জিনপুর তাই তো কপালে। প্রথমে গজ চেলে বড়েগুলি, আর পাঁচটি আরও ঘুঁটি খেয়ে ফেলি তার, মন্ত্রী দিয়ে শেষে রাজাকেই খাই, কিস্তিমাত ক’রে ভববল পাই– ভালোই দান চালি, কানু বলে এই, চৌষট্টিটা ছঁক গুনে গুনে নেই।

চর্যা-১৩ কানু ত্রিশরণ-নায়ে, আট কামরায় এ-দেহ ভাসিয়ে দেখি আমারই আপন দেহে মিলে যায় শূন্য-করুণা, এ কী! স্বপ্ন ও মায়া জেনে এ-জীবন, ভবনদী তরলাম, মাঝগাঙে এক ঢেউয়ের মতন অনুভব করলাম। পাঁচ তথাগতে দাঁড় ক’রে দেহ-নায়ে কানু পার্থিব মায়াজাল ত’রে যায়। গন্ধ রস ও স্পর্শ থাকুক নিদ্রাবিহীন স্বপ্নের মতো, শূন্যে, মনেরে মাঝি ক’রে, সুখ– সঙ্গমে কানু হ’ল নির্গত। চর্যা-১৪ ডোমনি পারাপারের নৌকা চলে গঙ্গা-যমুনায়, মাতঙ্গিনী, যোগীকে পার করে সে-খেয়ায়। সাঁঝ ঘনাল, বাও রে, ডোমনি, জোরসে চালাও না’, গুরুর কৃপায় জিনপুরে ফের রাখব আমার পা।

পাঁচটি বৈঠা পাছ-গলুইয়ে, পিঁড়ায় বাঁধা দড়ি, আকাশ-সেঁউতি দিয়ে নৌকা সেচো পড়িমরি। সূর্য-চাঁদের লাটাই-দু’টি গোটায় এবং খোলে, ডাইনে বাঁয়ে পথ নাই রে, যাও বরাবর চ’লে! পয়সাকড়ি নেয় না ডোমনি, স্বেচ্ছায় পার করে; বাইতে যে-জন জানে না, সে ঘুরে ঘুরে মরে। চর্যা-১৫ শান্তি স্বয়ং-সংবেদন-স্বরূপ বিচারে অলখ হয় না লক্ষণ; সোজা পথে গেল যে-যে, আর হয় না রে তাদের প্রত্যাবর্তন! কূলে-কূলে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ো না, মূঢ়, সোজা পথ এই সংসার– ভুল পথে তিলার্ধ না যেন রে ঘুরো, কানাত-মোড়ানো রাজ-দ্বার। মোহের মায়ার এই মহাসিন্ধুর না-বুঝিস কূল আর থৈ, নাও নাই, ভেলা নাই, দেখ যত দূর, নাথে না শুধাও, পাবে কই। শূন্য এ পাথারের পরিসীমা নেই, তথাপি রেখো না মনে দ্বিধা– অষ্টসিদ্ধিলাভ হবে এখানেই হামেশা চলিস যদি সিধা।

শান্তি বলেন, বৃথা মরিস না খুঁজে, তাকাস নে বামে দক্ষিণে; সোজা পথে অবিরত চল্ চোখ বুজে, সহজিয়া পথ নে রে চিনে। চর্যা-১৬ মহীধর তিনটি পাটে কৃষ্ণ হাতির অশান্ত বৃংহণ, শুনে, বিষয়-সমেত ভীষণ ‘মার’-এর আন্দোলন; মত্ত গজেশ ছুটে গিয়ে শেষটায় গগন-প্রান্ত ঘুলিয়ে ফ্যালে তেষ্টায়; পাপপুণ্যের শক্ত শিকলটি এ ছিঁড়ে ফেলে, স্তম্ভটি উপড়িয়ে, গগন-চূড়ায় নির্বাণে মন প্রবেশ করল গিয়ে। মন মহারস-পানে মত্ত হয়, তিনটি ভুবন উপেক্ষিত রয়, পাঁচ বিষয়ের নায়কের যে শত্রু কেউ নয়! খররবিকিরণে মন গগন-গাঙে সাঁতরায়– ডুবলে কিছুই যায় না দেখা!–মহীধরে কাতরায়। চর্যা-১৭ বীণা সূর্য হ’ল লাউ আর তার হ’ল চন্দ্র, অবধূতি চাকি হ’ল, অনাহত দণ্ড; হেরুক-বীণাটি বেজে ওঠে, সখী ও লো, করুণায় শূন্য-তন্ত্রী বিলসিত হ’ল– আলি-কালি দুই সুর হ’ল তাতে বন্দি, গজবর, সমরস বীণাটির সন্ধি। করতলে করপার্শ্ব চাপ দিলে পরে বত্রিশ তন্ত্রীতে সব পরিব্যাপ্ত করে– বজ্রাচার্য নৃত্য করে, দেবী ধরে গান, বুদ্ধনাটকের তবে হয় অবসান।

চর্যা-১৮ কানু পার ক’রে দেই তিনটি ভুবন অবহেলায় সুপ্ত থেকে মহাসুখের মহালীলায়। ডোমনি রে, তোর ভাবকালির পাই না কোনো ঠিক, পিছনে তোর কুলীনজন, সঙ্গে কাপালিক! বিচলিত করলি, ডোমনি, সবকিছুকেই, চাঁদটিকে তোর টলিয়ে দেওয়ার কারণ তো নেই! বিরূপা কয় কুলোকে যদিও তোরে, জ্ঞানী জনে রাখে গলায় মালা ক’রে। কানু বলে, কামাতুরা রে চণ্ডালী, তিনভুবনে তুলনাহীন তোর ছিনালি! চর্যা-১৯ কানু ভব নির্বাণ, পটহ মাদল; মন ও পবন, কাঁসি আর ঢোল; দুন্দুভি বাজে জয়-জয়-রবে, কানু-ডোমনির আজ বিয়ে হবে। ডোমনিকে বিয়ে ক’রে জাত গেল, শ্রেষ্ঠ ধর্ম যৌতুক পেল; কাটে নিশিদিন সুরত-রঙ্গে, রজনি পোহায় যোগিনী-সঙ্গে– যে-যোগী মজেছে ডোমনির পাঁকে প্রাণ গেলে তবু ছাড়ে না সে তাকে। চর্যা-২০ কুক্কুরী হলাম নিরাশ, স্বামী ক্ষপণক, হায়, আমার বেদনা ভাষায় কওয়া না যায়।

বিয়ালাম গো মা, আঁতুড়ের খোঁজ নাই, নাই কোনোকিছু, এখানে যা-কিছু চাই। প্রথম প্রসব আমার, বাসনাপুট, নাড়িটা কাটতে-কাটতেই, হ’ল ঝুঁট! পূর্ণ আমার হ’ল নবযৌবন, ঘটল মায়ের বাপের উৎসাদন। কুক্কুরী ভনে, এ-জগৎ চির-স্থির, যে জানে এখানে, সে-ই শুধু হয় বীর। চর্যা-২১ ভুসুকু গভীর নিশীথে এখানে ওখানে চ’রে অমৃতভক্ষ মূষিক আহার করে– বায়ুরূপী ঐ মূষিকেরে, যোগিবর, আনাগোনা-রোধকল্পে, ঘায়েল কর্‌। চপল মূষিক, মাটি খুঁড়ে থাকে গর্তে, জেনে তার ঠাঁই, ধাও তাকে বধ করতে।

কৃষ্ণ মূষিক, আঁধারে সে অগোচর, আনমনা ধ্যানে হ’য়ে যায় সে খেচর, উড়াম-বা’রাম অস্থির সে-মূষিক যতখন গুরু না-দেখান তাকে দিক্। ভুসুকু ভনয়: বিচরণ শেষ হ’লে সেই মূষিকের সব বন্ধন খোলে। চর্যা-২২ সরহ নিজ মনখানি বেঁধে ভবনির্বাণে মিথ্যাই লোক ফেরে তার সন্ধানে– অচিন্তনীয় কিছুই জানি না, মন, কীরূপে জন্ম, কীরূপে হয় মরণ। জীবনে-মরণে নাই কোনো বিচ্ছেদ, জীবিতে ও মৃতে নাই রে কোনোই ভেদ। জন্ম-মৃত্যু-ভয়ে ভরা যার বাসা সে ক’রে মরুক রসরসায়ন আশা; ত্রিদশে ভ্রমণ করে যে সচরাচর কীভাবে কভু-বা হবে সে অজরামর? কর্মে জন্ম, নাকি সে জন্মে কর্ম? সরহ বলেন, বড়ই ঘোরালো ধর্ম! চর্যা-২৩ ভুসুকু ভুসুকু, তুমি শিকারে গেলে, মারবে পাঁচ জনে, একাগ্রতা নিয়ে তখন যেয়ো পদ্মবনে।

বিহানে যারা জিন্দা, রাতে তারা মৃত্যুলোকে, শিকার-বিনা মাংস পেতে ভুসুকু বনে ঢোকে। মায়াজালের ফাঁদেই মায়া-হরিণ পড়ে মারা– তারাই বোঝে, সদ্গুরুকে জিগেশ করে যারা। চর্যা-২৬ শান্তি তুলা ধুনে ধুনে পাওয়া গেল আঁশ, আঁশ ধুনে ধুনে আর কিছু নেই, বোঝা তো গেল না কী যে হেতু তার– শান্তি বলেন–ভাবো যেভাবেই। তুলা ধুনে ধুনে খেলাম শূন্যতাকে, পরে তো হলাম শূন্য নিজেই। কাদা-ভরা পথ, দু’বার যায় না দেখা, চুলেরও ঢোকার সামর্থ্য নেই।

কার্য কারণ কিছু নয়, কিছু নয়, স্বয়ং-সংবেদন এ, শান্তি কয়। চর্যা-২৭ ভুসুকু আধেক রাতভর পদ্ম ফোটে রাশি-রাশি, হ’ল রে বত্রিশ যোগিনী-দেহ উল্লাসী। চাঁদটা পার হ’য়ে যায় রে অবধূতি-সেতু, রত্ন গুণে হয় সহজ চির-প্রকাশিত। নির্বাণের খালে চালানো হ’ল শশধরে, মৃণালে সরোবর পদ্ম যেরকম ধরে। বিরমানন্দ যে বিলক্ষণ পরিশুদ্ধ যে বোঝে এইখানে, কেবল সে-ই হয় বুদ্ধ।

ভুসুকু বলে তবে, পেয়েছি তার সাথে মিলে সহজানন্দের নিত্য মহাসুখ-লীলে! চর্যা-২৮ শবর উঁচু পর্বতে বাস করে এক শবরী বালা, ময়ূরপুচ্ছ পরনে, গলায় গুঞ্জামালা। মত্ত শবর, পাগল শবর, কোরো না গোল, সহজিয়া এই ঘরনিকে নিয়ে দুঃখ ভোল্। নানা গাছপালা, ডালপালা ঠ্যাকে আকাশ-তলে; একেলা শবরী কুণ্ডলধারী বনস্থলে। ত্রিধাতুর খাটে শবর-ভুজগ শেজ বিছায়, নৈরামনির কণ্ঠ জড়িয়ে রাত পোহায়, কর্পূরযোগে হৃৎ-তাম্বূল চিবায় সুখে, আত্মাহীনার আসঙ্গ তার মত্ত বুকে– গুরুবাক্যের ধনুকের তিরে আপন মন গেঁথে ফেলে লভো পরিনির্বাণ, পরম ধন। কোথায় লুকালে, শবর আমার, অন্ধকারে? খুঁজব তোমাকে কোন্ গিরিখাতে, কোন্ পাহাড়ে? চর্যা-২৯ লুই ভাব-ও হয় না, না-যায় অভাবও, এমন তত্ত্বে কী-বা জ্ঞান পাব? লুই বলে, বোঝা ভীষণ কষ্ট, ত্রিধাতু-বিলাসে হয় না স্পষ্ট।

যা-কিছু অরূপ, যা অতীন্দ্রিয় আগম-বেদে কি তা ব্যাখ্যনীয়? কী জবাব দেব–জলে বিম্বিত চাঁদ সে সত্য, নাকি কল্পিত? লুই বলে, কোনো কিছু নাই জানা, কই আছি, নাই তারই যে ঠিকানা। চর্যা-৩০ ভুসুকু করুণার কালো মেঘ নিরন্তর ফুঁড়ে ভাব-অভাবের দ্বন্দ্ব যায় ভেঙেচুরে। আকাশে উদিত এক অতি-অপরুপ! দ্যাখো রে, ভুসুকু, তার সহজ স্বরূপ। ইন্দ্রিয়ের জাল টুটে যাবে, জানো যদি,– মনের গহনে পাবে উল্লাসের নদী। আনন্দ লভেছি বুঝে বিষয়-বিশুদ্ধি, চাঁদের আলোর মতো বিকশিত বুদ্ধি; এ-আলোকই ত্রিলোকের একমাত্র সার– কেটে গেছে ভুসুকুর মনের আঁধার।

চর্যা-৩১ আর্যদেব কী জানি কেমন ঘরে ঢুকলুম, ইন্দ্রিয়-মন হ’য়ে গেল গুম। করুণা-ডমরু শুধু বেজে যায়, আর্যদেবের ঠাঁই নিরালায়। অসংবেদনে ট’লে ঢোকে মন চন্দ্রকান্তি চন্দ্রে যেমন– দূর ক’রে ভয়, ঘৃণা, লোকাচার চেয়ে চেয়ে দেখি শূন্য-বিকার। ছেড়ে দিয়ে লোকলজ্জা সকল আর্যদেবের সকলই বিকল। চর্যা-৩২ সরহ নাদ নয়, আর বিন্দুও না, সূর্য-চন্দ্র নয়, চিত্তরাজা স্বস্বভাবে বাঁধন-মুক্ত হয়।

সোজা পথটা সামনে রেখে ধরিস না পথ বাঁকা, লঙ্কা যা’স না, এই তো বোধি, নিজের মধ্যে ঢাকা! আয়না নে’য়ার দরকার নাই কাঁকন-পরা হাতে, নিজের মন না-বুঝলে নিজে, কী আর হবে তাতে? ওগো যোগী, যাবে যদি ভবনদীর পার, দুর্জনেরে সঙ্গে নিলে পার পাবে না আর। ডাইনে-বাঁয়ে ভ’রে আছে নালা ডোবা খাল, সরহ কয়, বাপু, তোমার সোজা রেখো হাল। চর্যা-৩৩ ঢেণ্ঢন টোলায় আমার ঘর, প্রতিবেশী নাই; অন্নহীন, নাই তবু ইষ্টির কামাই! ব্যাঙ কি কামড় মারে সাপের শরীরে? অথবা দোয়ানো দুধ বাঁটে যায় ফিরে? বলদে বিয়ায় আর গাভি হয় বন্ধ্যা, পিঁড়ায় দোয়ানো হয় তাকে তিন সন্ধ্যা– যে জ্ঞানী সবার চেয়ে, অজ্ঞান সে ঘোর; সবার চেয়ে যে সাধু, সেই ব্যাটা চোর! শিয়াল-সিংহের যুদ্ধ চলে অনুক্ষণ– লোকেরা বোঝে না, তাও বলেন ঢেণ্ঢন। চর্যা-৩৪ দারিক শূন্য-করুণা, কায়-বাক্-চিৎ, এই অভিন্নাচারে বিলাসে দারিক মত্ত হলেন আকাশের পরপারে। অলক্ষ্যকেই বিলোকন ক’রে, মহাসুখ-অভিসারে বিলাসে দারিক মত্ত হলেন আকাশের পরপারে।

কী তোর মন্ত্রে, কী তোর তন্ত্রে, কী ধ্যান-ব্যাখ্যানেই? অপ্রতিষ্ঠ মহাসুখ যদি, নির্বাণ তবে নেই। দুঃখ ও সুখ সম জ্ঞান ক’রে, ইন্দ্রিয়-উপভোগ, আপন-পরের ভেদ ভুলে যেতে, দারিক করেন যোগ। রাজা রাজা রাজা, আছে যত রাজা, সবাই ফক্কিকার– দ্বাদশ দেশের রাজা এ-দারিক, লুইপাদ গুরু যার। চর্যা-৩৫ ভদ্র এতকাল আমি ছিলাম অন্ধ স্বমোহাবেশে, সদ্গুরু রোগ সারিয়ে দিলেন সদুপদেশে। এতকাল মন নিমগ্ন ছিল মনের তলে, আকাশ যেমন ঢ’লে প’ড়ে যায় সাগরজলে।

দশ দিকে ছিল মহাশূন্যের মহা-আঁধার, এ-মনে ছিল না পাপপুণ্যের কোনো বাধা। বজ্র আমাকে খাওয়াল সে শেষে মোক্ষফল, মহাতৃপ্তিতে পান করলাম আকাশজল– ভাদে বলে, আমি ভাগ্যকে দিয়ে জলাঞ্জলি নিজ মন খেয়ে, সুখদুঃখের ঊর্ধ্বে চলি। চর্যা-৩৬ কানু তথতার মারে শূন্য বাসনা-আগার, উজাড় করেছি সব মোহের ভাঁড়ার; বেঘোর সহজ নিদে উলঙ্গ কানাই, এই ঘুমে আত্ম-পর ভেদাভেদ নাই, চেতনা-বেদনা নাই–খুলে আবরণ সুখময় ঘুমে কানু হ’ল অচেতন। স্বপনে হেরিনু আমি, শূন্য ত্রিভুবন গমনাগমনহীন ঘানির মতন– সাক্ষী জালন্ধরীপাদ–কারণ, আমায় পণ্ডিতে চেনে না পাশমুক্ত অবস্থায়। চর্যা-৩৭ তাড়ক আমিই যদি আমাতে নেই, কীসের তবে ভয়? মহামুদ্রা লাভের আশা আমার জন্য নয়।

সহজেরে বোঝ্ রে, যোগী, ভুলিস না রে ভবী, চতুষ্কোটি মুক্ত যেমন, তেম্নি মুক্ত হবি। যেরকম ইচ্ছা হবে সেরকমই থাকো, সহজিয়া পথটাকে ভুলে যেয়ো না কো; মেঢ্র ও অণ্ডের ক্রিয়া জাহের, সাঁতারে, বাতেনি যা, বুঝি কোন্ তরিকায় তারে? তাড়ক বলেন, বড় গুরু সমস্যাটা, যারা বোঝে, তাদের গলায় ফাঁস আঁটা। চর্যা-৩৮ সরহ দেহরূপ নায়ে বৈঠা মন, হাল ধরো সদ্গুরুর বচন, মন স্থির ক’রে ব’সো গো নায়ে, পারে যাওয়া নাই অন্য উপায়ে। সহজে নৌকা গুণ টেনে নাও, হে মাঝি, যেয়ো না আর-কোথাও। পথে পথে আছে ডাকাতের ভয়, ভব-দরিয়ার ঢেউয়ে, বিলয়।

কূল ধ’রে, স্রোতে বাইলে উজানে নৌকা ঢুকবে সোজা আসমানে। চর্যা-৩৯ সরহ মন রে, আমার স্বপ্নেও তুই হায় আপন দোষে আছিস অবিদ্যায়! মন, কী ক’রে আর গুরুবচন– বিহারে তুই করবি পর্যটন? গগনকোণে আজব হুহুঙ্কার– বঙ্গে জায়া নিয়ে গেলি, আর বিজ্ঞান তোর হ’ল যে মিসমার! অদ্ভুত এই ভবের মোহে, মন, পরকেও তুই দেখিস রে আপন– জগৎ যেন জলের মুকুর, আত্মা সহজে হয় শূন্য ও লাপাত্তা। চিত্ত আমার, নিত্য পরবশ, বিষ গিলেছিস ফেলে সুধারস। ঘরে-বাইরে কে আছে কে জানে, দুষ্ট কুটুম দুঃখ শুধু হানে, ইচ্ছা লাগে মারতে তাদের প্রাণে– দুষ্ট বলদ থাকার চেয়ে তবে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো হবে! একলা থাকি সুখে ও স্বচ্ছন্দে, জগৎ দূরে যাক–সরহ বন্দে। চর্যা-৪০ কানু মনোগোচর যা, তা-ই ধোঁকা, আগমপুথি, তসবিমালা।

অতীন্দ্রিয় সহজ আমি ব্যাখ্যা করি কোন্ ভাষাতে? বৃথাই, গুরু, শিষ্যটিকে মাথামুণ্ডু চাও বোঝাতে, কথায় বাড়ে প্রমাদ শুধু– গুরু সে বোবা, শিষ্য কালা! কানু বলেন, সহজ এই: বোবায় বোঝে, বললে কালা। চর্যা-৪১ ভুসুকু এ-জগৎ অনুৎপন্ন আদিতে, ভ্রান্তিতে প্রতিভাত। রজ্জুকে যে সর্প ভাবে তাকে কি কামড়ায় চন্দ্রবোড়া? অদ্ভুত হে যোগী, মিছা কোরো না তোমার হাত নোনা, বাসনা টুটবেই, যদি জগতের রীতি বুঝতে পারো। যেন, মরু-মরীচিকা, গন্ধর্বনগরী, মুকুরের প্রতিবিম্ব, বাত্যাবর্তে ঘন হ’য়ে শিল-হওয়া জল, যেন বহুবিধ খেলা খেলে চলে বন্ধ্যার দুলাল– খেলে খরগোশের শিং, বালুতেল, আকাশকুসুমে– রাজপুত্র ভুসুকুপা বলে, সব এরকমই বটে, গুরুর শরণ নাও, যে এখনও আছো ভ্রান্ত পথে। চর্যা-৪২ কানু শূন্যে পূর্ণ চিত্ত সহজে, কাঁধ ভেঙে গেলে দুঃখ নেই; কানু ম’রে গেছে, তোমরা কহ যে– সে আছে ত্রিলোকে সবখানেই।

দৃশ্যলোপে যে বুক-দুরুদুরু, ঢেউ কি কখনও শোষে সাগর? দেখে না চক্ষু-বিহীন মূঢ় দুধে-মিশে-থাকা দুধের সর। আসে না যায় না কেউ এ-ঠাঁই, এই বুঝে কানু আছে তোফাই। চর্যা-৪৩ ভুসুকু ফোটে সহজিয়া মহাতরু ত্রৈলোক্যে। শূন্য-স্বভাবে বন্ধনহীন নয় কে? সমরসে মনোরত্ন আকাশে মেশে, পানিতে যেমন পানি মেশে নিঃশেষে। পর নাই তার, যার কেউ নাই আপনা; জন্ম হয় নি যার, সে কখনও মরে না।

ভুসুকু বলেন, প্রকৃতির রীতি এই: আনাগোনা আর ভাবাভাবে স্থিতি নেই। চর্যা-৪৪ কঙ্কণ শূন্যে শূন্য মিললে তবে সকল ধর্ম উদিত হবে। অনুখন আছি এ-সংবোধে: বোধির বিততি মাঝ-নিরোধে। বিন্দু-নাদ না-ঢোকে হিয়ায়, একটি চাইলে আরটি যায়! কোত্থেকে এলে, সেইটে জানো, মাঝখানে থেকে আঘাত হানো। ভনে কলকল কাঁকনপাদে, সবকিছু বুঁদ তথতা-নাদে।

চর্যা-৪৫ কানু পঞ্চেন্দ্রিয় শাখা মন-তরুটাতে, আশারূপ ফল পাতা শোভা পায় তাতে। সদ্গুরু কাটে তরু বচন-কুড়ালে; কানু বলে, এ-জীবন পাবে না, ফুরালে। সেই তরু বাড়ে পাপপুণ্যের জলে, বিদ্বান্ কাটে তারে গুরু-কৃপা-বলে। তরুটার ছেদ-ভেদ না-জানে যে-বোকা পৃথিবী সত্য ভেবে খায় সে যে ধোঁকা। শূন্য সে-তরুবর, আকাশ কুড়াল– শিকড়ে বসাও কোপ, ছেঁটো না রে ডাল।

চর্যা-৪৬ জয়নন্দী স্বপ্ন যেমন বহু অদেখা দেখায় অন্তরে সংসার তেম্নি যে হায়! শেষ হ’লে হৃদয়ের মোহজাল বোনা থেমে যায় মন-পথে যত আনাগোনা। না সে পোড়ে, না সে ভেজে, ছিঁড়েও না মন, দ্যাখো মায়া-মোহে তার দৃঢ় বন্ধন। ছায়া-মায়া-কায়া এরা সমান সবাই, নানা শোভা ধরে তার উভয় পাখাই। তথতা-সাধনে করো শুদ্ধ হৃদয়, আর পথ নাই–জয়নন্দী ভনয়। চর্যা-৪৭ ধর্ম কমল-কুলিশ মাঝে হলাম মিলিত, চণ্ডালী সমতা-যোগে হ’ল প্রজ্বলিত।

ডোমনির কুঁড়েঘরে আগুন লেগেছে, আগুন নেবাই চাঁদ দিয়ে পানি সেচে। জ্বালা খুব তেজি, তবু কোনো ধোঁয়া নেই, মেরুশীর্ষ নিয়ে পশে সোজা গগনেই। পোড়ে ব্রহ্মা, হরিহর, পুড়ে হয় মুক্ত তামার শাসনপট্ট, নবগুণযুক্ত। ধামপাদ বলে, আজ সব স্পষ্ট জানি, পঞ্চনালে উঠে গেল নির্বাণের পানি। চর্যা-৪৯ ভুসুকু বজ্রনৌকা বেয়ে পাড়ি দেই পদ্মা খাল, দেশ লুট ক’রে নিল অদয় বঙ্গাল।

ভুসুকু, বাঙালি হলি আজ থেকে ওরে, নিজের ঘরনি গেল চাঁড়ালের ঘরে। জানি না কোথায় ঢুকে মন হ’ল ভ্রষ্ট, জ্বলন্ত পঞ্চপাটন, ইন্দ্রিয় বিনষ্ট। সোনা-রুপা কিছু আর রইল না বাকি, নিজ পরিবারে তবু মহাসুখে থাকি– নিঃশেষ হয়েছে যদি চৌকোটি ভাঁড়ার জীবন-মরণে নাই প্রভেদ আমার। চর্যা-৫০ শবর গগনে তৃতীয় বাড়ি, হৃদয়ে কুঠার, কণ্ঠলগ্না রমণীয়া নৈরামনি নারী– শবর শূন্যতা-সঙ্গে সুখে আছে ভারি ঝেড়ে ফেলে মায়া-মোহ-দ্বন্দ্ব-দুঃখ-ভার। মহাশূন্যোপম অই বাড়িটির পাশে ফুটেছে সুন্দর কত কার্পাসের ফুল, এলিয়ে দিয়েছে চাঁদ জোছনার চুল, আকাশকুসুম যেন ফুটেছে আকাশে।

খেতে খেতে পেকে ওঠে চিনা ও কাউন শবরী শবর মাতে, ভুলে যায় সব; চার-বাঁশের চেঁচাড়িতে শবরের শব দাহ করা হয়–কাঁদে শিয়াল-শকুন। দশ দিশে পিণ্ড পায় মৃত ভবমত্ত, শবর নির্বাণ লভে, যায় শবরত্ব। http://arts.bdnews24.com/?p=1234 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।