আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দাদা, আপনি ছিলেন, কি বিপুল অস্তিত্ব নিয়ে আপনি ছিলেন!!

ছোট্ট ছেলেটাকে স্কুলে ভর্তি করা হবে। ছেলেটির মা তার শ্বশুর কে অনুরোধ করলেন তার উত্তরসূরির শিক্ষাজীবনের সুচনালগ্নের এই দায়িত্ব নিতে। বৃদ্ধ সানন্দে রাজি হলেন। তখন পর্যন্ত বৃদ্ধের তিন ছেলের ঘরে মোট সাত জন নাতি নাতনী। প্রকাশিত কোন আদিখ্যেতা না থাকলেও ছোট্ট ছেলের প্রতি মনের গভিরে কোন দুর্বলতার অস্তিত্ব হয়তো ভালভাবেই ছিল।

আগের কথায় ফিরে যাই। কুয়াশায় মোড়ানো সকালে দাদার হাতের আঙ্গুল ধরে গুটি গুটি পায়ে প্রথম বারের মত স্কুলে গেল ছেলেটি। এই একই স্কুলের ছাত্র ছিলেন বৃদ্ধ, তার দুই ছেলে। ভর্তির পর নাতিকে জিজ্ঞাসা করলেন কি খাবি? নাতির কোন উত্তর নাই। বৃদ্ধ নিজ উদ্যোগেই নিয়ে গেলেন কাছের এক হোটেলে।

কিনে দিলেন বিশাল সাইজের এক রসগোল্লা। পিচ্ছি নাতি সেই গোল্লা খেয়ে শেষ করতে পারলনা। দাদার মুখে মৃদু হাসি। বড় পবিত্র সেই মুখমণ্ডল, বড় পবিত্র সেই হাসি। চোখ বন্ধ করলে এখনও দেখতে পাই সেই পবিত্র মুখের মায়াময় হাসি।

যেই হাসি দেখা যাবেনা আর কখনও। বৃদ্ধ দাদা আমার চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আর কখনও দেখবনা সেই পবিত্র মুখ। ঘটনাটা প্রায় বিশ বছর আগের। সেই পিচ্ছি নাতি আজ তার শিক্ষা জীবনের শেষ প্রান্তে।

স্কুলে ভর্তি করে দাদা বলেছিলেন এ উপলক্ষে আমাকে একটি আংটি কিনে দিবেন। পরের শুক্রবারে আমাকে নিয়ে গেলেন শহরের সবচেয়ে নামকরা জুয়েলারির দোকানে। বললেন পছন্দ কর। সেই বয়সেও মনে হয় ভালই বিটুল ছিলাম। বেছে বেছে বিশাল সাইজের একটা আংটি পছন্দ করলাম।

দাদা জিজ্ঞেস করলেন “এইটা তর আঙ্গুলে থাকব? খুইলা পইরা যাবে না !!!” ছোট্ট আমি বললাম “আমি বড় হয়া পরমু। আমারে এইটাই কিন্না দ্যান। বিনা প্রশ্নে দাবি মঞ্জুর। দাদার মুখে মৃদু হাসি। বড় পবিত্র সেই মুখমণ্ডল, বড় পবিত্র সেই হাসি।

বাসায় ফিরে আমার আমার এই কৃতিত্ব আম্মুর সাথে হেসে হেসে গল্প করছিলেন দাদা। সেই আংটি নানা ভাঙ্গা গড়ায় আজও আছে। সুধু নেই আমার সৌম্য দর্শন দাদা। দাদা, আমি তখন ফোরে পড়ি। সেই সময় স্টাইল করে সানগ্লাস কেনার, চাওয়ার বা পরার কোনটারই সাহস ছিল না।

তখন আপনার চোখের ছানি অপারেশন হয় ঢাকায়। হাসপাতাল থেকে আপনাকে যেদিন বাসায় নিয়ে যাওয়া হল তখন আমার নজর ছিল আপনার চোখের সানগ্লাস এর দিকে। ইসস যদি পেতাম!! সবার আড়ালে আপনাকে ইচ্ছার কথা জানালাম। আপনি ধমক দিয়েছিলেন কি না মনে নেই তবে না করেছিলেন নিশ্চিত। আবারও চাইলাম, আপনি আবারও না করলেন।

তখন আমার শয়নে সানগ্লাস, স্বপনে সানগ্লাস টাইপের অবস্থা। পরে আম্মু আমাকে বুঝিয়ে বলল, আপনার সানগ্লাস মূলত অসুস্থতার জন্য। চোখে নিয়মিত নানা ওষুধ, ড্রপ দিতে হচ্ছে। আমার জন্য ওই সানগ্লাস নিরাপদ না। তাতে কি অল্প বয়সের মন ভোলে? আমি আবার গিয়ে ধর্না দিলাম।

আমি ভাল করে ধুয়ে তারপর পরব। শেষ পর্যন্ত পেলাম না। আপনি বাড়ি চলে গেলেন। কয়েকদিন পর স্কুল থেকে বাসায় ফিরে শুনলাম আপনি আমার জন্য সানগ্লাসটা পাঠিয়ে দিয়েছেন, তবে বারবার বলেছেন যাতে ভাল করে স্যাভলন দিয়ে ধুয়ে নেই। কিছুদিন পরে কৈশোরে উত্তীর্ণ এই আমি সেই সানগ্লাস টা বেশিদিন ব্যবহার করিনি।

অনেক সানগ্লাস পরেছি, হয়তো ভবিষ্যতে আরও পরব তবে আপনার স্নেহ মাখানো উপহারের তুল্য কিছু পাব কি? পারিবারিক, আর্থিক ও সম্পর্কের নানা জটিলতায় একসময় দেখা গেল তিন ভাইয়ের সবার ছোট আমার বাবা হঠাত উঠে আসলো পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত জমির পাশেই নিজের কেনা অর্ধ প্রস্তুত বাসায়। অপ্রস্তত অবস্থায় মোটা খরচের ধাক্কা সামলিয়ে বাসার কাজ শেষ করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো আব্বুকে। অবস্থা এমন যে একটা খাট বনাম আব্বু, আম্মু, আমি আর আমার সদ্য জন্মানো ফিডার খাওয়া ছোটবোন। এতোগুলো মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করার মত দৈর্ঘ্য প্রস্থ সেই খাটের ছিলনা। অগত্যা উপায় সেই বর্ষা বাদলের দিনে ফ্লোরিং।

সখ করে নয় বরং বাধ্য হয়ে নাতি মেঝেতে শোবে সেই অবস্থা হয়ত বৃদ্ধ সহ্য করতে পারতেননা। এমন অবস্থায় একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে শুনি দাদা আমার জন্য একটা খাট পাঠিয়েছেন। সেগুন কাঠের খাট। যেই খাটে আমার বাবার শৈশব কেটেছিল সেটাই দাদা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আপনি বলেছিলেন এটা আমার সদ্য পাওয়া ক্লাস ফাইভের স্কলারশিপের উপহার।

আজ মনে হয় স্কলারশিপের উপহার ব্যাপারটা ছিল কারো কারো মুখ বন্ধ করার জন্য আপনার অজুহাত, আমি ফেল করলেও আপনি দিতেন। দাদা, আমি এখনও বাসায় গেলে আপনার দেওয়া খাটে ঘুমাই, স্পর্শ করি আপনার দেওয়া উপহার। খাটটি আছে, শুধু নেই আপনি, আমার সৌম্য দর্শন দাদা। ভেবে অবাক হই, আজও যেই গ্রামে একই পরিবারে দুই জন এইচএসসি পাস ছেলে পাওয়া বিরল সেই একই গ্রামে থেকে আজ থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে আপনি আপনার ছেলে মেয়ে প্রত্যেক উত্তরাধিকারীদের স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। প্রত্যেক ছেলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছে।

আপনার মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন শিক্ষিত চমৎকার বরে, ঘরে। নাতি নাতনীদের মাঝে দুই জন ডাক্তার আরও দুই জন ডাক্তার হবার পথে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহন করেছে এবং করছে আরও পাচ জন, ইনশাল্লাহ এই সংখ্যা আরও বাড়বে সামনের সময়ে। যেই সময়ে মফস্বল জেলা শহরের প্রৌঢ় মধ্যবিত্তরা নিজেদের বিবাহযোগ্য ছেলেদের যৌতুক নিয়ে দরকষাকষি করত সেই সময়ে আপনি নির্দ্বিধায় আপনার প্রত্যেক ছেলের পছন্দের মূল্যায়ন করে পারিবারিক ভাবে তাদের ইচ্ছা পূরণে ব্রতী হয়েছিলেন। আধুনিকতার যেই সংজ্ঞা আমি বা আমাদের প্রজন্ম জানি সেই ফরমুলার আপনাকে মূল্যায়ন করার সাধ্য নেই। এই তথাকথিত আধুনিকতা থেকে যাবে, কিন্তু নিজের বিবেক উৎসরিত আধুনিকতার উদাহরন আপনি, আমার দাদা আর নেই।

জীবনের শেষ কিছু বছর আপনার কেটেছে নিতান্তই নিস্তেজ হয়ে। বয়সের ভার আপনাকে উঠে দাঁড়াতে দেয়নি। মস্তিস্কের স্মৃতিধারক কোষগুলোর অসহযোগিতায় একান্ত কাছের মানুষদেরও চিনতে পারেননি। তাতে কি? আপনার শারীরিক উপস্থিতিটুকুই একটা শান্তির প্রলেপ দিত। উল্টোটাও হতে পারে।

হয়তো অবচেতন ভাবে আমরা সবাই প্রস্তুত ছিলাম আপনার প্রস্থানের। কিন্তু তাহলে এত কষ্ট হয় কেন? আপনার অনুপস্থিতিই যেন সমগ্র সত্ত্বা ধ্বনিত করে চলেছে আপনি ছিলেন, কি বিপুল অস্তিত্ব নিয়ে আপনি ছিলেন!! যে অনুপস্থিতি আর পূরণ হবার নয়। কখনই নয়। পরম করুনাময় আপনাকে যেখানেই রাখুক তা যেন শান্তিময় হয়। (গত ১৮ নভেম্বর উনি পরলোক গমন করেন।

তাঁর প্রস্থানের ৪০ দিন পূর্ণ হবার মাত্র দুই দিন বাকি। দিনগুলি কিভাবে চলে যায় লেখাটা আগের, তবে আজ পোস্ট করলাম। ) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।