উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমি হিসেবে খ্যাত নওগাঁর ধামইরহাট প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন এক শালবন। বিশাল এ শালবনটি ৬৫২ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। প্রকৃতির অপূর্ব নিদর্শন আর চিরসবুজের চোখজুড়ানো নজরকাড়া সৌন্দর্য যুগের পর যুগ অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছে এ শালবনটি। মন জয় করা এ শালবনে প্রাণ জুড়াতে আসে দূরদূরান্তের অনেক পর্যটক। এ শালবন ঘিরে লুকিয়ে আছে পর্যটন ক্ষেত্রের বিশাল সম্ভাবনা।
শালবনটি ২০১১ সালে সরকার জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে।
বনের পথ যেখানে শেষ সেখানেই ভারত সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। কাছাকাছি সীমান্তের পিলার। বেড়ার ওপারে দেখা যায় ভারতীয়দের কৃষিকর্ম আর বিএসএফের টহল। এ বনের অন্যতম আকর্ষণ শাল গাছ জড়িয়ে উঠে গেছে হিংলো লতা, অনন্তমূল ও বনবরইসহ নানা লতাগুল্ম আর বনফুল।
বনে প্রবেশ করতেই নাকে আসে নাম না জানা বিভিন্ন বনফুলের মিষ্টি গন্ধ। আর মাঝেমধ্যে আছে ঘন বেতবন। বেত গাছের সবুজ চকচকে চিকন পাতায় চোখ জুড়িয়ে আসে। এ বনে আছে সাপ, শিয়াল, খরগোশ, বনবিড়াল, বনরুই ও বেজিসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশু আর পাখি। পাখির কলতানে মুখরিত পুরো শালবন।
নওগাঁ শহরের বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে ৬০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে যেতে হবে ধামইরহাট উপজেলা সদরে। পথে পড়বে মহাদেবপুর, পত্নীতলা উপজেলার সদর। ধামইরহাট থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার পথ পেরোলেই দেখা মিলবে প্রকৃতির আপন খেয়ালে সাজানো নয়নাভিরাম প্রাচীন শালবনটি। ৬ কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে লাল মাটির রাঙাপথ। দূরে থেকেই নজরে পড়বে শালবনটি।
বনের দিকে যতই এগিয়ে যাবেন ততই অনুভূতি হবে রোমাঞ্চকর। পথের ধারে ছোট ছোট বসতবাড়ি, যেগুলোয় আদিবাসীদের বাস। চোখে পড়বে বরেন্দ্রভূমির চারদিকে শুধু উঁচু উঁচু শাল গাছ। ভারত সীমান্তঘেঁষা এ শালবনটি যেন প্রকৃতির গোপন রহস্যে ভরা। এ বনভূমি সরকারের রিজার্ভ ল্যান্ড ফরেস্ট হিসেবে সংরক্ষিত।
প্রাকৃতিক এ বনভূমির মাঝে নেই কোনো কৃত্রিমতা। ধামইরহাট উপজেলার মশইর মৌজার বিশাল শালবনটি সত্যিই অবাক করার মতো।
কথিত আছে- পাল যুগে পালবংশের কোনো এক রানী শালবনটি দেখতে এসেছিলেন। রানীকে কাছে পেয়ে সেখানকার প্রজারা তাদের জলকষ্টের কথা জানায়। কোমলপ্রাণ রানী প্রজাদের কষ্টে ব্যথিত হয়ে সেখানে একটি বিশাল দিঘি খনন করেন এবং এর নামকরণ করেন আলতাদিঘি।
দিঘিটি ৪২.৮১ একর জমিজুড়ে। আরও কথিত আছে- একসময় শালবনটির মালিক ছিলেন কলকাতার পাথরঘাটার জমিদার অত্যানন্দ ঠাকুর। তিনি হঠাৎ অন্ধ হয়ে যান। ফলে তার স্ত্রী অক্ষয়কুমারী দেবী জমিদারি পরিচালনা করতেন। উপজেলার আড়ানগরে তাদের কাছারিবাড়ি ছিল (বর্তমানে বাড়িটি তহশিল অফিস হিসেবে ব্যবহ্নত হচ্ছে)।
তিনি নিজে উপস্থিত থেকে প্রতি বছর ৩০ চৈত্র পরিপক্ব শাল গাছগুলো নিলামে বিক্রি করতেন। জমিদারের কর্মচারীরা আগেই গাছগুলো চিহ্নিত করে রাখতেন। দূরদূরান্ত থেকে কাঠ ব্যবসায়ীরা ওই নিলামে অংশ নিতেন। অক্ষয়কুমারীর উপস্থিতিতে ১৯৪৭ সালে শেষবারের মতো নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। এর পর থেকে আর সেখানে জমিদারের কেউ আসেননি।
বুনো পথ ধরে কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখা মিলবে শালবনের মাঝে বিশাল টলটলে জলের আলতাদিঘি। দিঘির এই প্রাকৃতিক বনভূমির চারপাশে ঝোপঝাড়। প্রকৃতি এখানে নিজ হাতে যেন সব কিছু সাজিয়েছে। তাই এখানে প্রতিদিনই আসে অনেক দূরের প্রকৃতিপ্রেমীরা। একনজর দেখতে কেউ বা পিকনিক করতে।
শালবনের মাঝে জায়গা করে নিয়ে বড় বড় ঢিবি গড়ে তুলেছে উইপোকা, যা নিজের চোখে দেখলেও কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না, তবে তা সত্য। লালচে রঙের এ ঢিবিগুলো প্রবল বর্ষণেও নষ্ট হয় না। উইপোকারা নির্বিঘ্নে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায় সারা বছর। শালবনে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সহযোগিতার জন্য ২৪ জন জনবল নিয়োজিত রয়েছে সর্বক্ষণ।
এটি পর্যটন কেন্দ্র না হলেও প্রতিদিনই মুখরিত হয় বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা দর্শনার্থীদের পদচারণে।
প্রকৃতির বনভূমি শালবনে কোনো বিশ্রামাগার না থাকলেও বনের উত্তর ধারে অনেকটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। যারা বেড়াতে আসেন তারা এ জায়গায় বসে নির্মল বাতাসে আরাম করেন। অনেকে সেখানেই রান্না করে খাবারের পর্ব সারেন। শালবনে গেলে চোখে পড়বে চারদিকে নিঝুমতা, নিস্তব্ধতা। দুই চোখে শুধুই সবুজ আর সবুজ।
কানে আসবে জানা-অজানা পাখির ডাক। বরেন্দ্রভূমির এই প্রকৃতির রাজ্যে যারা আসবেন তাদের মন ভরে উঠবে প্রকৃতির অকৃত্রিম ভালোবাসায়। সারাটা জীবন ক্ষণিকের এ স্মৃতি ডেকে ফিরবে বার বার। বেড়াতে আসা পর্যটক কায়েস উদ্দিন বলেন, এ স্থানটির কথা বহুবার শুনেছি কিন্তু আসা হয়নি। আজ এখানে এসে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না এত সুন্দর একটি শালবন রয়েছে।
আর মাঝখানের দিঘিটি শালবনের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করেছে। আরেক পর্যটক আবু মুসা স্বপন বলেন, শালবন উদ্যানটির আরও উন্নয়ন করা হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহ বাড়বে ও পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। সরকারের আয়ও বাড়বে। ধামইরহাট উপজেলার দায়িত্বে থাকা বন বিট কর্মকর্তা লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিক বলেন, শালবনের জাতীয় উদ্যানটির ১৭০ হেক্টর জমিতে এরই মধ্যে ৬৮ হাজার ঔষধি গাছ লাগানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বেতের বাগান করা হয়েছে।
এ উপজেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। প্রতিদিন এ শালবন উদ্যান দেখার জন্য শত শত লোক আসে এবং এখানে বনভোজনও করে। আশা করি খুব শীঘ্রই উপজেলার চেহারা পাল্টে যাবে এ উদ্যানের জন্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।