তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা
নামাজ পড়াচ্ছেন নবীজি। পেছনে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন সাহাবায়ে কেরাম। নবীজি তাদের সবার ইমাম। সবার কৌতুহলী দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে নবীজির দিকে। নবীজির কাঁধে একটি শিশু বালিকা।
আনমনে সে খেলছে ওখানে আপনমনে। তাকে কাঁধে নিয়েই নামাজ পড়াচ্ছেন দোজাহানের নবী মুহাম্মাদ সা.।
রুকুতে যাওয়ার আগে শিশুটিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে পাশে রাখলেন নবীজি। তারপর যথারীতি সিজদা করলেন। আবার যখন উঠে দাঁড়ালেন, শিশুটিকে তুলে আবার কাঁধে বসিয়ে দিলেন।
পুরো নামাজজুড়েই তিনি এমনটি করলেন।
শুধু কি নামাজে! নামাজের বাইরেও তিনি এই বালিকাকে চোখে চোখে রাখতেন। আদর ও স্নেহে কোলে তুলে রাখতেন। মমতার চুমো এঁকে দিতেন তার গালে, কপালে। হাত বুলিয়ে দিতেন মাথায়, জড়িয়ে রাখতেন গভীর ভালোবাসায়।
আশেপাশের সাহাবীগণ অবাক হয়ে ভাবেন, প্রিয়নবী শিশুটিকে কী ভালোটাই না বাসেন!
কে এই কন্যাবালিকা! যার জন্য নবীজির এতো মায়া, এতো ভালোবাসা!
এই বালিকার নাম উমামা। মায়ের নাম জয়নাব, বাবার নাম আবুল আস। এসব নামধামের চেয়েও তার আসল পরিচয়, এ মেয়েটি নবীজির প্রথম নাতনি। নবীজি তার নানা, হজরত খাদিজা তার নানি। পুরো নবীপরিবারের সবার কাছে সে সম্মানী, মদীনাবাসীর নয়নমণি।
হিজরি সনের অষ্টম বছরে জন্মগ্রহণ করেন উমামা। মা জয়নাব তখন খুব অসুস্থ, শয্যায় শায়িত। এ অসুখে ভুগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। এতিম হয়ে গেলেন শিশু উমামা। এক আকাশ স্নেহ ও ভালোবাসায় তাকে কোলে তুলে নিলেন নানা নবীজি মুহাম্মাদ।
সেই থেকে মা হারা এ কন্যা নবীজির নয়নমণি। নবীজি যেন তার মধ্যেই খুঁজে পেতেন কন্যা জয়নাবের মায়াবী প্রতিচ্ছবি।
একদিন হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশির পক্ষ থেকে কিছু উপহার এলো নবীজির কাছে। সেসবের মধ্যে একটি মূল্যবান হার ছিল। নবীজি সেটি হাতে নিয়ে দেখলেন।
কী চমৎকার সুন্দর! তিনি মুগ্ধ হয়ে বললেন, আমি এ হারটি আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে দেব। নবীজির স্ত্রীগণ তখন পরস্পরে বলাবলি করলেন, হজরত আবু বকরের বেটি আয়েশা ছাড়া এ হার আর কে পাবে! তিনিই তো নবীজির সবচেয়ে প্রিয় ভাগ্যবতী।
কিন্তু নবীজি হজরত আয়েশাকেও তা দিলেন না। অন্য কোনো স্ত্রীকেও দিলেন না। তিনি ডাকলেন, কোথায় আমার উমামা! চলে এসো মা! শিশু উমামা তখনও বাইরে খেলায় মত্ত।
নবীজি তাকে ডেকে এনে তার গলায় হারটি পরিয়ে দিলেন। এমনই আদর ও ভালোবাসায় উমামাকে বুকে জড়িয়ে নিতেন নবীজি সবসময়।
মা জয়নাবের মৃত্যুর পর হজরত জয়নাব তার খালার কাছে থাকতেন। নবীকন্যা হজরত ফাতেমা। উমামার অভিভাবক, উমামার খালা।
হৃদয়ের সবটুকু উত্তাপে হজরত ফাতেমা আগলে রাখতেন উমামাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও ভালো মানুষটি তার প্রিয় নানা, সবচেয়ে পবিত্র ও গুণবতী ফাতেমা তার মমতাময়ী খালা- এমন ভাগ্য ক’জনের!
হজরত উমামার বাবা আবুল আস ইবনে রবী তার এ কন্যার ব্যাপারে সজাগ সচেতন ছিলেন। হিজরি বারোতম বছরে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে উমামার ওলি বা অভিভাবক হিসেবে তারই খালাতো ভাই জুবায়ের বিন আওয়ামকে নির্ধারণ করে দেন।
হজরত ফাতেমার ইন্তেকালের পর হজরত আলী রা. উমামাকে বিয়ে করেন।
তাঁর বয়স তখন বিশ বছর। বাবার নির্ধারিত অভিভাবক হজরত জুবায়ের বিন আওয়াম এ বিয়ের আয়োজন করেন। হজরত আলীর জীবন এবং খেলাফতকালে যেসব কঠিন বিপদ ও দুঃসময় এসেছে, হজরত উমামা তখন স্বামীর পাশে ছিলেন শক্তি ও সাহসের উৎস হয়ে। হজরত আলী যখন জানতেন, যে কোনো সময় বিপক্ষের কারো হাতে তিনি আক্রান্ত হতে পারেন এবং মারাও যেতে পারেন। হজরত আলীর দু সন্তান হাসান এবং হোসাইন তাঁকে সম্মান ও সমীহ করতেন।
মা ফাতেমার মৃত্যুর পর তারা দু জন প্রায়ই তাঁর কাছে যেতেন এবং দেখা করে আসতেন।
তিনি আশঙ্কা করছিলেন, নবীজির পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য হজরত মুআবিয়া যে কোনো মূল্যে উমামাকে বিয়ে করতে প্রস্তাব পাঠাবেন। তাই তিনি একদিন ওসিয়ত করে বললেন, আমার মনে হচ্ছে, মুআবিয়া তোমার কাছে প্রস্তাব পাঠাবেন, তুমি আমার মৃত্যুর পর অন্য কারো স্ত্রী হতে চাইলে মুগিরা বিন নওফেলকে স্বামী হিসেবে বেছে নিও।
হজরত আলীর ইন্তেকালের পর সেই আশঙ্কা সত্য হলো। হজরত মুআবিয়া তৎকালের মদীনার গভর্নর মারওয়ান বিন হাকামের কাছে বার্তা পাঠালেন, তিনি যেন তার পক্ষ হয়ে নবীনাতনি হজরত উমামাকে বিয়ের পয়গাম পাঠান।
প্রয়োজনে তিনি তাঁকে এক লাখ দিনার মহর আদায় করবেন।
হজরত উমামা এ পয়গাম পেয়ে তৎপর হলেন। তিনি তখনই মুগিরা বিন নওফেলের কাছে খবর পাঠালেন, হজরত মুআবিয়া আমাকে প্রস্তাব দিয়েছেন। আপনি যদি আমাকে গ্রহণ করেন, তবে খুব শিগগিরই তা করে ফেলুন। হজরত মুগিরা তখনই সবকিছু ঠিক করলেন এবং বিয়ে সেরে ফেললেন।
হজরত মুগিরার স্ত্রী হিসেক্ষ বাকি জীবন কাটিয়ে দিলেন হজরত উমামা।
হজরত আলীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর উমামার গর্ভে একটি পুত্র জন্ম হয়েছিল। তার নাম ছিল আলী। শিশুটি মক্কা বিজয়ের দিন নবীজির পেছনে আরোহী হয়েছিল। শৈশব পার হওয়ার আগে সে চিরবিদায় নেয় পৃথিবী থেকে।
এরপর হজরত মুগিরার সংসারেও তাদের ঘর আলোকিত করেছিল নতুন অতিথি। শিশুটির নাম রাখা হয়েছিল ইয়াহইয়া। কিন্তু সেও বেশিদিন পৃথিবীর আলো দেখেনি।
তবে এ নিয়ে সীরাত লেখকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, হজরত উমামার কখনোই কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি।
বরং তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।
হজরত মুআবিয়ার শাসনামলে ইন্তেকাল করেন হজরত উমামা বিনতে আবুল আস। নবীপরিবারের একজন সৌভাগ্যবতীর বিদায়ে সেদিন কেঁদেছিল পৃথিবীর আকাশ বাতাস।
(উসদুল গাবাহ, আলইসাবাহ, সিয়ারু আ-লামিন নুবালা, আল-ইসতিআব)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।