আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কলম্বাসের আমেরিকা 'আবিষ্কার' এবং বর্ষ ৫০১ - আনু মুহাম্মদ

__

প্রবন্ধটি আনু মুহাম্মদের "কলম্বাসের আমেরিকা 'আবিষ্কার' এবং বহুজাতিক মানুষেরা শীর্ষক প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থ হতে নেয়া। বইটা এবারের মেলা থেকে সংগ্রহ করে পড়ার পর মনে হল আরো চার পাঁচজন মানুষকে পড়াই। স্ক্যান করে দেয়া যেত তবে ওতে মন্তব্য প্রতি মন্তব্যের সুযোগ থাকে না। বইটির কপিরাইট থাকাই স্বাভাবিক। কিনে পড়ে ফেলতে পারেন দাম মাত্র পঁয়ষট্টি টাকা মাত্র।

( জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন )

-----------------------------------------

এ বছর বোস্টন থেকে নোয়াম চমস্কির যে বইটি প্রকাশিত হয়েছে তার নাম 'বর্ষ ৫০১: অব্যাহত বিজয়াভিযান', (ইয়ার ৫০১: দ্য কনকোয়েস্ট কনটিনিউজ)। চমস্কি, প্রখ্যাত ভাষা তাত্ত্বিক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বর্ষগণনা করেছেন আরেকভাবে। বর্ষের শুরু ১১ অক্টোবর ১৪৯২। সে হিসেবে ৫০০ বছর পূর্তি হয়েছে গত বছর। ৫০১ বছর এখন চলছে।



বছরের এই হিসাব মার্কিন ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য, পূজিবাদের বিকাশ ধারা বিশ্লেষনের জন্য এ হিসাবের মধ্যে যেতেই হবে। আমাদের এই অঞ্চলের জন্যও এই হিসাব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা যে 'বিজয়' শুরু হয়েছিল ১৪৯২ সালে তা চমস্কির ভাষায় এখনও অব্যাহত আছে এবং সেই অব্যাহত বিজয়ের ক্ষেত্র সমগ্র বিশ্ব।

বর্ষ শুরু কলম্বাসের আমেরিকা 'আবিষ্কার'-এর মুহুর্ত থেকে। যে কোন মনোযোগী ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞানী বলবেন যে, ইউরোপের আমেরিকা আবিষ্কার, ঠিক কথায়, ইউরোপের আমেরিকা দখল ইউরোপকে পুরো বিশ্বের উপর কতৃর্ত্ব বিস্তারের পথ খুলে দিয়েছিল।



এ্যাডাম স্মীথ এর ভাষায়," আমেরিকা আবিষ্কার ও উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে পূর্ব ভারতের পথ সন্ধান লাভ-মানব জাতির ইতিহাসে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও মহত্তম দুটি ঘটনা। ...ইউরোপের জন্য নতুন ও বিশাল বাজার এবং বিশাল সম্পদ লাভ উৎপাদিকা শক্তির বিপুল বিকশের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। "

ওয়াশিংটনে মার্কিন ইতিহাসের উপর যে মিউজিয়ামিটি আছে সেখানে কলম্বাসের এই যাত্রা ও দখল সম্পর্কে আলাদাভাবে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা আছে, আছে তথ্য-চিত্র ইত্যাদি। সেখানে এই থ্যো দেয়া আছে যে, পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই চীনারা সমদ্র বাণিজ্যে আধিপত্য স্থাপন করেছিল এবং ১৪৪০-৫০ - এর দিকে চীনা বণিক ও নাবিকেরা নতুন অঞ্চল সন্ধানের যে পরিকল্পনা করেছিল তার মাধ্যমে তাদের আমেরিকায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা উজ্জ্বল ছিল। তা হলে সেটা ঘটতো আরও ৫০ বছর আগে।

তাদের জাহাজ ও অন্যান্য প্রস্তুতিও ছিল উন্নত মানের। কিন্তু এই সম্ভাবনার মুখেই চীনা সম্রাট সমদ্রে বাণিজ্য ও নতুন অঞ্চল সন্ধানের যাবতীয় প্রচেষ্টার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

তার ফলে এই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। উপসংহার টানা হয়েছে এভাবে যে, সেদিন এই নিষেধাজ্ঞা জারি না হলে আমেরিকা ইউরোপের উপনিবেশ না হয়ে এশিয়ার উপনিবেশ হত এবং বিশ্ব ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে অগ্রসর হতে পারতো।

যুক্তরাষ্ট্র ‘আবিষ্কৃত’ আমেরিকা নয়

ইউরোপ বা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার কথাটা আপাতঃদৃষ্টিতে নিরীহ।

যেরকমভাবে এই বিষয়টি এতদিন পর্যন্ত উপস্থাপন করা হয়েছে তাও প্রায় সকলেই নির্দোষ ধরে নিয়েছিলেন। শিক্ষিত ও সভ্য ইউরোপ আবিষ্কার করেছে অসভ্য মানুষ অধ্যুষিত এক বিশাল অঞ্চলকে তাদেরকে সভ্যতা শিখিয়েছে, মূল পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে-এটাই ছিল প্রচলিত ব্যাখ্যা। গত বছর আমেরিকা “আবিষ্কার” এর ৫০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মার্কিন প্রশাশন থেকে তার জন্য উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রচলিত ব্যাখ্যার প্রতি চ্যালেঞ্জ উত্থাপিত হয়েছে মার্কিন মুল্লুকেই, এই চ্যালেঞ্জ যে শুধু আদি আমেরিকান বা অ-ইউরোপীয় শেকড় থেকে আগত জনগোষ্ঠীই করছেন তাই নয়, মূল ধারা থেকে মতাদর্শিকভাবে বিচ্ছিন্ন আলোকপ্রাপ্ত ইউরোপীয় শেকড়ের ব্যক্তিবর্গও করছেন। অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে অনেক ধামাচাপা পড়া ইতিহাস প্রকাশীত হয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে, কে কাকে সভ্য করে-কে কাকে আবিষ্কার করে?

যে সময় কলম্বাস আমেরিকাকে ইউরোপীয় বাণিজ্য নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করেন সে সময় ইউরোপের নেতৃত্ব দিচ্ছিল স্পেন ও পর্তুগাল। সেখানেও বিভিন্নরকম সংঘাত জটিলতা সে সময় দানা বাঁধছিল। স্পেন ও পর্তুগাল আমেরিকা, আফ্রিকা ও ভারতকে ইউরোপীয় বণিকদের কাছে উপস্থিত করলেও স্পেন অ পর্তুগালের নেতৃস্থানীয় অবস্থান বেশিদিন থাকেনি। এরপর হল্যাণ্ড তাদের স্থান দখল করে। ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে এরপর পূর্ণ বিকশিত রূপ পায় ‘গ্রেট’ বৃটেন।

এবং এক পর্যায়ে আমেরিকা ‘আবিষ্কার’-এর প্রায় সাড়ে ৪’শ বছর পর বিশ্বের প্রধান শক্তি হিসেবে উপস্থিত হয় আমেরিকার সবচাইতে বিকশিত অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এই যুক্তরাষ্ট্র ৫০০ বছর আগের আমেরিকার উত্তরসূরী নয়, এটি ইউরোপের উত্তরসূরী। ইউরোপেরই সম্প্রসারণ।

সব আগ্রাসনই আবিষ্কার, সব হত্যাকাণ্ডই সভ্যতা!


কলম্বাসের আমেরিকায় পৌঁছানোর সময়ে আদি আমেরিকান্দের যেসব অঞ্চলে সে সময়কার উন্নত সভ্যতা বিদ্যমান ছিল সেগুলো হল আন্দেজ-এর ‘ইনকা,’ গুয়াতেমালার ‘মায়া,’ মধ্য মেক্সিকোর ‘আজটেক’। বলাই বাহুল্য যে, এসব সভ্যতা ইউরোপ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠেছিল ও বিকশিত হয়েছিল।

কৃষি উৎপাদন, বস্ত্র উৎপাদন ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান পশ্চাৎপদ ছিল না। উদ্ভিদ-এর চারশত প্রজাতি তখন তাদের জানা ছিল যেগুলো সে সময়কার এশিয়া বা ইউরোপে জানা ছিল না। উন্নয়নের মধ্য দিয়ে অনেক ভ্রাম্যমাণ-যাযাবর গোষ্ঠী ধীরে ধীরে স্থায়ী বসতি গাড়তে শুরু করে এবং সভ্যতা গড়ে উঠতে থাকে। হস্তশিল্প, বস্ত্রশীল্প, মৃতশিল্প এর মহ্য দিয়ে বিকশীত হয়। ঐতিহাসিকদের মতে ‘মায়া’দের মধ্যে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান ছিল অধিকতর উন্নত।

ইউরোপীয় বা এশীয়দের মতো তাদের গৃহপালিত পশুর মধ্যে ঘোড়া, গরু, শুয়োর ছিল না। তাদের ছিল কুকুর, টার্কি এবং গিনিপিগ। তাদের জানা ছিল না লোহার ব্যবহার এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ যে তাদের ছিল না আগ্নেয়াস্ত্র ঘোড়া এবং আগ্নেয়াস্ত্র ইউরোপীয়দের বিজয় সুনিশ্চিত করবার অন্যতম অবলম্বন ছিল।

কলম্বাস প্রথমে যেখানে নামেন তা পুরনো ঐতিহাসিকদের কাছে পরিচিত ছিল ‘হিস্পানিওয়ালা’ নামে, এখন যা ‘হাইতি’ এবং ডোমিনিক্যান প্রজাতন্ত্র’ নামে পরিচিত। ১৫৫২ সালে ডি লাস কেসাস নামে একজন স্পেনীয় “ব্রিফ একাউন্ট অব দ্য ডেস্ট্রাকশন অব ইন্ডিজ” নামে যে পুস্তিকা প্রকাশ করেন তার সূত্র ধরে একজন আদি আমেরিকান হ্যান কলিং ইতিহাসের পুনর্লিখনে সচেষ্ট হয়েছেন এখন।

কেসাস লিখেছিলেন, “স্পেনীয়রা এই ভুখন্ডে নামার সঙ্গে সঙ্গে যেরকম বন্যজন্তুর মত নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার পরিচয় দিয়েছিল তার সঙ্গে আদিবাসীদের কোন পূর্ব পরিচয় হিল না। “

হ্যান কলিং আরও জানাচ্ছেন, কলম্বাস ইউরোপে স্বর্ণ পাহাড় নিয়ে যাবার প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়ে তিনি এবং তার উত্তরসূরীরা একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন। ১৪৯৩ থেক ১৫০০ সালের মধ্যে হিস্পানীওয়ালা জনসংখ্যা অরধেক হয়ে যায়। শুধু এই অঞ্চলে ওই সময়ে নিহত শিশু, বয়স্ক, নারী, পুরুষ মিলে মতান্তরে দেড় লাখ থেকে ৫ লাখ দাঁড়ায়।

দ্বীপের জনসংখ্যা মোটামুটি শেষ করার পর অন্যান্য দ্বীপে অভিযান চালানো হয়। যেগুলোর মধ্যে প্রথমে আসে কিউবা, জ্যামাইকা এবং সান জুয়ান (পরে যার নাম হয়েছে পুয়ের্টোরিকো)। হত্যাকাণ্ড এবং দাস সংগ্রহ এক সঙ্গে চলতে থাকে। এক পর্যায়ে ম্যাচাচুচেটস উপত্যকার গবর্ণরের কাছে প্রতি একজন পুরুষের মাথার জন্য ৪০ পাউণ্ড এবং নারীর মাথার জন্য ২০ পাউণ্ড পাওয়া যেতো। এছাড়া ইউরোপীয়দের আনা, আদি আমেরিকানদের অজানা, বসন্ত, যক্ষা ও সিফিলিস রোগে-মহামারীতে বহু মানুষ মরেছেন।



ইউরোপীয় ‘সভ্যতা’ আমেরিকা ‘আবিষ্কার’ করেই ক্ষান্ত হয়নি। সেখানকার জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ প্রাচীন সমৃদ্ধ সভ্যতা ধ্বংস, মানুষকে হত্যা কিংবা দাসে পরিণত করেছে। একজন মার্কিন ছাত্র সঠিকভাবেই সাম্প্রতিক উপসাগরীয় যুদ্ধ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেনঃ “এই ঘটনা কলম্বাসের আবিষ্কারেরই ধারাবাহিকতা। এদের কাছে সব আগ্রাসনই আবিষ্কার। সব হত্যাকাণ্ডই সভ্যতা।



নিউইয়র্কে প্রাকৃতিক ইতিহাস মিউজিয়ামে একটি ছবি আছে, বেশ বড় করেবাঁধানো। ম্যানহাটনে আটলাণ্টিকের ধারে একজন ইউরোপীয় ক্যাপ্টেন দাঁড়ানো, দূরে আটলান্টিকের তীরে জাহাজ নোঙ্গর করা, মালামাল নামাচ্ছে আদি আমেরিকানেরা, প্রায় উলঙ্গ নারী-পুরুষ। স্থানে স্থানে সৈনিক অস্ত্র হাতে। ক্যাপ্টেনের পেছনে একটি দূর্গের ছবি। একজন আদি আমেরিকান, সর্দার ধরনের, হাত জোড় করে তাকে কর দিচ্ছে।

সশস্ত্র সৈনিকদের নিরস্ত্র জনগণের উপর বিজয়ের এই ছবি সৃষ্টি করা হয়েছে ১৪৯২- এর বেশ কিছু বছর পর, যে ছবিকে মিউজিয়াম রাখা হয়েছে “শান্তি প্রতিষ্ঠার” একটি স্মারক হিসেবে।

---------

( কপিরাইট জনিত কারণে পুরো লেখাটি দেয়া হলো না। আপত্তি আসা মাত্র আমি লেখাটি মুছে দেবো)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।